ছোট হয়ে আসছে এনজিও’র দুনিয়া। তহবিল সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক এনজিও। বাতিল হয়েছে অনেকের নিবন্ধন। বাতিলের অপেক্ষায় রয়েছে আরও বেশকিছু। বৈশ্বিক মহামারি ও অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাবে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে দাতা সংস্থাগুলো। সরকারের নিয়ম-নীতি ও পদ্ধতিগত পরিবর্তন আসছে ধারাবাহিকভাবে। সবমিলিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে দেশের এনজিও খাত। গত ১০ বছরে এনজিওগুলোর বিদেশি ফান্ড প্রাপ্তির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিদেশি অর্থের প্রবাহ ক্রমান্বয়ে কমছে। দেশে সর্বোচ্চ পরিমাণে ফান্ড ছাড় হয়েছে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় ৭ হাজার ৯২৯ কোটি টাকা। এই ফান্ড প্রাপ্তির পেছনের অন্যতম কারণ ছিল ২০১৭ সালের রোহিঙ্গা সংকট।
পরবর্তী ২০১৯-২০ অর্থবছরে ফান্ড ছাড় হয়েছে প্রায় ৭ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা ফান্ড ছাড় হয়েছে। গত জুলাই মাসে ফান্ড ছাড়া হয়েছে ৬৬৬ কোটি টাকা। গত কয়েক বছরে ছাড় হওয়া ফান্ডের উল্লেখযোগ্য অংশ গেছে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে। ফলে কক্সবাজার কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে দেশি-বিদেশি এনজিওগুলোর কার্যক্রম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশি তহবিল কম পাওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানের পরিবর্তন। বাংলাদেশের জিডিপি ও মাথাপিছু আয়ের যে হিসাব প্রচার করা হচ্ছে তা দেখে বিদেশি দাতা সংস্থাগুলো তহবিল প্রদানে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। তারা আফ্রিকাসহ বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোতে তাদের কার্যক্রম বৃদ্ধি করছে।
এ ছাড়া দাতা সংস্থাগুলো তাদের কাজের পদ্ধতিও পরিবর্তন করেছে। সংস্থাগুলো বাংলাদেশেই নিজেদের শাখা খুলে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এতে করে স্থানীয় পর্যায়ের এনজিওগুলো বিদেশি তহবিল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এনজিওগুলোকে অর্থায়নের ক্ষেত্রেও পদ্ধতি বদলেছে সরকার। এখনো সরাসরি প্রকল্প প্রদান না করে টেন্ডারের মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকারি দপ্তরগুলো। এসব টেন্ডারে অংশগ্রহণের জন্য যে ধরনের শর্ত দেয়া হচ্ছে তাতে অনেক এনজিও এসব শর্ত পূরণ করতে পারছে না। অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠান টেন্ডারে অংশগ্রহণের জন্য এনজিও ব্যুরো নিবন্ধন কিংবা ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনার সনদ থাকার শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। যা প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এনজিওদের তহবিলের আরেকটি উৎস ছিল ব্যাংক ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সিএসআর (সোশ্যাল করপোরেট রেসপন্সিবিলিটি)। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো সিএসআর-এর অর্থ সামাজিক কাজে ব্যয়ের পরিবর্তে নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কাজে ব্যয় করছে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে কাজের ধরন পাল্টাতে হচ্ছে এনজিওগুলোকে। অতীতে এনজিওগুলোর মূল কার্যক্রম ছিল সচেতনতা সৃষ্টি কেন্দ্রিক।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষিভিত্তিক উন্নয়ন কার্যক্রমে এনজিওগুলো অগ্রণী ভূমিকা পালন করতো। দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় যেখানে সরকারের পক্ষে কাজ করা সম্ভব ছিল না সেখানে সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে এনজিওরা। কিন্তু সেবামূলক কাজের পরিবর্তে অর্থনৈতিক কার্যক্রমে বেশি যুক্ত হচ্ছে এনজিওগুলো। বিদেশি ফান্ডের প্রবাহ কমার পেছনে স্বল্পন্নোত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণকে কারণ মনে করেন এসোসিয়েশন অব ডেভেলপমেন্ট এজেন্সিস অব বাংলাদেশ (এডাব) এর সভাপতি মো. আব্দুল মতিন। তিনি বলেন, তহবিল সংকটের কারণে ছোট এনজিওগুলোর টিকে থাকা কঠিন হয়ে গেছে। অনেক এনজিও বন্ধ হয়ে গেছে। সরকার যে উন্নয়ন ও অগ্রগতির কথা বলছে তা সুষম না। এখনো বহু এলাকার মানুষ উন্নয়ন বৈষম্যের শিকার। তাদের মধ্যে অভাবের তাড়না রয়েছে। যেখানে সরকারের পাশাপাশি এনজিওগুলোর কাজ করার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু সুশাসন, মানবাধিকার ও জবাবদিহিদার ঘাটতিও দাতা সংস্থাগুলোর মুখ ফেরানোর পেছনের অন্যতম কারণ বলেও মনে করেন তিনি। তবে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম পরিচালনাকারী সংস্থাগুলো ভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। বড় বড় সংস্থাগুলো ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান কিংবা পিকেএসএফ থেকে ঋণ নিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের তহবিল সংগ্রহে এই সুবিধা নিতে পারছে না। এর পেছনে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা ও তাদের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিগত সমস্যা রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখতে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এনজিওদের সংগঠন ফেডারেশন অব এনজিও’স ইন বাংলাদেশ (এফএনবি)। সংগঠনটির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভাপতি এবং ব্যুরো বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন বলেন, ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর তহবিল সংকট দূর করতে আমরা ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছি। কোনো নির্দিষ্ট একটি ব্যাংক যদি তাদের অর্থায়নে আগ্রহী হয় তাহলে এই শ্রেণির প্রতিষ্ঠানগুলো সহজেই তাদের তহবিল সংগ্রহ করতে পারবে। এ ছাড়া বড় এনজিওগুলোকেও এ ব্যাপারে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। গত জানুয়ারিতে ২০টি এনজিওর নিবন্ধন বাতিল করেছে এনজিও ব্যুরো। ২০২১ সালে বাতিল হয়েছে ২২টি এনজিও’র নিবন্ধন। ২০১৯ সালে বাতিল হয়েছে ২ শতাধিক এনজিও’র নিবন্ধন।
সুত্র : মানবজমিন