[caption id="attachment_6428" align="alignleft" width="800"] সৌজন্যে উখিয়া নিউজ ডটকম[/caption]
ওবাইদুল হক চৌধুরী,সম্পাদক,উখিয়া নিউজ ডটকম::
‘তবু তোমার বুকেই গুলির পর গুলি চালালো ওরা/তুমি কি তাই টলতে টলতে টলতে টলতে বাংলার ভবিষ্যৎকে/বুকে জড়িয়ে সিঁড়ির ওপর পড়ে গিয়েছিলে?’ ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞের মর্মস্পর্শী দৃশ্যপট এভাবেই চিত্রায়িত হয়েছে মহাদেব সাহার কবিতায়। সেই রক্তাক্ত ১৫ আগস্ট আজ, পিতার বিয়োগান্তে বাঙালির শোকের দিন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আঁধার রাতের রূপকল্প কেবল কবিতায় নয়, গানেও প্রকাশ পেয়েছে ‘সেদিন আকাশে শ্রাবণের মেঘ ছিল, ছিল না চাঁদ।’ সত্যিই সেই রাতে ঢাকার আকাশে কালো মেঘ ছিল, ছিল না বৃষ্টি, ছিল না আঁধার বিদীর্ণ করা নীল জ্যোৎস্না। শ্রাবণের আঁধারে ডুব দিয়েছিল বৃষ্টিহীন রুক্ষরাত। আর এই অমানিশার অন্ধকারে রচিত হয়েছিল ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়। রাজধানীর আকাশে-বাতাসে তখনো ছড়ায়নি মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ থেকে আজানের সুরেলা ধ্বনি। ভোরের আলো ফোটার আগেই ঘোর কৃষ্ণপ্রহরে হায়েনার দল বেরিয়ে আসে। নিদ্রাচ্ছন্ন নগরীর নীরবতাকে ট্যাঙ্ক-মেশিনগানের গর্জনে ছিন্নভিন্ন করে ওরা সংহার করে তাকে। তিনিই আমাদের ‘বাংলাদেশ’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিশ্বের মাণচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি দেশকে যিনি একটি স্বাধীন দেশ হিসাবে স্বীকৃতি করেছিলেন তিনি হলেন বাঙ্গালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙ্গারী বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু মানেই ৫৬ হাজার বর্গ মাইলের বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু মানেই মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু মানেই বিশ্ব দরবারে বাঙ্গালীর মাথা উচুঁ করে দাড়ানো। বাঙ্গালীর রক্ত আর বঙ্গবন্ধু ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলার প্রাণ ও স্পন্দন,বাঙ্গালীর চেতনা আর বাঙ্গালীর শৃঙ্খল মুক্তির পথ প্রদর্শক হলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯২০ সালের ১৭ ই মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে শেখ লুৎফুর রহমান ও সায়রা বেগমের ঘরে বাঙ্গালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্ম গ্রহন করেন। শিশুকাল থেকেইে তিনি ছিলেন অদম্য সাহসের অধিকারী। আর এই অসীম সাহসের কারনেই ১৯৩৯ সালে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন সময়ে সরকারী নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ সভা করার দুঃসাহসের কারনে বঙ্গবন্ধুর জীবনে প্রথম কারাবরন করেন। ১৯৩৮ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি বেগম ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। শারিরিক অসুস্থতার কারনে ১৯৪২ সালেএন্ট্রাস(প্রবেশিকা) পাস করে কলিকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৪ সালেবঙ্গবন্ধু কুষ্টিয়ায় অনুষ্টিত নিখিলবঙ্গ মুসলীম ছাত্রলীগের সম্মেলনে যোগদান করে আণুষ্টানিকভাবে রাজনীতিতে অভিসিক্ত হন। এ বছরই তিনি ফরিদপুর ডিস্ট্রিক এসোসিয়েশনের সাধারন সম্পাদক নিযুক্ত হন। পরে ১৯৪৬ সালে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্ধীতায় কলকাতা ইসলামীয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ সালের ২৩ শে ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষনা করলে বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষনিকভাবে তার ঘোষনার প্রতিবাদ করেন। এরই প্রেক্ষিতে ১৯৪৮ সালের ২রা মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ঐ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে সাধারন ধর্মঘট আহবানকালে বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হন। ১৯৪৯ সালের ২৩ শে জুন পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী মুসলীমলীগ গঠিত হয় এবং জেলে থাকাবস্থায় বঙ্গবন্ধু ঐ সংগঠনের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৯ সালের ২৭ শে জুলাই তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে না গিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। ১৯৫০ সালের ১লা জানুয়ারী তিনি দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় খাদ্যের দাবীতে আন্দোলন করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন। ১৯৫২ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে বঙ্গবন্ধু কারাগারেই অনশন শুরু করেন। ১৯৫২ সালের ২১শে ফ্রেব্রুয়ারী রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদ মিছিলে গুলি চলে, এতে শহীদ হন সালাম,বরকত,রফিক,জব্বারসহ অনেকেই। জেলে থেকে বঙ্গবন্ধু এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে একটানা ৩ দিন বিৃবতি দেন। ১৯৫৩ সালের ১৬ ই নভেম্বর প্রাদেশিক আওয়ামী মুসলীমলীগের কাউন্সিল অধিবেশনে তিনি সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালের ১০ ই মার্চ সাধারন নির্বাচনে ২৩৭ টি আসনের মধ্যে যুক্তফন্ট ২২৩টি আসনে বিজয়ী হয়। এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসাবে গোপালগঞ্জ আসনে বিজয়ী হন। ১৪ মে বঙ্গবন্ধু যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভায় সর্বকনিষ্ট মন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহন করেন। ১৯৫৫ সালের ৫ জুন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৭ জুন ঢাকার পল্টনের জনসভায় বঙ্গবন্ধু প্রথম পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসন দাবী করেন। ১৯৫৫ সালে ২১ অক্টোবর আওয়ামী মুসলীমলীগের বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশনে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে আদর্শ হিসাবে গ্রহন করে দলে নাম থেকে মুসলীম শব্দ প্রত্যাহার করে নতুন নামকরন করা হয় আওয়ামীলীগ। বঙ্গবন্ধুকে পুনরায় দলের সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৬৪ সালের ৫ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এছাড়া ১১ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িকদাঙ্গা বিরোধী দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়। ১৯৬৬ সালের ১৮ই মার্চ আওয়ামীলীগের কাউন্সিল অধিবেশনে ৬ দফা গৃহীত হয়। ৬ দফার পক্ষে সারাদেশে ব্যাপক প্রচারনা শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। এ সময় তাকে ঢাকা,ময়মনসিং,সিলেট থেকে ৩ মাসে ৮ বার গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৬৮ সালের ৩রা জানুয়ারী পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে এক নম্বর আসামী করে মোট ৩৫ জন বাঙ্গালী সেনা ও সিএসপি অফিসারের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে বিছিন্ন করার অভিযোগে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। ১৯৬৯ সালে ২৩ ফ্রেব্রুয়ারী সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানকে এক বিশাল সংবর্ধনা দেওয়ার আয়োজন করে। ঐ সভায় শেখ মুজিবরি রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এ সময় বঙ্গবন্ধু ছাত্রজনতার ১১ দফা সমর্থন করেন। ১৯৬৯ সালের ১০ মার্চ রাজনৈতিক সংকট নিরসনে আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেন। এ বৈঠকে বঙ্গবন্ধু ৬ দফার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেন। ১৯৭০ সালের ১লা জানুয়ারী ১৯৫৮ সালের পর প্রথম রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। বঙ্গবন্ধু প্রথমদিন থেকেই ৬ দফার পক্ষে দেশব্যাপী ব্যাপক প্রচারনা শুরু করেন। ১৯৭০ সালের ৫ জুন পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচনী এলাকা বিষয়ে সরকারের চুড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদে ৩১০টি আসন আর জাতীয় পরিষদে ১৬৯টি (সংরক্ষিত মহিলা আসনসহ) আসন নির্দিষ্ট করা হয়। ১৯৭০ সালের ৮ অক্টোবর ইসলামাবাদ থেকে ১৯টি রাজনৈতিক দলের প্রতিক ঘোষনা করে নির্বাচন কমিশন। আওয়ামীলীগ তখন নৌকা প্রতিক বরাদ্দ পায়। ¯œরনীয় যে, ১৯৫৪ সালের পূর্ব পাকিস্তানের সাধারন নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রতিক ছিল নৌকা। ১৯৭০ সালের ২৮ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু বেতার ও টেলিভিশনে নির্বাচনী ভাষন দেন। তিনি বলেন,প্রতিকুল অবস্থার মধ্য দিয়ে আওয়ামীলীগের জন্ম হয়েছে। আর সংকটময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আওয়ামীলীগের বিকাশ । এ সময় তিনি দেশবাসীর কাছে ৬ দফার পক্ষে ম্যান্ডেট চান। ১৯৭০ সালে ১২ নভেম্বর পূর্ব বাংলায় ভয়াবহ ঝড় এবং জলোচ্ছাসে ১০/১২ লাখ মানুষ মারা যান। বঙ্গবন্ধু তার নির্বাচনী প্রচারনা স্থগিত করে ত্রান কাজে ঝাপিয়ে পড়েন। এ সময় “সোনার বাংলা শ্মশান কেনো” শিরোনামে তথ্য সংবলিত একটি পোস্টার জাতিকে নাড়া দেয়। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর দেশের বন্যা দূর্গত এলাকা বাদে জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্টিত হয়। নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে আওয়ামীলীগ সরাসরি ভোটে ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি এবং সংরক্ষিত মহিলা মিলে ১৬৭টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্টতা অর্জন করে। ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ পূর্ব পাকিস্তানের ৩১০টি আসনের মধ্যে ৩০২টি আসন লাভ করে। ১৯৭১ সালের ৩রা জানুয়ারী আওয়ামীলীগের সকল নির্বাচিত সদস্য ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রনয়ণ তথা ৬ দফা বাস্তবায়নের শপথ গ্রহন করেন। “আমার সোনার বাংলা,আমি তোমায় ভালবাসি” এই রবীন্দ্র সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে অনুষ্টানের উদ্বোধন হয়। বঙ্গবন্ধু জয়বাংলা শ্লোগান দিয়ে বাঙ্গালী জাতির মুক্তির সংকল্প ব্যক্ত করেন। শপথ অনুষ্টানের উদ্বোধনী সঙ্গীতের পর “জয় বাংলা, বাংলার জয়” গানটিও পরিবেশিত হয়। ১৯৭১ সালের ১০ জানুয়ারী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ৩ দফা বৈঠক করেন। ৪ দিন পরে তিনি ফিরে যাবার সময় বলেন শেখ মুজিব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চলছেন। ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশনকে সামনে রেখে আওয়ামীলীগের সংসদীয় দলের বৈঠক শুরু হয় হোটেল পূর্বনীতে। ঐদিন আকস্মিকভাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অদিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষনা করেন। সারা বাংলা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিক্ষুব্দ জনসমুদ্রে পরিনত হয় রাজপথ। বঙ্গবন্ধু এটাকে শাসকদের আরেকটি চক্রান্ত বলে চিহ্নিত করেন। তিনি ২রা মার্চ ও ৩রা মার্চ সারা পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল আহবান করেন। ৩রা মার্চ বিক্ষুব্দ জনতা জান্তা সরকার ইয়াহিয়া খানের কারফিউ উপেক্ষা করে রাজপথে নেমে আসে। এ সময় শামরিক জান্তার গুলিতে মারা যান ৩ জন আহত হন অন্তত ৬০ জন। এই সময় পুরো দেশ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পরিচালিত হতে থাকে। ১৯৭১ সালের ৭ ই মার্চ বঙ্গবন্ধু তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে এক যুগান্তকারী ভাষনে ঘোষনা করেন,“এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম,এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম”। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষনেই স্পষ্ট হয়ে যায় স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষৎ। সারাদেশ শুরু হয় অভুতপূর্ব অসহযোগ আন্দোলন। ১৯৭১ সালের ১৬ই মার্চ বিষ্ফোরনমূক বাংলাদেশে আসেন ইয়াহিয়া খান। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিলে বঙ্গবন্ধু তার গাড়িতে কালো পতাকা লাগিয়ে হেয়ার রোড়ে প্রেসিডেন্ট ভবনে আলোচনার জন্য যান। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ প্রতিরোধ দিবস পালনের ঘোষনা দেন। সকল সরকারী এবং বে-সরকারী ভবনে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু এ দিন সরকারী ছুটি ঘোষনা করেন। ২৫ মার্চ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে মানুষের ঢল নামে। সন্ধ্যায় খবর পাওয়া যায় ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করেছেন। এ সময় বঙ্গবন্ধু আওয়ামীলীগের গুরুত্বপূর্ন নেতাদের সাথে বৈঠক করেন। রাত সাড়ে এগারটায় শুরু হয় নিরীহ বাঙ্গালীর উপর বর্বরুচিত হামলা অপারেশন সার্চ লাইট। ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা। ২৫ শে মার্চ রাত পৃথিবীর ইতিহাসে নৃশংসতম কালো রাত। ২৫ মার্চ শেষ রাত অথ্যাৎ ২৬ শে মার্চের প্রথম প্রহর রাত ১২.৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক গ্রেপ্তার হবার পূর্বে বাংলাদেশের স¦াধীনতার ঘোষনা বার্তা ওয়ারলেস যোগে চট্টাগ্রামের জহুরুল আহমদ চৌধুরীকে প্রেরন করেন। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে আওয়ামীলীগ নেতা আব্দুল হান্নান বঙ্গবন্ধু এই স্বাধীনতা ঘোষনার বাণী স্বকন্ঠে প্রচার করেন। পরে ২৭ শে মার্চ চট্টগ্রামে অস্টম ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান ঐ ঘোষনা পুনরায় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে পাঠ করেন। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে করাচিতে নিয়ে যাওয়া হয়। ২৭শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষন এবং স্বাধীনতার ঘোষনার আলোকে বীর বাঙ্গালী গড়ে তোলে স্বতঃস্ফুর্ত প্রতিরোধ। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের গৌরবউজ্বল অধ্যায়। ১৯৭১ সালে ১৭ই এপ্রিল তৎকালীন মেহেরপুর মহকুমার ভবেরপাড়ার বৈদ্যনাথতলা আম্রকাননে এক অনাড়ম্বর অনুষ্টানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংরাদেশ সরকারের নতুন মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমদ ঘোষনা করেন আজ থেকে বৈদ্যনাথতলা এলাকার নাম মুজিবনগর এবং অস্থায়ী রাজধানী মুজিবনগর থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা করা হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি এবং তাঁর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাস্ট্রপতি ঘোষনা করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মে মুক্তিযোদ্ধারা ক্রমেই সংগঠিত হতে শুরু করেন । এইদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু করা হয়। এই কেন্দ্রে সিগনেচার টিউন ছিল “জয় বাংলা,বাংলার জয়”। কেন্দ্রে বঙ্গবন্ধুর ভাষন প্রচারিত হতে থাকে।এই কেন্দ্র থেকে প্রচারিত“ শোন একটি মুজিবুরের কন্ঠে” গানটি বাঙ্গালীর উদ্দীপনাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। ১৯৭১ সালের ৩রা আগষ্ট পাকিস্তান টেলিভিশন থেকে বলা হয় ১১ আগষ্ট থেকে সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু হবে। এই ঘোষনায় বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ উদ্বেগের ঝড় বয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুকে ইয়াহিয়া খানের সামনে হাজির করা হয়। ইয়াহিয়ার সঙ্গে ছিলেন ভুট্রো এবং জেনারেল আকবর। ইয়াহিয়া খান করমর্দনের জন্য হাত বাড়ালে বঙ্গবন্ধু বলেন দুঃখিত ওহাতে বাঙ্গালীর রক্ত লেগে আছে ওহাত আমি স্পর্শ করবো না। এ সময় অনিবার্য বিজয়ের দিকে এগুতে থাকে আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। ১৯৭১ সালের ২রা ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের মুক্তির সংগ্রাম যখন বিজয়ের দারপ্রান্তে তখন লায়লাপুর কারাগারে ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে সমঝোতার প্রস্তার দেব। কিন্তু ঐ সমঝোতা প্রস্তাব বঙ্গবন্ধু ঘৃনাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ত্রিশ লাখ শহীদ এবং ২ লাখ মা-বোনদের ইজ্বতের বিনিময়ে আসে আমাদের বিজয়। আত্মসমর্পন করে পাকিস্তানী বাহিনী। বাঙ্গালী জাতি মুক্ত হয় পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে। কিন্তু মুক্তির অপূর্নতা রয়ে যায়। স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু তখনও নির্জন কারাগারে । ১৯৭২ সালের ৩রা জানুয়ারী পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসাবে জুলফিকার আলী ভুট্রো করাচিতে ঘোষনা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বিনাশর্তে মুক্তি দেওয়া হবে। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে মুক্তি পান। পিআইয়ের একটি বিশেষ বিমানে লন্ডন পাঠানো হয়। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী সকালে তৎকালীন ব্রিট্রিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের আগ্রহে ব্রিটেনের রাজকীয় বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ ফ্লাইটে বঙ্গবন্ধুকে ভারতের নয়াদিল্লীতে পৌছালে রাষ্টপতি ভি,ভি গিরি এবং প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের রাস্ট্রপতিকে স্বাগত জানান। বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধু বলেন “অশুভের বিরুদ্ধে শুভের বিজয় হয়েছে”। ঐদিন বিকালে ভারতীয় বিমানের একটি বিশেষে ফ্লাইটে বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরন করেন। লাখো মানুষের জনসমুদ্র বাধভাঙ্গা আবেগে অশ্রুসিক্ত জাতির পিতা বলেন আজ আমার জীবনের স্বাদ পূর্ন হয়েছে। ঐদিন জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু হৃদয়কাড়া ভাষন দেন। ঐদিন রাতেই তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহন করেন। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারী দেশে রাষ্ট্রপতি শাসনের পরিবর্তে সংসদীয় শাসন কাঠামো প্রবর্তন করে নতুন মন্ত্রী পরিষদ গঠন করে বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহন করেন। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ শোষনহীন সমাজ গঠনের অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে প্রথম স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত হয়। ১৯৭২ সালে ২০ এপ্রিল শুরু হয় গণপরিষদের উদ্বোধনী অনুষ্টান। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষনা সম্পর্কিত প্রস্তাব উত্থাপন করলে তা সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয়। ১৯৭২ সালে ১৬ই ডিসেম্বর নতুন সংবিধান কার্যকর করে বাতিল করা হয় গণপরিষদ। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ নতুন সংবিধানের আওতায় বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্টিত হয়। নির্বাচনে জাতীর জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯২টি আসনে বিজয়ী হয়। ১৯৭৪ সালের ২৩ শে সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম বাঙ্গালী নেতা হিসাবে জাতিসংগের সাধারন পরিষদে বাংলাভাষায় বক্তৃতা দেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী দেশে বিরাজমান পরিস্থিতি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু জাতীয় সংসদে চতুর্থ সংশোধনী বিল পাশ করেন। এই বিলের মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে বাংলাদেশের নবযাত্রা শুরু হয়। ১৯৭৫ সালের ২৫ ফ্রেব্রুয়ারী রাষ্ট্রপতির এক ডিক্রির মাধ্যমে সমগ্র রাজনৈতিক দলের সম্মিলনে বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামীলীগ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ১৯৭৫ সালে ১৫ই আগষ্ট দেশের স্বাধীনতা বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের ষড়যন্ত্রে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধানমন্ডি ৩২ নম্বর নিজ বাড়ীতে আত্মঘাতী হামলায় সপরিবারে শহীদ হন। ভাগ্যক্রমে দেশের বাহিরে থাকায় আজকের সফল প্রধানমন্ত্রী ধরিত্রী কণ্যা শেখ হাসিনা এবং তাঁর ছোটবোন শেখ রেহানা বেচেঁ যান। ১৯২০ থেকে ১৯৭৫ মাত্র ৫৫ বছর বঙ্গবন্ধুর জীবন অধ্যায় যা পৃথিবীর ইতিহাসে এক আলোকময় অধ্যায়। ‘৭৫ এর ১৫ই আগষ্ট যারা তাঁকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে এ অধ্যায়ের অবসান ঘটিয়েছিল। তারা সেদিন জানতো না বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের প্রতিটি ক্ষন একটি এক একটি আলোক কণিকা। যার জীবনকাল আজ লাভ করেছে অমরত্ম। মাত্র ৫৫ বছরের জীবনকালে তিনি যেভাবে এদেশে আলো ছড়িয়েছেন। আজও সেই আলোয় বাংলার ১৬ কোটি মানুষ উদ্ভাসিত। তাইতো আজ বাংলার মানুষ সমসুরে গেয়ে উঠেন “বদলে গেছে ঢাকার শহর বদলে গেছে দেশ, এইতো হলো বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ”।