প্রতিদিন সকালে নিয়ম করে বাংলাদেশের পতাকা তোলেন এবং সন্ধ্যায় নামিয়ে রাখেন। এখানে বেড়াতে আসা পর্যটকরাই একমাত্র তাদের আয়ের উৎস। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এভাবেই চলছে এই পরিবারটির জীবন-সংগ্রাম। লিখেছেন এমএম সালাহউদ্দিন
বাংলাদেশের মানচিত্রে সর্ব দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে যে বিন্দুর মতো চিহ্ন দেখা যায় সেইটাই দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন। অনিন্দ্য সুন্দর এ দ্বীপটির সঙ্গে পর্যটকদের পরিচয় করিয়েছেন প্রখ্যাত লেখক হুমায়ূন আহমেদ। সেন্টমার্টিন থেকেও কিছুটা দূরে আছে ছেড়াদ্বীপ। জোয়ারের সময় এটি সেন্টমার্টিন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বলে এর নাম রাখা হয় ছেড়াদ্বীপ। বাংলাদেশের শেষ স্থলসীমা এটি।
এ বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝি সোনারগাঁও (নারায়ণগঞ্জ) থেকে আমরা ১৪ জনের একটি দল যাত্রা করলাম টেকনাফের উদ্দেশে। আমাদের গন্তব্য বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে নৈস্বর্গিক সোভামণ্ডিত ভূখণ্ডের শেষবিন্দু ছেড়াদ্বীপ। আমাদের টিমের সবাই সাংবাদিক। তারা সবাই সোনারগাঁও রিপোর্টার্স ক্লাবের সদস্য।
একাধিকবার ছেড়াদ্বীপ ভ্রমণ করা সাংবাদিক রিপন সরকার মূলত আমাদের এ সফরের গাইড। ঢাকা থেকে রাত ৮টায় ছেড়ে আসা আমাদের বহনকারী সেন্টমার্টিন পরিবহনের বাসটি টেকনাফ গিয়ে থামল পরের দিন সকাল সাড়ে ৭টার দিকে। এর মধ্যে অবশ্য কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে দুইবার যাত্রাবিরতি করে। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ যেতে ভোরের নরম আলোয় দেখলাম অপরূপ পাহাড় ঘেরা পথ দিয়ে চলছে আমাদের বাস। কোথাও লেখা বন্যহাতির চলার পথ, সাবধানে চলুন। আবর কোথাও চোখে পড়ল রাস্তার পাশে ঝোঁপরি গেড়ে অসহায় রোহিঙ্গাদের মানবেতর জীবনযাপন।
টেকনাফ থেকে জোয়ার-ভাটার মর্জির উপর ভর করে চলাচল করে সেন্টমার্টিনগামী জাহাজ। এর মধ্যে কুতুবদিয়া, কেয়ারী সিন্দাবাদ ও গ্রিনলাইনের মান ভালো। গ্রিনলাইন সম্পূর্ণ শিতাতপ নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় এর ভাড়া অন্য জাহাজগুলোর চেয়ে দ্বিগুণ। কুতুবদিয়া জাহাজে সেন্টমার্টিন যেতে যেখানে সাধারণ সিটের মাথাপিছু ভাড়া ৯০০ টাকা, সেখানে গ্রিনলাইনে ১৬ টাকা থেকে শুরু করে কেবিনে আরও কয়েক গুণ বেশি ভাড়া গুনতে হয়।
আমরা কুতুবদিয়া জাহাজের নাবিকের ডানপাশে এনক্লোজারটা পুরোটাই ভাড়া করলাম। সকাল সাড়ে ৯টায় টেকনাফ থেকে জাহাজটি ছাড়ার পর আমাদের জাহাজের পিছু নিল শঙ্খচিলের (গাঙচিল) দল। সে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। আমরা পফ্ট কর্ন হাতের তালুতে রাখছি আর শঙ্খচিলগুলো বাতাসে ভেসে ভেসে সেগুলো খুটে খুটে খাচ্ছে। নাফ নদী দিয়ে সমুদ্রে প্রবেশের আগ পর্যন্ত এগুলো অনেকটা অতিথিকে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যাওয়ার মতো জাহাজের পিছু পিছু এগুলো খেলা করতে করতে আসে। যাত্রীরা এতে প্রচুর বিনোদন পান, বিশেষ করে শিশুরা। পর্যটকরা নিজে খাওয়ার চেয়ে এগুলোকেই চিপস বা পফ্ট কর্ন খাওয়ানোতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
তিন ঘণ্টা পর দুপুর সাড়ে ১২টায় আমাদের জাহাজ ভিড়ল সেন্টমার্টিনের একমাত্র জেটিতে। আমরা প্রবেশ করলাম আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ও বিদ্যুৎবিহীন প্রাকৃতিক ছায়ায় ঘেরা অপরূপ সুন্দর দ্বীপ সেন্টমার্টিনে। সেখানে আগে থেকেই আমাদের কটেজ ভাড়া করাছিল। আমরা গিয়ে উঠলাম নারকেল বাগান এলাকার হাজি মো. সালেহ মিয়ার কটেজে। সেখানে তাকে আগে থেকেই সবার খাবার রেডি রাখার কথা বলা ছিল। গিয়ে সবাই ফ্রেশ হয়ে খেয়েদেয়ে বিকাল পর্যন্ত ঘুমিয়ে সন্ধ্যার আগেই বেড়িয়ে পড়লাম সাগরের তীরে। শতাব্দী পুরনো এ দ্বীপটি ধীরে ধীরে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আগে এর আয়তন ছিল ১০ বর্গমাইল, বর্তমানে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৮ বর্গ মাইলে। দ্বীপটিতে বর্তমানে সাড়ে দশ হাজার মানুষের বসবাস। এর মধ্যে ভোটার সংখ্যা ৩ হাজার ১০০ জন।
১৯৮১ সাল থেকে সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ এখানে একটি বড় জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে শতাধিক বাড়িতে সরবরাহ করত। কিন্তু ১৯৯৪ সালে প্রলয়ংকরী এক ঘূর্ণিঝড়ে এটি নষ্ট হলে পরে আর মেরামত করে সচল করা হয়নি। তবে প্রখ্যাত লেখক হুমায়ূন আহমেদের তৈরি সমুদ্রবিলাস, পর্যটন কর্পোরেশনের কটেজসহ বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ছোট-বড় কটেজ। এগুলোতে সোলার প্যানেল ও সময় করে জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। তবে এখানে সবকিছুর দামই বেশ চড়া। ঢাকায় যে পানির বোতল ২০ টাকা সেটা এ দ্বীপে ৬০ টাকা, আর ছেড়াদ্বীপে ৮০ টাকা করে।
এখানকার অধিবাসীদের বেশিরভাগই জেলে। তবে, পর্যটন মৌসুমে বছরের অর্ধেক সময় তারা দ্বীপে দোকানপাট দিয়ে আয় করে। বছরের বাকি সময় কাটে সমুদ্রে মাছ ধরে। এখারকার বাসিন্দারা খুবই ধর্মপরায়ণ। খুবই পর্দানশীল এখানকার নারীরা।
রাতে সমুদ্র তীরে ঢেউয়ের গর্জন আর তার মধ্যে শুরু হয় স্থানীয় বাউল আলম ও আমিনের মনকারা সঙ্গীত পরিবেশন। রাত তিনটা পর্যন্ত চলত এ গানে আসর। সত্যি এ এক অপার্থিব অভিজ্ঞতা।
স্পিড বোট ভাড়া করে সেন্টমার্টিনের মূল ভূখণ্ড থেকে যাওয়া যায় ছেড়াদ্বীপে। ৪০ মিনিটের সমুদ্রযাত্রা শেষে দেখা মিলবে গভীর নীল পানি বেস্টিত স্বপ্নের সেই ছেড়াদ্বীপের। পানি এখানে প্রচণ্ড নোনতা।
সেন্টমার্টিন ভ্রমণের মূল আকর্ষণ এই ছেড়াদ্বীপ। কেয়াবন বেস্টিত মনোরম এ দ্বীপটির চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে প্রবাল পাথর। এখানে পানিতে নামতে হলে ধারালো প্রবাল থেকে আপনার পা রক্ষা করতে হলে অবশ্যই আপনাকে প্লাস্টিকের স্যান্ডেল পরতে হবে।
গত একযুগ ধরে নির্জন এ দ্বীপে বাস করছেন রহিমা খাতুন নামে এক নারী। স্বামী মারা যাওয়ার পর সন্তানদের ভরণপোষণের জন্য তাদের যেটুকু জমি ছিল তা বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে যান তিনি। পরে সরকারি অনুমোতি নিয়ে বসবাস করছেন এখানে।
ছেলে সাদ্দাম ও পুত্রবধূকে নিয়ে জনমানবহীন এ দ্বীপের বাসিন্দা বলতে তিনি এবং তার পরিবার। প্রতিদিন সকালে নিয়ম করে বাংলাদেশের পতাকা তোলেন এবং সন্ধ্যায় নামিয়ে রাখেন। এখানে বেড়াতে আসা পর্যটকরাই একমাত্র তাদের আয়ের উৎস। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এভাবেই চলছে তার জীবন-সংগ্রাম। সরকারি কোনো সাহয্য-সহযোগিতা তো পানই না, সমুদ্র উত্তাল থাকলে ঠিকমতো তিন বেলা খাবার জোটেনা বাংলাদেশের শেষ সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরিদের। এ বছর থেকে কেবল পর্যটন মৌসুমে তাদেরকে সেখানে থাকার অনুমতি দেয়া হচ্ছে।