মিয়ানমারের পশ্চিমে নগা ইয়েন্ট চ্যাঞ্জ নামের একটি গ্রামে আমার বাড়ি। সেখানে আমার সুখী আর শান্তিপূর্ণ শৈশব কেটেছে। আমার বাবার একটা দোকান ছিল। আমার বাবা-মা ও ছয় ভাইবোনের সঙ্গে আমরা একটি বড় বাসায় থাকতাম। আমাদের বাড়ির চারপাশে আম, নারকেল আর কলাগাছ ছিল। মাঝে মাঝে হাতির দল আমাদের গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ ধরে আসত এবং বনে ফিরে যেত।
আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমাদের জীবনে কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছিল না। বড় কোনো সমস্যা ছিল না। আমরা মুসলিম রোহিঙ্গা এবং অন্যরা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের রাখাইন হলেও এসব নিয়ে তেমন কোনো অশান্তি ছিল না।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমাদের পাশের রাখাইন গ্রামে আমার অনেক বন্ধু ছিল। আমরা প্রায়ই দুই গ্রামের বিভিন্ন মাঠে একত্রে খেলতে যেতাম। আমরা একসাথে ‘চিনলো’ (স্থানীয় জনপ্রিয় খেলা) খেলতাম। সেসব দিনগুলোতে আমরা অনেক মজা করতাম।
এখন সেই আলস্যে ঘেরা আনন্দময় ও আশায় ভরা জীবন আর নেই। সেটা এক দূরতম স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে।
গত ছয় বছর ধরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে ‘শুদ্ধি অভিযান’ শুরু করার পর থেকে আমি বাংলাদেশের কক্সবাজারে সীমান্তবর্তী একটি শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছি। বিশ্বে এমন স্থাপনার ভেতর সবচেয়ে বড় এটি। আমাদের প্রায় দশ লাখ মানুষ এখন এ জায়গায় ঠেসে রয়েছে। তারা বাঁশ ও তেরপল দিয়ে তৈরি ছোট্ট আশ্রয়ে বাস করছে। এখানে আমাদের জীবন দৈনন্দিন সংগ্রামে পরিণত হয়েছে। প্রায়ই আমাদের পর্যাপ্ত খাবার বা বিশুদ্ধ পানি থাকে না। এখানে আগুন লেগেছে, খুন হয়েছে। আমরা এখানে নিরাপদ বোধ করি না।
আমি এখানে কীভাবে এলাম?
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে নারকীয় অত্যাচার চালানোতে সাহায্য করায় আমি ফেসবুক, এর মূল প্রতিষ্ঠান মেটা এবং মার্ক জুকারবার্গসহ জড়িত সবাইকে দোষারোপ করছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটি তাদের বিভিন্ন পেজে মানুষকে রোহিঙ্গাবিরোধী মনোভাব জাগিয়ে তুলতে দিয়েছে। এর অ্যালগরিদমগুলো ভুল তথ্য প্রচার করেছে। অবশেষে যা সত্যিকারের সহিংসতায় রূপান্তরিত হয়েছে।
অবশ্যই, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা ও রাখাইন সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনার ইতিহাস দীর্ঘ। কিন্তু, আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায়, স্মার্টফোন এবং ফেসবুক আমাদের জীবনে প্রবেশ না করা পর্যন্ত এবং রাজনীতিবিদ, ধর্মান্ধ এবং সুবিধাবাদীদের বাস্তব সময়ে আমার জনগণের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচার করার অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত আমাদের জনগণের মধ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য প্রতিনিয়ত শত্রুতা ছিল না।
অবশ্যই রোহিঙ্গা এবং রাখাইন সম্প্রদায়ের মধ্যে দ্বন্দ্বের ইতিহাস পুরোনো। কিন্তু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, আমাদের জনগণের জীবনে স্মার্টফোন, ফেসবুক আসার আগ পর্যন্ত প্রতিনিয়ত এমন শত্রুতার চরম বহিঃপ্রকাশ ছিল না। কিছু রাজনীতিবিদ, ধর্মান্ধ ও সুবিধাবাদীরা এগুলো ব্যবহার করে আমাদের জনগণের বিরুদ্ধে সহিংসতার সৃষ্টি করেছে।
২০১২ সালে যখন আমার বয়স ১১ ছিল তখন প্রথমবার বুঝতে পেরেছিলাম যে, ফেসবুক ঘৃণার হাতিয়ার হতে পারে। একদল রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে বৌদ্ধ এক নারীকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগ ওঠে। আমার জানামতে, এ ঘৃণ্য অপরাধের কখনোই বিচার হয়নি। কিন্তু প্রমাণের অভাব থাকলেও জনতা আমাদের পুরো সম্প্রদায়কে দায়ী করা থেকে বিরত থাকেনি। আমাদের লোকেদের বিরুদ্ধে ফেসবুকে বিদ্বেষমূলক পোস্ট নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়। তখন থেকেই রাখাইন প্রতিবেশীদের সঙ্গে আমাদের উষ্ণ সম্পর্ক শীতলতার দিকে মোড় নেয়।
কয়েক বছর পর, ২০১৬ সালের শেষ দিকে ফেসবুকের মাধ্যমে রোহিঙ্গাবিরোধী মনোভাব, নিপীড়নকে উৎসাহিত করা ও বৈধতা দেওয়ার কারণে তা আমার পরিবারের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে শুরু করে।
আমার বাবা এবং অন্যান্য অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে আক্রমণের মিথ্যা অভিযোগ তোলা হয় এবং বড় রকমের জরিমানাও করা হয়। আমার চাচা আবু সুফিয়ান এবং ছেলে বুষাকে জরিমানা না দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিচার ছাড়াই জেলে পাঠানো হয়।
পরবর্তীতে রোহিঙ্গাদের নিয়ে ঘৃণামূলক ও ইসলামবিদ্বেষী বার্তা ফেসবুকে নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। এমন অনেক মেসেজ দেখেছি যেখানে ‘দেশকে রক্ষা করো এবং লাথি মেরে অবৈধ বাঙালিদের তাড়িয়ে দাও’ বলা হয়েছিল। এ সময় আরেকটি বিশেষ বার্তা চাউর হয়, সেটি হলো- ‘এই অবৈধদের জন্মহার অনেক বেশি। আমরা যদি এটা চলতে দেই তাহলে আমাদের দেশের প্রেসিডেন্টের মুখে দাড়ি থাকবে।’
আমি এসব মেসেজ সম্পর্কে ফেসবুককে অবগত করেছিলাম, তবে তারা কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। তারা উলটো দাবি করেছিল নৈর্ব্যক্তিকভাবে ঘৃণা ছড়ানো এসব পোস্ট ফেসবুকের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড লঙ্ঘন করে না।
এর কিছুকাল পরেই হত্যাযজ্ঞ শুরু হলো।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের শুরুতে এ হত্যাকাণ্ড শুরু হয়।
আমি তখন ১৫ বছর বয়সী একজন ভালো ছাত্র। আমার আশা ছিল যে আমি একজন উকিল হবো।
সেদিন সকালে আমি সকাল থেকে উঠে আমার ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ গুলির শব্দ শুনলাম। গ্রামের থানা থেকে গুলির শব্দ আসছিল। কী করতে হবে বুঝতে না পেরে আমরা বাসায় থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রায় তিন ঘণ্টা এ শব্দ চলল। ততক্ষণে সেনাবাহিনীও চলে এসেছে।
যখন আমরা বের হলাম তখন বুঝতে পারলাম, স্থানীয় বাজারে একটি দোকানের মালিক মোহাম্মদ সোমিনকে হত্যা করা হয়েছে। আমি তাকে মরতে দেখিনি তবে তার শরীর মাটিতে পড়ে থাকতে দেখেছি।
তারা যখন গ্রামগুলোতে অভিযান চালাচ্ছিল তখন নিরাপত্তাবাহিনীর সেনারা অনেক বিস্ফোরক স্থাপন করে। হুসেইন আহমেদ নামের একজন গ্রামবাসী ভুলে ট্রিগার চেপে ফেলেন এবং আমার চোখের সামনে মৃত্যুবরণ করেন। অনেকেই জঙ্গলের দিকে পালানোর চেষ্টা করছিল। কেউ কেউ তার পরদিনই বাংলাদেশে রওনা হয়। তবে আমরা আমাদের বাসাতেই ছিলাম।
দ্রুতই সেনাবাহিনী বাকি গ্রামবাসীদের রেড ক্রিসেন্ট অফিসের সামনের মাঠে আসতে বলল। আমরা যাইনি। আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে, আমরা গেলে তারা আমাদের মেরে ফেলত। আমরা জানতে পেরেছিলাম যে, সেনারা অন্যান্য গ্রামে গিয়ে রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা করেছে।
আমরা গ্রাম ছেড়ে অন্যান্য গ্রামে আত্মীয়স্বজনদের বাসায় কয়েক রাতের জন্য থাকলাম। আমরা গ্রামে ফিরে দেখলাম পুরোটা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। চারদিকে শুধুই ধ্বংসের চিহ্ন। এটা সহজেই অনুমেয় ছিল যে, এখানে অনেককে হত্যাও করা হয়েছে।
আমরা বুঝতে পারলাম আমাদের আর মিয়ানমারে পালাবার কোনো জায়গা নাই। আমরা হেঁটে বাংলাদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। যাওয়ার পথে গ্রামগুলোতে পরিত্যক্ত বাসাবাড়ি ও ধানক্ষেতে অগণিত মরদেহ পড়ে থাকতে দেখলাম। বেশিরভাগ বাসাবাড়ি পুড়িয়ে সম্পূর্ণ নষ্ট করে ফেলা হয়েছিল। প্রচণ্ড শীত আর বৃষ্টির ভেতরেই আমরা জঙ্গল এবং পাহাড়ের দুর্গম পথ পাড়ি দিলাম। আমরা দিনের পর দিন না খেয়ে থেকেছি। ১৫ দিন পর অবশেষে আমরা বাংলাদেশে পৌঁছালাম।
গ্রামে সেদিন গুলির শব্দ শোনার পর ঠিক ৬ বছর পার হলো আজ। আমি এখনো কক্সবাজারের জনাকীর্ণ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাস করছি। আমি এখনো আমার নিজের বাসার স্বপ্ন দেখি এবং ভিন্নতর একটা জীবনের স্বপ্ন দেখি যেখানে আমি আমার গ্রামে ফিরে যেতে পারব এবং শিক্ষাও অর্জন করতে পারব। আমার উকিল হবার স্বপ্নটা আমি মাটিচাপা দিতে চাই না। কিন্তু কমবয়সী একজন রোহিঙ্গার জন্য এমন সুযোগ খুবই কম- আমাদের শিক্ষার অধিকারও নেই।
ফেসবুক আমাদের এই পরিণতি ঘটাতে সাহায্য করেছে। শুধু রোহিঙ্গারাই নয় বরং অনেক এনজিওর পক্ষ থেকেও বারংবার মানা করা সত্ত্বেও ফেসবুক ঘৃণা ও সহিংসতা ছড়ানো রোধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। এখন তাদের উচিত কৃতকর্মের দায়ভার গ্রহণ করা এবং আমাদের জীবনকে পুনরায় ঠিক পথে নিয়ে আসা।
জাকারবার্গ ও তার সঙ্গে যারা ফেসবুক ক্রিয়াশীল রাখতে সাহায্য করেন তাদের উচিত কক্সবাজারে এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করা। ক্যাম্পের পরিস্থিতি বোঝার জন্য এবং আমরা কীরকমভাবে বেঁচে আছি জানার জন্য তাদের এখানে আসা উচিত। হয়তো তারা এটা বুঝতে পারবেন যে, আমাদের মানুষদের সঙ্গে তারা কী করেছেন। হয়তো তারা এরপরে আমাদের সাহায্য করার জন্য কিছু করবেন।
যারা এ গণহত্যায় প্রাণ হারিয়েছে ফেসবুক তাদের প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারবে না বা যারা বেঁচে গেছে এবং মিয়ানমারে তাদের সব ফেলে এসেছে- তাদের ক্ষতি সম্পূর্ণভাবে পুষিয়ে দিতে পারবে না। তবে জনাব জোকারবার্গ এখনো আমাদের সাহায্য করতে পারেন। তিনি কক্সবাজারে আমার মতো কম বয়সীদের শিক্ষিত করে রোহিঙ্গাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তোলায় ভূমিকা রাখতে পারেন। আমাদের যে ক্ষতি তার কোম্পানি করেছে, সেটির সাপেক্ষে এটুকু তিনি করতেই পারেন।
মূল লেখা: মাউং সায়েদুল্লাহ্, বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থী।
ভাষান্তর: সরকার জারিফ। সৌজন্যে::কালবেলা