বিদেশে প্রশিক্ষণ চলছে মাসের পর মাস। মালয়েশিয়া, তুরস্ক, সিরিয়াসহ নানা দেশে যাচ্ছে-আসছে। হামলায় ব্যবহার হচ্ছে অত্যাধুনিক সব অস্ত্র। শূন্য হাতে বাড়ি থেকে নিখোঁজ হওয়া তরুণ জঙ্গিরা এত কিছু করার টাকা পাচ্ছে কোথা থেকে? এর কারণ অনুসন্ধানে নেমে জানা গেছে, এ অর্থের জোগানদাতা এ দেশের কিছু ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ। এ ধরনের ৪৮ জনকে চিহ্নিত করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পাশাপাশি ১৪টির মতো এনজিও জঙ্গিদের পেছনে বিপুল অর্থ ঢালছে। এগুলোর বেশির ভাগই আন্তর্জাতিক এনজিও, কার্যক্রম রয়েছে বাংলাদেশেও। এ ছাড়া প্রবাসী রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন ইসলামী দল সমর্থিত কর্মীরা জঙ্গিবাদে অর্থায়ন করছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত বিভিন্ন দেশ এবং সুদূর আফ্রিকা থেকেও বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান টাকা পাঠাচ্ছে বলে জানা গেছে। জঙ্গি অর্থায়নের দায়ে গতকাল সিঙ্গাপুরে চার বাংলাদেশির বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়েছে। জঙ্গিবাদে অর্থায়নের উৎস চিহ্নিত করতে সরকার উচ্চ পর্যায়ের টাস্কফোর্স গঠন করেছে। আইন সংশোধন করে এনজিওর বিদেশি অনুদান প্রাপ্তি কঠিন করা হয়েছে, শাস্তি বাড়িয়ে তদন্ত সংস্থাও বাড়ানো হয়েছে অর্থপাচার প্রতিরোধ আইন সংশোধন করে। এর পরও দেশ-বিদেশ থেকে জঙ্গি অর্থায়নের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে হাটহাজারীসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে জঙ্গি সংগঠন শহীদ হামজা ব্রিগেডের ২৯ সদস্যকে গ্রেপ্তার এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে র্যাব। এর আগে হামজা ব্রিগেডের ‘ব্লু গ্রুপের’ নেতা মনিরুজ্জামান ডনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অভিযোগ রয়েছে, এই সংগঠনের জন্য এক কোটি আট লাখ টাকা সংগ্রহ করেন কয়েকজন আইনজীবী। এর মধ্যে বিএনপি নেতা ও সাবেক হুইপ সৈয়দ ওয়াহিদুল আলমের মেয়ে ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা ২৫ ও ২৭ লাখ টাকা করে দুই দফায় ৫২ লাখ টাকা, সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী হাসানুজ্জামান লিটন ৩১ লাখ এবং ঢাকা জজকোর্টের আইনজীবী মাহফুজ চৌধুরী বাপন ২৫ লাখ টাকা করে জমা করেন। এ অভিযোগে গত বছরের আগস্ট মাসে তিন আইনজীবীকে গ্রেপ্তার করা ছাড়া আর কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সেই আইনজীবীরাও এখন জামিনে।
জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ততার কারণে সরকার এ পর্যন্ত ছয়টি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করেছে। এর মধ্যে ২০০৩ সালে নিষিদ্ধ হয় শাহাদাত-ই-আল হিকমা পার্টি বাংলাদেশ, ২০০৫ সালে জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) ও হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী। ২০০৯ সালে নিষিদ্ধ করা হয় হিযবুত তাহ্রীর বাংলাদেশ এবং গত বছর নিষিদ্ধ হয় আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি)। এসব জঙ্গি সংগঠনসহ জামায়াত-শিবির ও বিভিন্ন ইসলামী দলের অনেক কর্মী বিদেশে রয়েছে, যারা প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জঙ্গি সংগঠনগুলোকে দিচ্ছে বলে জানা গেছে।
এ ছাড়া জঙ্গি অর্থায়নের অন্যতম উৎস অস্ত্র ও মাদক চোরাচালান। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘কমবেটিং টেররিজম সেন্টার’-এর তথ্য মতে, বাংলাদেশ অবৈধ অর্থে ভরপুর। সন্ত্রাসীরা এর বড় সুবিধা ভোগ করছে। ভারত থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ পণ্য চোরাচালান হয়ে আসে, যার সঙ্গে উভয় দেশের জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোও সম্পৃক্ত। ক্ষুদ্র অস্ত্র, মাদক ও জাল
ডলার ছাপানোও বাংলাদেশে জঙ্গি অর্থায়নের উৎস। এর বেশির ভাগই বাংলাদেশে ঢোকে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল ও মিয়ানমার হয়ে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় ঢাকায় অভিযান চালিয়ে জেএমবির যেসব আস্তানার খোঁজ মিলেছে, এর বেশির ভাগেরই মালিক সৌদিপ্রবাসী বাংলাদেশিরা।
জঙ্গি অর্থায়নের উৎস খুঁজতে উচ্চ পর্যায়ের একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। ২০১৪ সালে গঠিত ওই টাস্কফোর্সের দ্বিতীয় সভা হয় ২০১৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। তাতে ছয়টি সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে ইসলামী শরিয়াহ আইনে পরিচালিত ব্যাংকগুলোতে সুদমুক্ত আমানতকারীদের সুদ বা লভ্যাংশের কত টাকা শুরু থেকে এ পর্যন্ত জমা হয়েছে এবং এ অর্থ কোথায় ব্যয় হয়েছে তার একটি হিসাব দিতে হবে। আর ইসলামী ব্যাংকিং পরিচালনার জন্য আলাদা কোনো আইন না থাকায় সাধারণ ব্যাংকিং আইনে কোনো বিধান সংযোজন করে বিদ্যমান আইনটি সংশোধন করা যায় কি না, তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে এ দুটিসহ মোট ছয়টি সিদ্ধান্ত তুলে ধরে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে চিঠি পাঠায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এরপর এক বছর পার হয়ে গেলেও ওই চিঠির উত্তর দেয়নি সংশ্লিষ্ট কেউই। এ অবস্থায় গত ৮ মে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. কামরুল হাসান খান স্বাক্ষরিত আরেকটি তাগিদপত্র পাঠানো হয়েছে মন্ত্রণালয়গুলোতে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জঙ্গিদের যারা অর্থ ও আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে তাদের চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তারা জঙ্গি সংগঠনগুলোকে অর্থ দিচ্ছে। এ বিষয়ে আরো তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। এরপর আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব।’
একই কথা বলেছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক ও র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। তাঁরা বলেন, ‘জঙ্গিদের অর্থের জোগানদাতা ও সহায়তাকারীদের ধরা হবে। জঙ্গিদের সহায়তাকারী অনেককেই আমরা চিহ্নিত করতে পেরেছি।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘জঙ্গিদের যারা অর্থ দিয়ে সহায়তা করছে, তাদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে। আশা করি, অল্প সময়ের মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।’
জঙ্গি সাইফুল টাকা পেত ছয় দেশ থেকে বাংলাদেশি আইএস জঙ্গি সাইফুল হক সুজন গত ১০ ডিসেম্বর সিরিয়ায় মার্কিন বিমান হামলায় নিহত হয়। যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইবাকস লিমিটেড ও ইবাকসটেল ইলেকট্রনিকস লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা সে। পরে তার বাবা আবুল হাসানাতকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেয় ডিবি পুলিশ। হাসানাত জানান, সিরিয়ায় আইএসের প্রধান হ্যাকার সাইফুলের গড়া ইবাকসের ঢাকা কার্যালয়কে সন্ত্রাসবাদে অর্থ আদান-প্রদানের কাজে ব্যবহার করা হতো। সাইফুলের ভাই আতাউল হক বিদেশ থেকে ঢাকা কার্যালয়ের হিসাবরক্ষক নাহিদউদ্দোজা মিয়ার কাছে টাকা পাঠাত।
গত ১৮ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মহাব্যবস্থাপক দেবপ্রসাদ দেবনাথ স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদন অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে বলা হয়েছে, নিহত জঙ্গি সাইফুল ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে আটটি ব্যাংকে থাকা মোট ৩৭টি হিসাবের তথ্য সংগ্রহ ও পর্যালোচনা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩০টি হিসাবের লেনদেন সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর থেকে স্থগিত করা হয়েছে। এসব হিসাবে ১৩ লাখ ৭২ হাজার টাকা জমা রয়েছে।
ওই ৩০টির মধ্যে ইবাকস এবং ইবাকসটেল ইলেকট্রনিকসের দুটি হিসাবে এফটিটির মাধ্যমে ২০১২ সাল থেকে ২০১৫ পর্যন্ত দুই কোটি ২২ লাখ টাকা জমা হয়েছে। এসব অর্থ এসেছে মূলত ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, যুক্তরাজ্য, সুরিনাম, স্পেন ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এসব দেশের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ও মেইনটেন্যান্স চার্জ হিসেবে এ অর্থ পাঠিয়েছে। হিসাব দুটিতে বিদেশ থেকে কোন কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান টাকা পাঠিয়েছে তার তথ্য জানতে বাংলাদেশ ব্যাংক এগমন্ড সিকিউরড ওয়েব (ইএসডাব্লিউ) এবং ওই সব দেশের ফাইন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটগুলোকে অনুরোধ করেছে।
বিএফআইইউর সর্বশেষ ‘বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৪’ অনুযায়ী, বাংলাদেশের ব্যাংক, বীমাসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সন্দেহজনক লেনদেনের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এসব লেনদেনে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া মানা হচ্ছে না। সাধারণত অপরাধ কিংবা সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কোনো সন্ত্রাসী গ্রুপ বা একক কোনো সন্ত্রাসীকে এসব লেনদেনের মাধ্যমে অর্থায়ন করা হচ্ছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে এ ধরনের সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে ৬১৯টি। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ৪২০টি। আর ২০১১-১২ অর্থবছরে সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে ১৭৫টি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদেশ থেকে অর্থ আসা ছাড়াও হিসাব দুটিতে নগদে অর্থ জমা হয়েছে। জমা হওয়া এ অর্থের বড় অংশ তুলে নেওয়াও হয়েছে। এসব নগদ লেনদেন হয়েছে নাহিদউদ্দোজা মিয়ার নামে। এ ছাড়া মো. আতাউল হক, জাহাঙ্গীর, মো. মশিউর রহমান, মো. আনিসুর রহমান, মামুনুর রশিদ, আবুল হাসানাত, মাহবুবুল হক, কালাম, মুন্না, হোসেন আহমেদ, মিঠু, মাহি, মো. আলি, মো. আবু হানিফ, অজিত বাবু, মোহাম্মদ তাজুল ইসলামও ওই সব অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলেছেন। অন্য ২৮টি হিসাবের টাকাও নগদে লেনদেন হয়েছে। এই ৩০টি হিসাবই নাহিদউদ্দোজার স্বাক্ষরে পরিচালিত হয়েছে। তবে এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে ফরেন ট্রেড সংক্রান্ত কোনো হিসাব পরিচালনার তথ্য নেই।
জঙ্গিবাদের ৪৮ মদদদাতা চিহ্নিত : জঙ্গিদের অর্থের জোগান ও মদদ দেওয়ার অভিযোগে ৪৮ জনকে চিহ্নিত করেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। দেশের বেশির ভাগই বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী। প্রবাসী বাংলাদেশিরাও রয়েছে এ তালিকায়। চিহ্নিত অর্থদাতাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে বিগত চারদলীয় জোট সরকারের মন্ত্রী-এমপিও আছেন।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, দীর্ঘদিন ধরেই দেশ-বিদেশের একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে জঙ্গিদের অর্থ জোগাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো জঙ্গিদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলেও অর্থদাতাদের আইনের আওতায় আনতে পারছে না। এ নিয়ে র্যাব-পুলিশ সমালোচনার মধ্যে পড়েছে। সম্প্রতি গুলশান ও কিশোরগঞ্জে বড় ধরনের জঙ্গি হামলার পর টনক নড়ে পুলিশ সদর দপ্তরের। কর্তাব্যক্তিরা দফায় দফায় বৈঠক করছেন। সরকারের শীর্ষ মহলও পুলিশকে নির্দেশনা দিয়েছে মদদদাতা ও অর্থের জোগানদাতাদের চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে। নির্দেশ পেয়ে র্যাবসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাদের চিহ্নিত করতে মাঠে নামে। এরই মধ্যে র্যাব ৪৮ জনের নাম পেয়েছে।
এ প্রসঙ্গে র্যাবের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘৪৮ জন অর্থদাতার মধ্যে ১৫-১৬ জন কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতা। তাঁদের মধ্যে রাজশাহীর ব্যবসায়ী আবদুল লতিফ, খুলনার রোস্তম ফরাজী, ঝিনাইদহের রুহুল আমিন, কুমিল্লার মোহাম্মদ শরীফ, চটগ্রাম ও কক্সবাজারের লতিফ বিশ্বাসের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে। তাঁরা জঙ্গি বা অন্য কোনো সংগঠনকে আর্থিক সহায়তা করেছেন বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। তা ছাড়া সাতজন দেশের বাইরে থেকে কলকাঠি নাড়ছেন। রাজশাহীর পুটিয়া, বাগমারা, দৌলতপুর, কাটাখালী, শিবপুর, বিড়ালদহ, বানেরচর, গোয়ালকান্দি, তাহেরপুর, নলডাঙ্গা, আত্রাই, রানীনগর, কালুপাড়া, হামিরকুচ্ছা, ঝুগিপাড়া, কুষ্টিয়া, ভেড়ামারা, নওঁগা, দিনাজপুর, হাকিমপুর, লালমনিরহাট, রংপুর, নওগাঁ, সিলেট, কুমিল্লার দেবীদ্বার, চট্টগ্রামসহ আরো কয়েকটি এলাকায় মদদদাতারা অবস্থান করছেন। তাঁদের পুরো জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহ করা হয়েছে।’
গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, সিলেটের শাহজালাল মিয়া, খুলনার মাওলানা মুফতি রউফ, ঢাকার মাওলানা জহির উদ্দিন, মাওলানা মামুনুর রশীদ, চট্টগ্রামের সাঈদ আহম্মদ জঙ্গিদের অর্থ দিচ্ছেন। তাঁরা এক সময় জামায়াত করতেন। তাঁদের সঙ্গে হিযবুত তাহ্রীরের সুসম্পর্ক আছে।
এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, সৌদি আরব, পাকিস্তান, আরব আমিরাত থেকে জেএমবি ও হুজির সাবেক সদস্য হাসিবর রহমান, ফাহিম মোল্লা, আবদুল করিম, সৌরভ, সালেহ, আসলাম, জাহাঙ্গীর, আল আমিন, সামির ওরফে ইমরান, আবদুস সামাদ, শরিফ ওরফে সালেহ, জাহাঙ্গীর ওরফে রাজীব অর্থ পাঠাচ্ছেন। ব্রিটিশ নাগরিক গোলাম মোস্তফা ও তাঁর বাবা সাজেদুর রহমান এবং ব্রিটেনের দুই প্রভাবশালী ব্যক্তিও অর্থ সহায়তা দিচ্ছেন বলে তথ্য রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে।
ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন গত চারদলীয় জোট সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপি। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আমলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হলেও রহস্যজনক কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। তাঁদের মধ্যে ব্যারিস্টার আমিনুল হক, নাদিম মোস্তফাসহ অন্তত পাঁচজনের বিরুদ্ধে বিএনপি সরকারের সময়ই জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগ ছিল। যদিও তাঁরা ওই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। এর পরও আমরা তাঁদের কর্মকাণ্ড নজরদারি করছি।’
জঙ্গি অর্থায়নে ১৪ এনজিও : বিভিন্ন দেশের ১৪টি এনজিওর বিরুদ্ধে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদে অর্থ সরবরাহের অভিযোগ রয়েছে। এসব এনজিওর বেশির ভাগই মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক। এ তালিকায় রয়েছে রিভাইবাল অব ইসলামিক হেরিটেজ সোসাইটি (আরআইএইসএস), রাবেতা আল-আলম আল-ইসলামী, সোসাইটি অব সোশ্যাল রিফর্ম, কাতার চ্যারিটেবল সোসাইটি, আল মুনতাদা আল ইসলামী, ইসলামিক রিলিফ এজেন্সি, আল ফুরকান ফাউন্ডেশন, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক রিলিফ অর্গানাইজেশন (আইআইআরও), কুয়েত জয়েন্ট রিলিফ কমিটি, মুসলিম এইড, দার আল-খায়ের, তাওহিদী নূর, সৌদিভিত্তিক হায়াতুল ইগাছা এবং দ্য গ্রিন ক্রিসেন্ট।
জেএমবির আর্থিক মদদদাতা হিসেবে অভিযুক্ত রাবেতা আল-আলম আল-ইসলামী সৌদি আরব সরকারের একটি সাহায্য সংস্থা, যা বিশ্বব্যাপী মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগ (এমডাব্লিউএম) নামে পরিচিত। এটির আরেকটি সহযোগী এনজিও রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক রিলিফ অর্গানাইজেশন (আইআইআরও) নামে। এ প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদে অর্থায়নের অভিযোগ রয়েছে। এমডাব্লিউএমের পাকিস্তান শাখার প্রধান ছিলেন ওসামা বিন লাদেনের আপন বোনের জামাই মোহাম্মদ জামাল খলিফা। ২০০৭ সালে মাদাগাস্কারের সরকারি বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন তিনি। এমডাব্লিউএমের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল রিলিফ অর্গানাইজেশনের প্রতিনিধি হয়ে বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন বর্তমান আল-কায়েদার প্রধান আইমান আল জাওয়াহিরি।
২০০৯ সালে ভোলায় অভিযান চালিয়ে জঙ্গিদের একটি মাদ্রাসা কাম প্রশিক্ষণকেন্দ্রে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ ও সেনাবাহিনীর পোশাকের সন্ধান পায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যুক্তরাজ্যভিত্তিক এনজিও দ্য গ্রিন ক্রিসেন্টের অর্থায়নে চলত ওই মাদ্রাসা ও জঙ্গি প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। ওই এনজিওটির মালিক ফয়সাল মোস্তফা, যিনি ১৯৯৬ সালে যুক্তরাজ্যে জঙ্গিদের রাসায়নিক, অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহের দায়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ২০০০ সালে তিনি আবারও গ্রেপ্তার হন বার্মিংহামে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক মজুদের অভিযোগে।
সরকারের এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর পরিচালক কে এম আবদুস সালাম কালের কণ্ঠকে বলেন, এনজিওগুলো যাতে জঙ্গিবাদে অর্থায়ন করতে না পারে, সে জন্য আইনকানুনেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। আগে কোনো এনজিও নিবন্ধনের ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগত। এখন এর সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ছাড়পত্র নেওয়ার শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া এনজিওগুলোর বিদেশ থেকে আসা অর্থ ছাড় করার আগেই তা যতটা সম্ভব যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে উল্লেখ করে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘ব্র্যাকের মতো বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের বিদেশি অর্থায়ন যাচাই করা হয় না। তবে জঙ্গিবাদে অর্থায়নের অভিযোগ রয়েছে এমন ইসলামী এনজিওগুলোর কাছে অর্থ পাঠানো হলে দাতার পরিচয়, উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানার জন্য আমরা অনেক সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহায়তা নিই। আবার এনজিও বিষয়ক ব্যুরো সরাসরি অর্থদাতার সঙ্গে ই-মেইলে যোগাযোগ করে অর্থ পাঠানোর কারণ জানতে চায়। সেখান থেকে উত্তর পাওয়ার পর তা পর্যালোচনা করে অর্থ ছাড়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।’
কালের কণ্ঠ