কালেরকন্ঠ
এস এম সাদ্দাম হোসেন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতির নামে নাম হলেও তিনি ছিলেন কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা এই তরুণ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হয়েই যেন পেয়ে যান আলাদিনের চেরাগ! অল্পদিনেই তিনি গড়ে তুলেছেন শত কোটি টাকার সম্পদ। পাহাড় কেটে সাবাড়, একের এক জমি রেজিস্ট্রি, গরু ও স্বর্ণ চোরাচালান থেকে শুরু করে মাদক ব্যবসা, অপরাধ জগতের কোন কিছুই বাদ যায়নি তার হাত থেকে।
আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানকের ‘আপন লোক’ পরিচয়ে সব জায়গায় প্রভাব খাটিয়ে সাদ্দাম হোসেন নিজের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। যদিও সভাপতি হওয়ার আগপর্যন্ত ছাত্রলীগের সাবেক জেলা সভাপতি ইশতিয়াক আহমদ জয়ের ভয়ে তিনি কক্সবাজার শহরেই পা দিতেন না।
ছাত্রলীগ ও স্থানীয় একাধিক সূত্র মতে, ছাত্রলীগের কক্সবাজার জেলা সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর এস এম সাদ্দাম হোসেন কক্সবাজার শহরের হোটেল-মোটেল জোনে নিজের ইয়াবা সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন। তৎকালীন এক র্যাব কর্মকর্তার নাম ব্যবহার করে তিনি অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়েন।
এই সুযোগে তিনি ভয় দেখিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রচুর টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
প্রতি সপ্তাহেই রামু উপজেলা ভূমি অফিসে সাদ্দাম হোসেনের নামে-বেনামে জমির লেনদেন হতো। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভূমি কর্মকর্তার মতে, সাদ্দাম হোসেন এখন শত কোটি টাকার মালিক।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, সাদ্দাম হোসেন ছিলেন নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান।
তার বাবা নুরুল হকের গরুর ব্যবসা থাকলেও তা তেমন বড় কোন ব্যবসা ছিল না। নুরুল হক তার দুই স্ত্রী ও ৭ সন্তান নিয়ে কোন রকমে সংসার চালিয়ে আসছিলেন। সেই ঘরের সন্তান হলেন এস এম সাদ্দাম হোসেন। কক্সবাজারের কাছের উপজেলা রামুর জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের মুরা পাড়ার বাসিন্দা।
টানাপড়েনের সেই সংসার থেকে উঠে আসা সাদ্দাম হোসেন এখন কোটিপতি।
অনেকের মতে, তিনি এখন কয়েক শত কোটি টাকার মালিক।
ছাত্রলীগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্রগুলো বলছেন, গরু চোরাচালান, স্বর্ণ চোরাচালান, জমির ব্যবসা, মাদকের কারবার ছাড়াও সাদ্দাম হোসেনের আরেকটি বড় ব্যবসা ছিল ছাত্রলীগের কমিটি বাণিজ্য। এই কমিটি বাণিজ্য করেই তিনি লাখ লাখ টাকা কামিয়েছেন।
সূত্রগুলোর মতে, ছাত্রলীগ নেতা হত্যা মামলার আসামি আব্দুল হান্নান নামের এক বিবাহিত যুবককে অর্ধ-কোটি টাকার বিনিময়ে কুতুবদিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক করেছিলেন এই সাদ্দাম হোসেন। ২৫ লাখ টাকায় তানভীরকে করেছিলেন চকরিয়ার মাতামুহুরী ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। আর ছাত্রলীগের উপজেলা কমিটিতে মূল পদে আনার কথা বলে কয়েকজনের কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্র জানান, সাদ্দাম হোসেন রামু উপজেলা ও মহেশখালী উপজেলায় ছাত্রলীগের কমিটিতে সম্মানজনক পদ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি টাকা।
কক্সবাজার জেলা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের ঠিকাদারদের অভিযোগ, জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন তাদের সাথে প্রতারণা করে ৩০ কোটি টাকার কাজ হাতিয়ে নিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ দিয়েও কোন সুরাহা পাওয়া যায়নি।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের দাবি, মিয়ানমার কেন্দ্রিক গরু চোরাচালান সিন্ডিকেটের মূল দায়িত্ব পালন করতেন কক্সবাজার ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে আস্তানা গেড়ে চোরাচালান চালিয়ে যাওয়া ‘স্মাগলিং কিং’ এনামুল হক ওরফে এনাম ডাকাতের সিন্ডিকেটের হয়ে কাজ করতেন সাদ্দাম হোসেন। এনাম ডাকাত মিয়ানমার থেকে সীমান্ত পার করে গরু নিয়ে আসতেন জোয়ারিয়ানালা পাহাড়ি এলাকায়। সেই গরু পাহাড় থেকে ট্রাকে তোলার দায়িত্ব পালন করতেন সাদ্দাম। প্রতি গরু থেকে সাদ্দাম হোসেন পেতেন আড়াই হাজার টাকা। তার হয়ে চোরাচালান দেখাশোনা করেন নিজের ভাই আবদুস শুক্কুর। এখনও তিনি এই সিন্ডিকেট চালিয়ে যাচ্ছেন।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, পাহাড় কেটে মাটি বিক্রি করা সাদ্দাম হোসেনের টাকা উপার্জনের আরেকটি মাধ্যম। তিনি ও তার স্বজনরা ইতোমধ্যে জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়নের ১০ থেকে ১২টি পাহাড় কেটে সাবাড় করে ফেলেছে। আর পাহাড় কাটার পুরো বিষয়টি সমন্বয় করতেন সাদ্দাম হোসেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, সাদ্দাম হোসেনের বাবা নুরুল হক গরুর ব্যবসার পাশাপাশি কৃষক হিসেবে কাজ করে সংসার চালাতেন। সেই সংসারের ছেলে সাদ্দাম হোসেন কিভাবে কোটি টাকার মালিক হলেন তা খুঁজে পেতে দুদকের অনুসন্ধান চালানো উচিৎ বলে মনে করেন।
রামু ভূমি অফিসের একটি সূত্রের দাবি, সাদ্দাম এখন শত কোটি টাকার মালিক। ওই সূত্রের দাবি, ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন প্রতি সপ্তাহেই রামু ভূমি অফিসে জায়গার লেনদেন করতেন। তার হয়ে কাজ করতেন নিজের ভাই আবদুস শুক্কুর, যিনি পেশায় একজন ট্রাক চালক। সাদ্দাম হোসেনকে ব্যবহার করে এই আবদুস শুক্কুরও আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছেন।
জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি হওয়ার আগপর্যন্ত ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সাদ্দাম হোসেনকে কেউ চিনতোই না। অদৃশ্য শক্তি বলে তিনি হঠাৎ হয়ে যান কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। আর সভাপতি হওয়ার পর তার অপরাধ জগতের দরজা খুলে যায়।
এ ব্যাপারে জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি এস এম সাদ্দাম হোসেনের বক্তব্য নেয়ার চেষ্টা করা হলেও ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে আত্মগোপনে থাকায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এস এম সাদ্দাম হোসেন স্বৈরাচারী সরকারের পতনের মুহূর্ত আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি ৪ আগস্ট বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যান। যতটুকু জানা গেছে, তিনি এখন মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন।