মুহম্মদ নূরুল ইসলাম …
বিছমিল্লাহ্হির রাহমানির রাহিম।
সকল প্রশংসা সেই সত্তার যার হাতের মুঠোতে আমার জীবন-মৃত্যু। সকল প্রশংসা তাঁরই যিনি আমাকে অসংখ্য নিয়ামত দান করেছেন, শুকরিয়া প্রকাশ করছি রাব্বুল আলামীনের যিনি আমার কলমকে সচল রেখেছেন। সে রবের কাছে লাখো-কোটি শুকরিয়া যিনি আমাকে সূরা আল ইখলাস বা সূরা আল এখলাস নিয়ে কিছু লেখার জন্য সাহায্য করেছেন।
অসংখ্য দরুদ ও সালাম বিশ^মানবতার মুক্তির দূত, মহান শিক্ষক সাইয়্যিদুল মুরসালিন হযরত মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি, যিনি ইসলামকে বিজয়ী আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন। যিনি পৃথিবীর ইতিহাসে এক ঘোরতর জাহেলিয়াতের যুগে আবির্ভুত হয়ে ইসলামের দাওয়াতের মাধ্যমে জাহেলিয়াতের পংকিলতায় নিমজ্জিত জাতিকে তাওহিদি চেতনায় উদ্ভাসিত ও আলোকিত করেছেন।
ভূমিকা
সূরা আল এখলাস বা আল ইখলাস কুরআন করিমের একটি সূরা। এটি কুরআন করিমের ১১২ নম্বর সূরা। এই সূরার আয়াতের সংখ্যা-চার এবং এক রুকু বিশিষ্ট। কুরআন করিমে চার আয়াত ও এক রুকু বিশিষ্ট আরো একটি সূরা আছে। তা হচ্ছে সূরা কুরায়শ। কুরআন করিমে এক রুকু বিশিষ্ট একাধিক সূরা রয়েছে। কুরআন করিমে তিন আয়াত বিশিষ্ট কয়েকটি সূরা রয়েছে। কুরআন করিমের চার আয়াত বিশিষ্ট এই সূরার পৃথক বৈশিষ্ট্য যেমন রয়েছে, তেমিন ভাবে রয়েছে এর গুরুত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব, মর্যাদা। পৃথক বৈশিষ্ট্য, গুরুত্ব, শ্রেষ্ঠত্বের মধ্যে এই সূরায় নির্ভেজাল ভাবে তাওহীদের আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ্ সোবহানু তা’আলাকে সুনির্দিষ্ট করে চেনার জন্য সূরা এল ইখলাস বা এখলাসই যথেষ্ট। এই সূরার শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার কথা বলতে গেলে বলতে হয়- এর মধ্যে রয়েছে অপরিসীম নিয়ামত। রাব্বুল আলামীন এই সূরার মধ্যে কি পরিমাণ নিয়ামত দান করেছেন তা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন সময় সাহাবীদেরকে বলেছেন এই সূরার ভালোবাসাই জান্নাতে পৌঁছে দিতে যথেষ্ট। এই সূরাকে ভালোবাসা তথা সৃষ্টিকর্তা রাব্বুল আলামীনকে ভালোবাসাই জান্নাতের ঠিকানা নিশ্চিত করে।
নামকরণ
ইখলাস বা এখলাস শুধু এই সূরাটির নামই নয়, এখানে আলোচ্য বিষয়বস্তুর শিরোনামও। কারণ, এখানে খালেস তথা নির্ভেজাল তাওহীদের আলোচনা করা হয়েছে। কুরআন করিমের অন্যান্য সূরার ক্ষেত্রে সাধারণত সেখানে ব্যবহৃত কোন শব্দের মাধ্যমে সূরার নামকরণ করতে দেখা গেছে। কিন্তু এ সূরাটিতে ইখলাস শব্দ কোথাও ব্যবহৃত হয়নি। কাজেই এর এ নামকরণ করা হয়েছে এর অর্থের ভিত্তিতে। যে ব্যক্তি এ সূরাটির বক্তব্য অনুধাবন করে এর শিক্ষার প্রতি ঈমান আনবে, সে শিরক থেকে মুক্তি লাভ করে খালেস তাওহীদের আলোকে নিজেকে উদ্ভাসিত করবে।
আরবি ‘এখলাস’ বা ‘ইখলাস’ শব্দের অর্থ একনিষ্ট বা নিষ্টাবান। যেমনÑ‘হিতে আল্লাহ্র ‘এখলাস’ বান্দা,’ অর্থÑ ‘সে আল্লাহ্ তা’আলার একনিষ্ট (নিষ্টাবান) বান্দা।’ ‘এখলাস’ বা ‘ইখলাস’-এর মূল ‘খুলুস’। এই ‘খুলুস’ শব্দ থেকেই ‘এখলাস’ বা ‘ইখলাস’ শব্দটি এসেছে। আরবি ‘খুলুস’ শব্দের অর্থ একনিষ্ট। এই ‘খুলুস’ শব্দটা ‘খালেস’ হয়েছে। ‘খালেস’ অর্থ ‘একনিষ্টতা’।
সূরা আল ইখলাস কোথায়, কখন নাযিল হয়
সূরা আল ইখলাস কোথায়, কখন নাযিল হয়েছে? এনিয়ে রয়েছে মতভেদ। কারো মতে এটি মক্কী, আবার কারো মতে মাদানী। এ সূরাটি নাযিল হবার কারণ হিসেবে যেসব হাদীস উল্লেখিত হয়েছে সেগুলোর ভিত্তিতেই এ মতভেদ দেখা দিয়েছে। তবে সূরাটি মক্কাতেই নাযিল হয়েছে। এব্যাপারে নিচে পর্যায়ক্রমে সেগুলো আলোচনা করা হলো :
১. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বর্ণনা করেন, কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলে, ‘আপনার রবের বংশ পরিচয় আমাদের জানান।’ একথায় এ সূরাটি নাযিল হয়। (তাবারানী)।
২. আবুল আলীয়াহ হযরত উবাই ইবনে কাব রা.-এর বরাত দিয়ে বর্ণনা করেন, ‘মুশরিকরা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলে, আপনার রবের বংশ পরিচয় আমাদের জানান। এর জবাব আল্লাহ এ সূরাটি নাযিল করেন। (মুসনাদে আহমাদ, ইবনে আবী হাতেম, ইবনে জারীর, তিরমিযী, বুখারী ফিত তারীখ, ইবনুল মুনযির, হাকেম ও বায়হাকী) এ বিষয়বস্তু সম্বলিত একটি হাদীস আবুল আলীয়ার মাধ্যম ইমাম তিরমিযী উদ্ধৃত করেছেন। সেখানে হযরত উবাই ইবনে কা’বের বরাত নেই। ইমাম তিরমিযী একে অপেক্ষাকৃত বেশি নির্ভুল বলেছেন।
৩. হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ্ রা. বর্ণনা করেন, এক গ্রামীণ আরব (কোন কোন হাদীস অনুযায়ী লোকেরা) নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলে, আপনার রবের বংশধারা আমাদের জানান)। এর জবাবে আল্লাহ্ তা’আলা এ সূরাটি নাযিল করেন) (আবু ইয়ালা, ইবনে জারীর, ইবনুল মুনযিল, তাবারানী ফিল আওসাত, বায়হাকী ও আবু নু’আইম ফিল হিলইয়া)।
৪. ইকরামা হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে রেওয়ায়াত করেন, ইহুদীদের একটি দল রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে হাযির হয়। তাদের মধ্যে ছিল কা’ব ইবনে আশরাফ ও হুই ইবনে আখতাব প্রমুখ লোকেরা। তারা বলে “হে মুহাম্মাদ! (রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনার যে রব আপনাকে পাঠিয়েছেন তিনি কেমন সে সম্পর্কে আমাদের জানান।” এর জবাবে মহান আল্লাহ্ এ সূরাটি নাযিল করেন। (ইবনে আবী হাতেম, ইবনে আদী, বায়হাকী ফিল আসমায়ে ওয়াস সিফাত)
এ ছাড়াও ইমাম ইবনে তাইমিয়া কয়েকটি হাদীস তাঁর সূরা ইখলাসের তাফসীরে বর্ণনা করেছেন। সেগুলো হচ্ছে :
৫. হযরত আনাস রা. বর্ণনা করেন, খয়বারের কয়েকজন ইহুদী রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাামের কাছে এসে বলে “হে আবুল কাসেম! আল্লাহ্ ফেরেশতাদেরকে নূরের পরদা থেকে, আদমকে পচাগলা মাটির পিÐ থেকে, ইবলিসকে আগুনের শিখা থেকে, আসমানকে ধোঁয়া থেকে এবং পৃথিবীকে পানির ফেনা থেকে তৈরি করেছেন। এখন আপনার রব সম্বন্ধে আমাদের জানান (অর্থাৎ তিনি কোন বস্তু থেকে সৃষ্ট)?” রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একথার কোন জবাব দেন নি। তারপর জিব্রীল আ. আসেন। তিনি বলেন, হে মুহাম্মদ। ওদেরকে বলে দাও, ‘হুওয়াল্লাহু আহাদ” (তিনি আল্লাহ্ এক ও একক) …
৬. আমের ইবনুত তোফায়েত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলে : “হে মুহাম্মদ! আপনি আমাদের কোন জিনিসের দিকে আহŸান জানাচ্ছেন? তিনি জবাব দেন, “আল্লাহ্র দিকে।” আমের বলে : “ভালো, তাহলে তার অবস্থা আমাকে জানান। তিনি সোনার তৈরি, না রূপার অথবা লোহার?” একথার জবাবে এ সূরাটি নাযিল হয়।
৭. যাহহাক, কাতাদাহ ও মুকাতেল বলেন, ইহুদীদের কিছু আলেম রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে আসে। তারা বলে : “হে মুহাম্মাদ! আপনার রবের অবস্থা আমাদের জানান। হয়তো আমরা আপনার ওপর ঈমান আনতে পারবো। আল্লাহ্ তাঁর গুণাবলী তাওরাতে নাযিল করেছেন। আপনি বলুন, তিনি কোন বস্তু দিয়ে তৈরি? কোন গোত্রভুক্ত? সোনা, তামা, পিতল, লোহা, রূপা, কিসের তৈরি? তিনি পানাহার করেন কি না? তিনি উত্তরাধিকারী সূত্রে কার কাছ থেকে পৃথিবীর মালিকানা লাভ করেছেন? এবং তারপর কে এর উত্তরাধিকারী হবে? এর জবাবে আল্লাহ্ এ সূরাটি নাযিল করেন।
৮. ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেন, নাজরানের খৃস্টানদের সাতজন পাদরী সমন্বয়ে গঠিত একটি প্রতিনিধি দল রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সাক্ষাৎ করে। তারা তাঁকে বলে : “আমাদের রব কেমন? তিনি কিসের তৈরি?” তিনি বলেন, “আমার রব কোন জিনিসের তৈরি নন। তিনি সব বস্তু থেকে আলাদা।” এ ব্যাপারে আল্লাহ্ এ সূরাটি নাযিল করেন।
এ সমস্ত হাদীস থেকে জানা যায়, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে মাবুদের ইবাদাত ও বন্দেগী করার প্রতি লোকদের আহŸান জানাচ্ছিলেন তার মৌলিক সত্ত¡া ও অবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লোক প্রশ্ন করেছিল। এ ধরনের প্রশ্ন যখনই এসেছে তখনই তিনি জবাবে আল্লাহ্র হুকুমে লোকদেরকে এ সূরাটিই পড়ে শুনিয়েছেন। সর্বপ্রথম মক্কায় কুরাইশ বংশীয় মুশরিকরা তাঁকে এ প্রশ্ন করে। তাদের এ প্রশ্নের জবাবে এ সূরাটি নাযিল হয়। এরপর মদীনা তাইয়েবায় কখনো ইহুদী, কখনো খৃস্টান আবার কখনো আরবের অন্যান্য লোকেরাও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এই ধরনের প্রশ্ন করতে থাকে। প্রত্যেক বারই আল্লাহ্র পক্ষ থেকে ইশারা হয় জবাবে এ সূরাটি তাদের শুনিয়ে দেবার। ওপরে উল্লেখিত হাদীসগুলোর প্রত্যেকটিতে একথা বলা হয় যে, এর জবাবে এ সূরাটি নাযিল হয়। এর থেকে এ হাদীসগুলো পরস্পর বিরোধী একথা মনে করার কোন সংগত কারণ নেই। আসলে হচ্ছে কোন বিষয় সম্পর্কে যদি পূর্ব থেকে অবতীর্ণ কোন আয়াত বা সূরা থাকতো তাহলে পরে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে যখনই সেই একই বিষয় আবার উত্থাপিত হতো তখনই আল্লাহ্র পক্ষ থেকে হিদায়াত আসতো, এর জবাব উমুক আয়াত বা সূরায় রয়েছে অথবা এর জবাব উমুক আয়াত বা সূরায় রয়েছে অথবা এর জবাবে লোকদেরকে উমুক আয়াত বা সূরা পড়ে শুনিয়ে দাও। হাদীসসমূহের রাবীগণ এ জিনিসটিকে এভাবে বর্ণনা করেছেন, যখন উমুক সমস্যা দেখা দেয় বা উমুক প্রশ্ন উত্থাপিত হয় তখন এ আয়াত বা সূরাটি নাযিল হয়। একে বারংবার অবতীর্ণ হওয়া অর্থাৎ একটি আয়াত বা সূরার বারবার নাযিল হওয়াও বলা হয়।
কাজেই সঠিক কথা হচ্ছে, এ সূরাটি আসলে মক্কী। বরং এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে চিন্তা করলে একে মক্কায় একেবারে প্রথম যুগে অবতীর্ণ সূরাগুলোর অন্তর্ভুক্ত করা যায়। আল্লাহ্র সত্তা ও গুণাবলী সম্পর্কে কুরআনের কোন বিস্তারিত আয়াত তখনো পর্যন্ত নাযিল হয় নি। তখনো লোকেরা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আল্লাহ্র দিকে দাওয়াতের বার্তা শুনে জানতে চাইতো : তাঁর এ রব কেমন, যাঁর ইবাদাত-বন্দেগী করার দিকে তাদেরকে আহŸান জানানো হচ্ছে। এর একেবারে প্রাথমিক যুগে অবতীর্ণ সূরাগুলোর অন্তর্ভুক্ত হবার আর একটি প্রমাণ হচ্ছে, মক্কায় হযরত বেলাল রা.-কে তার প্রভু উমাইয়া ইবনে খালাফ যখন মরুভূমির উত্তপ্ত বালুকার ওপর চিৎ করে শুইয়ে তার বুকের ওপর একটা বড় পাথর চাপিয়ে দিতো তখন তিনি “আহাদ” বলে চিৎকার করতেন। এ আহাদ শব্দটি এ সূরা ইখলাস থেকেই গৃহীত হয়েছিল।
বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য
সূরা এখলাস বা ইখলাস নাযিল হওয়ার উপলক্ষ সম্পর্কিত যেসব হাদীস ওপরে বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর ওপর নজর বুলালে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তাওহীদের দাওয়াত নিয়ে এসেছিলেন তখন দুনিয়ার মানুষের ধর্মীয় চিন্তা-ভাবনা ও ধ্যান-ধারণা কি ছিল তা জানা যায়। মূর্তি পূজারী মুশরিকরা কাঠ, পাথর, সোনা, রূপা ইত্যাদি বিভিন্ন জিনিসের তৈরি খোদার কাল্পনিক মূর্তিসমূহের পূজা করতো। সেই মূর্তিগুলোর আকার, আকৃতি ও দেহাবয়ব ছিল। এ দেবদেবীদের রীতিমত বংশধারাও ছিল। কোন দেবী এমন ছিল না যার স্বামী ছিল না আবার কোন দেবতা এমন ছিল না যার স্ত্রী ছিল না। তাদের খাবার দাবারেরও প্রয়োজন দেখা দিতো। তাদের পূজারীরা তাদের জন্য এসবের ব্যবস্থা করতো। মুশরিকদের একটি বিরাট দল খোদা মানুষের রূপ ধারণ করে আত্মপ্রকাশ করায় বিশ্বাস করতো এবং তারা মনে করতো কিছু মানুষ খোদার অবতার হয়ে থাকে। খৃস্টানরা এক খোদায় বিশ্বাসী হবার দাবীদার হলেও তাদের খোদার কমপক্ষে একটি পুত্র তো ছিলই এবং পিতা পুত্রের সাথে খোদায়ী সা¤্রাজ্য পরিচালনার ব্যাপারে রুহুল কুদুসও (জিব্রীল) অংশীদার ছিলেন। এমন কি খোদার মা-ও ছিল এবং শাশুড়িও। ইহুদিরাও এক খোদাকে মেনে চলার দাবীদার ছিল কিন্তু তাদের খোদাও বস্তুসত্তা ও মরদেহ এবং অন্যান্য মানবিক গুণাবলির ঊর্ধে ছিল না। তাদের এ খোদা টহল দিতো, মানুষের আকার ধারণ করে আত্মপ্রকাশ করতো। নিজের কোন বান্দার সাথে কুশ্তিও লড়তো। তার একটি পুত্রও (উযাইর) ছিল। এ ধর্মীয় দলগুলো ছাড়া আরো ছিল মাজূসী-অগ্নি উপাসক ও সাবী-তারকা পূজারীর দল। এ অবস্থায় যখন লোকদেরকে এক ও লা-শরীক আল্লাহ্র আনুগত্য করার দাওয়াত দেয়া হয় তখন তাদের মনে এ প্রশ্ন জাগা নিতান্ত স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল যে, সেই রবটি কেমন, সমস্ত রব ও মাবুদদেরকে বাদ দিয়ে যাকে একমাত্র রব ও মাবুদ হিসেবে মেনে নেবার দাওয়াত দেয়া হচ্ছে? এটা কুরআনের অলৌকিক প্রকাশভংগীরই কৃতিত্ব। এ সমস্ত প্রশ্নের জবাব মাত্র কয়েকটি শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করে কুরআন মূলত আল্লাহ্র অস্তিত্বের এমন সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ধারনা পেশ করে দিয়েছে, যা সব ধরনের মুশরিকী চিন্তা ও ধ্যান-ধারণার মূলোৎপাটন করে এবং আল্লাহ্র সত্তার সাথে সৃষ্টির গুণাবলীর মধ্য থেকে কোন একটি গুণকেও সংযুক্ত করার কোন অবকাশই রাখেনি।
সূরা ইখলাসের শ্রেষ্ঠত্ব ও গুরুত্ব
এ কারণে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দৃষ্টিতে এ সূরাটি ছিল বিপুল মহত্বের অধিকারী। বিভিন্নভাবে তিনি মুসলমানদেরকে এ গুরুত্ব অনুভব করাতেন। তারা যাতে এ সূরাটি বেশি করে পড়ে এবং জনগণের মধ্যে একে বেশি করে ছড়িয়ে দেয় এ জন্য ছিল তাঁর এ প্রচেষ্টা। কারণ এখানে ইসলামের প্রাথমিক ও মৌলিক আকিদাকে (তাওহীদ) এমন ছোট ছোট চারটি বাক্যের মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়েছে, যা শুনার সাথে সাথেই মানুষের মনে গেঁথে যায় এবং তারা সহজেই মুখে মুখে সেগুলো আওড়াতে পারে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদ্ধতিতে লোকদের বলেছেন, এ সূরাটি কুরআনের এক-তৃতীয়াংশের সমান-এ মর্মে হাদীসের কিতাবগুলোতে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে। বুখারী, তিরমিযী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ, তাবারানী ইত্যাদি কিতাবগুলোতে বহু হাদীস আবু সাঈদ খুদরী, আবু হুরাইরা, আবু আইয়ুব আনসারী, আবুদদারদা, মু’আয ইবনে জাবাল, জাবের ইবনে আবদুল্লাহ্, উবাই ইবনে কা’ব, কুলসুম বিনতে উকবাহ ইবনে আবী মু’আইত, ইবনে উমর, ইবনে মাস’উদ, কাতাদাহ ইবনুন নূ’মান, আনাস ইবনে মালেক ও আবু মাস’উদ রাদিয়াল্লাহু আনহুম থেকে বর্ণিত হয়েছে। মুফাস্সিরগণ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ উক্তির বহু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। তবে আমাদের মতে সহজ, সরল ও পরিষ্কার কথা হচ্ছে, কুরআন করিম যে দীন ও জীবন ব্যবস্থা পেশ করে তার ভিত্তি রাখা হয়েছে তিনটি বুনিয়াদী আকিদার ওপর। এক. তাওহীদ, দুই. রিসালাত ও তিন. আখেরাত। এ সূরাটি যেহেতু নির্ভেজাল তাওহীদ তত্ব বর্ণনা করেছে তাই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একে কুরআনের এক-তৃতীয়াংশের সমান গণ্য করেছেন।
ইমাম বুখারী র….. আবু সাঈদ রা. হতে বর্ণনা করেন যে, আবু সাঈদ রা. বলেন, এক ব্যক্তি অপর এক ব্যক্তিকে বারবার সূরা ইখলাস পাঠ করতে শুনে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে তা বিবৃত করেন। শুনে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যাঁর হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ করে বলছি : “ইহা কুরআনের এক-তৃতীয়াংশের সমান।”
ইমাম বুখারী র. …. আবু সাঈদ রা. হতে বর্ণনা করেন যে, আবূ সাঈদ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন সাহাবাগণকে বলেন, ‘তোমাদেরকে কেহ কি এক রাতে কুরআনের এক-তৃতীয়াংশ পাঠ করতে পারো না?’ তারা বলে, হে আল্লাহ্র রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! ইহা কি কারো পক্ষে সম্ভব? রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “শোনো, সূরা এখলাস কুরআনের এক-তৃতীয়াংশের সমান।”
ইমাম আহমদ র. …. আবু সাঈদ খুরদী রা. হতে বর্ণনা করেন যে, আবূ সাঈদ খুদরী রা. বলেন, কাতাদা ইব্ন নু’মান রা. একবার গোটা রাত সূরা এখলাস পড়ে কাটিয়ে দেন। এ সংবাদ শুনে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যাঁর হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ করে বলছি, এই সূরাটি কুরআনের অর্ধেক কিংবা (বলেন) এক-তৃতীয়াংশের সমান।”
ইমাম আগহমদ র. …. আবদুল্লাহ ইব্ন আমর রা. হতে বর্ণনা করেন যে, আবদুল্লাহ ইব্ন আমার রা. বলেন, হযরত আবূ আইয়ুব আনসারী রা. এক মজলিসে বর্ণনা করছিলে, ‘তোমাদের কেহ কি সারারাত জেগে কুরআনের এক-তৃতীয়াংশ পাঠ করতে পারবে?’ উত্তরে জনতা বলে, ‘এটা কি কারো পক্ষে সম্ভব?’ অতঃপর তিনি বলেন, হ্যাঁ, সম্ভব। সূরা এখলাসই গোটা কুরআনের তিন ভাগের একভাগ। ইত্যবসরে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসে কথাটি শুনে বলেন, “আবূ আইয়ুব ঠিকই বলেছেন।”
ইমাম তিরমিযী র. …. আবূ হুরায়রা রা. হতে বর্ণনা করেন যে, আবূ হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন বলেন : তোমরা একত্রিত হয়ে বস, আমি আজ তোমাদেরকে এক-তৃতীয়াংশ কুরআন তিলাওয়াত করে শুনাবো। এই ঘোষণা শুনে আমরা অনেকেই একত্রিত হয়ে বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ পরে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসে সূরা এখলাস পাঠ করে চলে গেলেন। এবার আমরা কানাঘুষা করতে লাগলাম যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো আমাদেরকে কুরআনের এক-তৃতীয়াংশ শুনাবার ওয়াদা করেছিলেন। কিন্তু এভাবে চলে গেলেন কেনো? হয়তো আসমান হতে কোনো ওহী এসে থাকবে। অতঃপর তিনি পুনরায় এসে বললেন : আমি ওয়াদা করেছিলাম তোমাদেরকে কুরআনের এক-তৃতীয়াংশ পড়ে শুনাবো। শোন, “এই সূরা এখলাস কুরআনের এক-তৃতীয়াংশের সমান।”
ইমাম আহমদ র. … আবূ আইয়ুব আনসারী রা. হতে বর্ণনা করেন যে, আবূ আইয়ুব আনসারী রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : তোমরা কেহ কি এক রাত্রে কুরআনের তিনভাগের একভাগ পাঠ করতে পারো? শোন, “কেহ কোনো রাতে সূরা এখলাস পাঠ করলে বলা যাবে যে, সে রাত্রে সে কুরআনের এক তৃতীয়াংশ পাঠ করেছেন।”
ইমাম আহমদ র. … উবাই ইব্ন কা’ব রা. কিংবা জনৈক আনসারী হতে বর্ণনা করেন যে, উবাই ইব্ন কা’ব রা. বা আনসারী ব্যক্তি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : “যে ব্যক্তি সূরা এখলাস পড়লো, সে যেনো কুরআনের এক-তৃতীয়াংশ পাঠ করলো।”
ইমাম আহমদ র. … আবূ মাসউদ রা. হতে বর্ণনা করেন যে, আবূ মাসউদ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : “সূরা এখলাস কুরআনের এক-তৃতীয়াংশ।”
ইমাম আহমদ র. … আবুদ্দারদা রা. হতে বর্ণনা করেন যে, আবুদ্দারদা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : “আচ্ছা, তোমরা কি প্রতিদিন কুরআনের তিনভাগের একভাগ পাঠ করতে অক্ষম?” উত্তরে সাহাবাগণ বলেন :হ্যাঁ হুযুর! আমাদের ক্ষমতা এর চেয়ে অনেক কম। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : “শোনো, আল্লাহ্ তা’আলা পবিত্র কুরআন করিমকে তিনভাগে বিভক্ত করেছেন। সূরা এখলাস হলো কুরআন করিমের এক-তৃতীয়াংশ।”
ইমাম আহমদ র. … উম্মে কুলছুম বিনতে উকবা রা. হতে বর্ণনা করেন যে, উম্মে কুলছুম রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামবলেছেন : “সূরা এখলাস কুরআন করিমের এক-তৃতীয়াংশের সমান।”
জান্নাতের ঠিকানা সূরা আল ইখলাস?
ইমাম বুখারী র…. আয়েশা রা. হতে বর্ণনা করেন যে, আয়েশা রা. বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ক্ষুদ্র একটি সৈন্যদলকে কোথাও এক অভিযানে প্রেরণ করেন। ফিরে আসার পর তাঁরা সেনাপতির বিরুদ্ধে নালিশ দায়ের করল যে, সে প্রতি নামাজের কিরাআতের শেষে সূরা ইখলাস পাঠ করত। শুনে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাকে জিজ্ঞেস করো সে এমন কেন করতো। এব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, “কারণ এই সূরায় আল্লাহ্র গুণ ও পরিচয় বর্ণনা করা হয়েছে বিধায় এটা পড়তে আমার কাছে খুব ভালো লাগে।” শুনে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন : “তাকে বলো যে, আল্লাহ্ তা’আলাও তাকে ভালোবাসেন।”
ইমাম বুখারী র. সালাত অধ্যায়ে হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, এক আনসারী সাহাবী কুবা মসজিদের ইমামতি করতেন। তাঁর নিয়ম ছিল, তিনি প্রত্যেক রাকাআতে সূরা ফাতিহা পাঠ করতেন এবং পরে সূরা ইখলাস পাঠ করে অন্য সূরা মিলিয়ে নিয়ে পড়তেন। এভাবে কিছুদিন অতিবাহিত হলে লোকেরা এ ব্যাপারে আপত্তি উঠায়। তারা বলেন, তুমি এ কেমন কাজ করছো, প্রথমে সূরা ইখলাস পড়ো তারপর তাকে যথেষ্ট মনে না করে আবার তার সাথে আর একটি সূরা পড়ো। এটা ঠিক নয়। শুধুমাত্র “কুল হুওয়াল্লাহ বা সূরা এখলাস” পড়ো অথবা একে বাদ দিয়ে অন্য একটি সূরা পড়ো। তিনি জবাব দেন, আমি এটা ছাড়তে পারবো না। তোমরা চাইলে আমি তোমাদের নামায পড়াবো না অথবা ইমামতি ছেড়ে দেবো। কিন্তু লোকেরা তাঁর জায়গায় আর কাউকে ইমাম বানানোও পছন্দ করতো না। অবশেষে ব্যাপারটি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সামনে আসে। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেন, “তোমার সাথীরা যা চায় তা করতে তোমার বাধা কোথায়? কোন্ জিনিসটি তোমাকে প্রত্যেক রাকআতে এ সূরাটি পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছে?” তিনি বলেন : “এ সূরাটিকে আমি খুব ভালোবাসি।” রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জবাবে বলেন : “এ সূরার প্রতি তোমার ভালোবাসা তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে।”
অন্য এক বর্ণনায় আছে যে, হযরত আনাস রা. বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকটে এসে বলেন, “হুজুর, আমি সূরা এখলাসকে খুব ভালোবাসি।” শুনে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : এর ভালোবাসা তোমকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে।
ইমাম মালিক র. … আবূ হুরায়রা রা. হতে বর্ণনা করেন যে, আবূ হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন এক ব্যক্তিকে সূরা এখলাস পাঠ করতে শুনে বল্লেন : “ওয়াজিব হয়ে গেছে।” আমি জিজ্ঞেস করলাম কী ওয়াজিব হয়ে গেছে? তিনি বলেন, “জান্নাত।”
অন্য এক হাদিসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি রাত্রে বিছানায় ডান কাত হয়ে শুয়ে একশতবার সূরা এখলাস পাঠ করবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তা’আলা তাকে বলবেন, হে আমার বান্দা! তুমি তোমার ডান দিক দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করো।”
আবূ ইয়ালা মুসিলী র. …. জাবির ইবন আবদুল্লাহ রা. হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তিনটি কাজ এমন আছে যা কেহ ঈমানের সাথে করলে সে জান্নাতের যে কোনো দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে এবং তার সাথে ডাগর চোখা সুনয়না অপরূপ সুন্দরী হুরদের বিয়ে দেওয়া হবে। ১. হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দেওয়া, ২. গোপনে ঋণ আদায় করা ও ৩. প্রত্যেক ফরয নামাজের পর দশবার সূরা এখলাস পাঠ করা।” শুনে আবূ বকর রা. বললেন : “ ইয়া রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেহ এর একটি করলে?” রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “হ্যাঁ, একটি করলেও সে এই ফযীলত লাভ করবে।”
জান্নাতে প্রাসাদের অধিকারী কারা?
ইমমাম আগমদ র. …. মুআয ইব্ন আনাস জুহানী রা. হতে বর্ণনা করেন যে, মুআয ইব্ন আনাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : “যে ব্যক্তি সূরা এখলাস দশবার পাঠ করবে আল্লাহ্ তা’আলা জান্নাতে তার জন্য একটি প্রাসাদ নির্মাণ করবেন।” একথা শুনে হযরত উমর রা. বললেন : তা হলে তো আমরা অধিক পরিমাণে এটি পাঠ করে অনেক প্রাসাদের মালিক হয়ে যাবো। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন : “আল্লাহ্ আরো বেশি ও ভালো দানকারী।”
দারিমী র. …. সাঈদ ইব্ন মুসায়য়াব রা. হতে বর্ণনা করেন যে, সাঈদ ইবন মুসায়য়াব রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : “কেহ সূরা এখলাস দশবার পাঠ করলে আল্লাহ্ তা’আলা জান্নাতে তার জন্য একটি প্রাসাদ আর বিশবার পড়লে দুইটি প্রাসাদ এবং ত্রিশবার পড়লে তিনটি প্রাসাদ নির্মাণ করে দেবেন।” শুনে হযরত উমর রা. বললেন, ‘হুযুর! তা হলে তো আমরা প্রাসাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে নেবো।’ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন : “আল্লাহ তা’আলা আরো প্রাচুর্যময়।”
অন্যান্য ফজিলত
আবূ ইয়ালা মুসিলী র. … আনাস ইব্ন মালিক রা. হতে বর্ণনা করেন যে, আনাস ইব্ন মালিক রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “কেহ পঞ্চাশবার সূরা এখলাস পাঠ করলে আল্লাহ্ তা’আলা তার পঞ্চাশ বছরের গুনাহ মাফ করে দেন।”
আবূ ইয়ালা মুসিলী র. … আনাস ইব্ন মালিক রা. হতে বর্ণনা করেন যে, আনাস ইব্ন মালিক রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “কেহ একদিনে দুইশতবার সূরা এখলাস পাঠ করলে আল্লাহ্ তা’আলা তার নামে এক হাজার পাঁচশত সওয়াব লিখে দেবেন, যদি তার কোনো ঋণ না থাকে।”
আবূ বকর বাযযার র. … আনাস ইব্ন মালিক রা. হতে বর্ণনা করেন যে, আনাস ইব্ন মালিক রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি দুইশতবার সূরা এখলাস পাঠ করবে আল্লাহ্ তা’আলা তার দুইশত বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন।”
আবুল কাসিম তাবারানী র. … জাবির ইবন আবদুল্লাহ রা. হতে বর্ণনা করেন যে, জাবির ইবন আবদুল্লাহ রা বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : “কেহ ঘরে প্রবেশ করার সময় সূরা এখলাস পাঠ করলে আল্লাহ্ তা’আলা তার ঘর এবং গোটা প্রতিবেশি হতে দারিদ্র দূর করে দেবেন।”
আবূ ইয়ালা মুসিলী র. … আনাস ইবন মালিক রা. হতে বর্ণনা করেন যে, আনাস ইবন মালিক রা. বলেন, আমরা একদিন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সঙ্গে তাবূকে অবস্থান করছিলাম। সেদিন ভোরবেলা সূর্য এত উজ্জ্বল ও কিরণময় হয়ে উদিত হয় যেমনটি ইতিপূর্বে আমরা কখনো দেখি নি। কিছুক্ষণ পর হযরত জিবরীল আ. সেখানে আসেন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ভাই বিরীল! ব্যাপার কি? আজকের সকালের সূর্য এত কিরণময় ও উজ্জ্বল হওয়ার কারণ কি? এমনটি তো ইতোপূর্বে কখনো দিখি নি। জিবরীল আ. বললেন : “আজ মদিনায় মুআবিয়া ইবন মুআবিয়া লায়ছির ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর জানাযায় অংশ গ্রহণ করার জন্য আল্লাহ্ তা’আলা সত্তর হাজার ফেরেশতা প্রেরণ করেছেন।”
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, “কোন আমলের বদৌলতে সে এতে ফযীলত লাভ করলো?”
জিবরীল আ. বললেন, “সে দিন-রাত হাঁটা-চলা উঠা-বসা ইত্যাদি সর্বাবস্থায় সূরা এখলাস পাঠ করতো। আপনি তাঁর জানাযায় শরীক হতে চাইলে যমীনের দূরত্ব সংকোচন করে আমি আপনাকে সিখানে নিয়ে যেতে পারি।” এতে সম্মত হওয়ায় রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জানাযায় শরীক হন।
সূরা আল ইখলাস
বলো, তিনি আল্লাহ্, একক। আল্লাহ্ কারোর ওপর নির্ভরশীল নন এবং সবাই তাঁর ওপর র্নিভরশীল। তাঁর কোন সন্তান নেই এবং তিনি কারোর সন্তান নন। এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নেই।
সূরার বিষয়বস্তুর ব্যাখ্যা
ইহুদি, খৃষ্টান, মুশরিকসহ অন্যরা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছ থেকে ‘সাবুদ’ বা ‘সৃষ্টিকর্তা’ বা ‘রব’ সম্বন্ধে বিভিন্নন সময় যে প্রশ্ন করেছিলো তার জবাবে সূরা আল ইখলাস নাজিল করা হয়। আর সে কারনেই সূরা আল ইখলাসে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। সূরার শুরুতেই বলা হয়েছে, ‘কুল হু ওয়াল্লাহু আহাদ।’
এখানে ‘বলো’ শব্দের মাধ্যমে প্রথমত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করা হয়েছে। কারণ তাঁকেই প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনার রব কে? তিনি কেমন? আবার তাঁকেই হুকুম দেয়া হয়েছিল, প্রশ্নের জবাবে আপনি একথা বলুন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর তিরোধনের পর এ সম্বোধনটি প্রত্যেক মু’মিনের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যে কথা বলার হুকুম দেয়া হয়েছিল এখন সে কথা তাকেই বলতে হবে।
অর্থাৎ আমার যে রবের সাথে তোমরা পরিচিত হতে চাও তিনি আর কেউ নন, তিনি হচ্ছেন আল্লাহ্। এটি প্রশ্নকারীদের প্রশ্নের প্রথম জবাব। এর অর্থ হচ্ছে, তোমাদের সামনে আমি কোন নতুন রব নিয়ে আসি নি। অন্যসব মাবুদদের ইবাদাত ত্যাগ করে কোন নতুন মাবুদের ইবাদাত করতে আমি তোমাদের বলি নি। বরং আল্লাহ্ নামে যে সত্তার সাথে তোমরা পরিচিত তিনি সেই সত্তা। আরবদের জন্য ‘আল্লাহ্’ শব্দটি কোন নতুন ও অপরিচিত ছিল না। প্রাচীনতম কাল থেকে বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টার প্রতিশব্দ হিসেবে আরববাসী আল্লাহ্ শব্দটি ব্যবহার করে আসছিল। নিজেদের অন্য কোন মাবুদ ও উপাস্য দেবতার সাথে এ শব্দটি ব্যবহার করে আসছিল। নিজেদের অন্য কোন মাবুদ ও উপাস্য দেবতার সাথে এ শব্দটি সংশ্লিষ্ট করতো না। অন্য মাবুদদের জন্য তারা “ইলাহ” শব্দ ব্যবহার করতো। তারপর আল্লাহ্ সম্পর্কে তাদের যে আকীদা ছিল তার চমৎকার প্রকাশ ঘটেছিল ‘আবরাহার’ মক্কা আক্রমণের সময়। যা সূরা ফীলে বর্ণিত হয়েছে। সে সময় কা’বা ঘরে ৩৬০টি উপাস্যের মূর্তি ছিল। কিন্তু এ বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য মুশরিকরা তাদের সবাইকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র আল্লাহ্র কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছিল। অর্থাৎ তারা নিজেরা ভালোভাবে জানতো, এ সংকটকালে আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন সত্তাই তাদেরকে সাহায্য করতে পারবে না। কা’বাঘরকেও তারা এসব ইলাহের সাথে সম্পর্কিত করে বায়তুল আ-লিহাহ (ইলাহ-এর বহুবচন) বলতো না বরং আল্লাহ্র সাথে সম্পর্কিত করে একে বলতো ‘বায়তুল্লাহ্’। আল্লাহ্ সম্পর্কে আরবের মুশরিকদের আকীদা কি ছিল কুরআনের বিভিন্ন স্থানে তা বলা হয়েছে। যেমন : সূরা যুখরুফে বলা হয়েছে : “যদি তুমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, কে তাদেরকে পয়দা করেছে, তাহলে তারা নিশ্চয়ই বলবে আল্লাহ্।” (৮৭ আয়াত)
সূরা আনকাবুতে বলা হয়েছে : “যদি তুমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, পৃথিবী ও আকাশসমূহ কে সৃষ্টি করেছেন এবং চন্দ্র ও সূর্যকে কে নিয়ন্ত্রিত করে রেখেছেন, তাহলে নিশ্চয়ই তারা বলবে আল্লাহ্। এরপর এরা প্রতারিত হচ্ছে কোন্ দিক থেকে? আল্লাহ্ই তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা পর্যাপ্ত রিযিক দেন এবং যাকে ইচ্ছা কমিয়ে দেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সব জিনিস জানেন। আর যদি তুমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, কে আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন এবং তার সাহায্যে মৃত পতিত জমিকে সজীবতা দান করেছেন, তাহলে তারা নিশ্চয়ই বলবে, আল্লাহ্। বলো, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্র জন্য কিন্তু অধিকাংশ লোক বুঝে না” (৬১-৬৩ আয়াত)।
সূরা মু’মিনূনের ৮৪-৮৯ নম্বর আয়াতসমূহে বলা হয়েছে : তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, যদি তোমরা জানো তাহলে বলো এ পৃথিবী এবং এর মধ্যে যারা বাস করে তারা কারা? তারা নিশ্চয়ই বলবে, আল্লাহ্র। বলো, তাহলে তোমরা সচেতন না কেনো? তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, সাত আকাশ ও মহান আরশের মালিক কে? তারা অবশ্যি বলবে, আল্লাহ্। বলো, তাহলে তোমরা ভয় করো না কেনো? তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, বলো, যদি তোমরা জেনে থাকো, কার কর্তৃত্ব চলছে প্রতিটি জিনিসের ওপর? আর কে তিনি যিনি আশ্রয় দান করেন এবং তাঁর মোকাবিলায় কেউ আশ্রয় দিতে পারে না? তারা নিশ্চয়ই বলবে, এ ব্যাপারটি তো একমাত্র আল্লাহ্রই জন্য নির্ধারিত। বলো, তাহলে তোমরা কোথা থেকে বিভ্রান্ত হচ্ছে?”
সূরা ইউনুসের ৩১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে : “এদেরকে জিজ্ঞেস করো কে তোমাদের আকাশ ও যমীন থেকে রিযিক দেন? তোমরা যে শ্রবণ ও দৃষ্টিক্ষমতার অধিকারী হয়েছো এগুলো কার ইখতিয়ারভুক্ত? আর কে জীবিতকে মৃত থেকে এবং মৃতকে জীবিত থেকে বের করেন? এবং কে এ বিশ্বব্যবস্থাপনা চালাচ্ছেন? এরা নিশ্চয়ই বলবে, আল্লাহ্।”
অনুরূপভাবে সূরা ইউনুসের আর এক জায়গায় বলা হয়েছে : “যখন তোমরা জাহাজে আরোহণ করে অনুক‚ল বাতাসে আনন্দ চিত্তে সফর করতে থাকো আর তারপর হঠাৎ প্রতিক‚ল বাতাসের বেগ বেড়ে যায়, চারদিক থেকে তরঙ্গ আঘাত করতে থাকে এবং মুসাফিররা মনে করতে থাকে, তারা চারদিক থেকে ঝঞ্জা পরিবৃত হয়ে পড়েছে, তখন সবাই নিজের দীনকে একমাত্র আল্লাহ্র জন্য নির্ধারিত করে নিয়ে তাঁরই কাছে দোয়া করতে থাকো এই বলে : “হে আল্লাহ্ যদি তুমি আমাদের এ বিপদ থেকে উদ্ধার করো তাহলে আমরা কৃতজ্ঞ বান্দায় পরিণত হবো। কিন্তু যখন তিনি তাদেরকে বাঁচিয়ে দেন তখন এই লোকেরাই সত্যচ্যুত হয়ে পৃথিবীতে বিদ্রোহ সৃষ্টির কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে।”
সূরা বনী ইসরাঈলের ৬৭ নম্বর আয়াতে একথাটিরই পুনরাবৃত্তি এভাবে করা হয়েছে : “যখন সমুদ্রে তোমাদের ওপর বিপদ আসে তখন সেই একজন ছাড়া আর যাদেরকে তোমরা ডাকতে তারা সবাই হারিয়ে যায়। কিন্তু যখন তিনি তোমাদের বাঁচিয়ে স্থলভাগে পৌঁছিয়ে দেন তখন তোমরা তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও।”
এ আয়াতগুলো সামনে রেখে চিন্তা করুন, লোকেরা তাঁকে (রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করলো, আপনার সেই রব কে এবং কেমন, যার ইবাদাত বন্দেগী করার জন্য আপনি আমাদের প্রতি আহবান জানাচ্ছেন? তিনি এর জবাবে বললেন : ‘হুওয়াল-লাহু’ বা “তিনি আল্লাহ।” এ জবাব থেকে আপনা-আপনি এ অর্থ বের হয়, যাকে তোমরা নিজেরাই নিজেদের ও সারা বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা, প্রভু, আহারদাতা, পরিচালক ও ব্যবস্থাপক বলে মানো এবং কঠিন সংকটময় মুহূর্তে অন্য সব মাবুদদের পরিত্যাগ করে একমাত্র তাঁর কাছেই সাহায্য করার আবেদন জানাও, তিনিই আমার রব এবং তাঁরই ইবাদাত করার দিকে আমি তোমাদের আহŸান জানাচ্ছি। এ জবাবের মধ্যে আল্লাহ্র সমস্ত পূর্ণাংগ গুণাবলী আপনা-আপনি এসে পড়ে। কারণ যিনি এ বিশ্ব-জাহানের সৃষ্টিকর্তা, যিনি এর বিভিন্ন বিষয়ের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা করেন, যিনি এর মধ্যে বসবাসকারী সমস্ত প্রাণীর আহার যোগান এবং বিপদের সময় নিজের বান্দাদের সাহায্য করেন তিনি জীবিত নন, শুনতে ও দেখতে পান না, স্বাধীন ও সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নন, সর্বজ্ঞ ও সর্বজ্ঞানী নন, করুণাময় ও স্নেহশীল নন এবং সবার ওপর প্রাধান্য বিস্তারকারী নন, একথা আদতে কল্পনাই করা যায় না।
ব্যাকরণের সূত্র অনুসারে উলামায়ে কেরাম “হুওয়াল-লাহু আহাদুন” বাক্যটির বিভিন্ন বিশ্লেষণ দিয়েছেন। কিন্তু যে বিশ্লেষণটি এখানকার সাথে পুরোপুরি খাপ খায় সেটি হচ্ছে : ‘হুয়া’ উদ্দেশ্য (ঝঁনলবপঃ) “আল্লাহ” তার বিধেয় (চৎবফরপধঃব) এবং “আহাদুন” তার দ্বিতীয় বিধেয়। এ বিশ্লেষণের দৃষ্টিতে এ বাক্যটির অর্থ হচ্ছে, তিনি (যাঁর সম্পর্কে তোমরা প্রশ্ন করছো) আল্লাহ, একক। অন্য অর্থ এও হতে পারে এবং ভাষারীতির দিক দিয়ে এটা ভুলও নয় যে, তিনি আল্লাহ্ এক।
এখানে সর্বপ্রথম একথাটি বুঝে নিতে হবে যে, বাক্যটিতে মহান আল্লাহ্র জন্য “আহাদ” শব্দটি যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তা আরবি ভাষায় এ শব্দটির একটি অস্বাভাবিক ব্যবহার। সাধারণত অন্য একটি শব্দের সাথে সম্বন্ধের ভিত্তিতে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়, যেমন : “ইউমুল আহাদ” “সপ্তাহের প্রথম দিন।” অনুরূপভাবে “ফবাআচ্ছাউ আহাদুম” “তোমাদের কোন একজনকে পাঠাও।” অথবা সাধারণ নেতিবাচক অর্থে এর ব্যবহার হয়। যেমন : “মা যা-আ ফি আহাদুন” “আমার কাছে কেউ আসে নি।” কিংবা ব্যাপকভাবে ধারণাসহ প্রশ্ন সূচক বাক্যে বলা হয়। যেমন : “হাল ইন্দাকা আহাদুন” “তোমার কাছে কি কেউ আছে?” অথবা এ ব্যাপকতার ধারণাসহ শর্ত প্রকাশক বাক্যে এর ব্যবহার হয় যেমন : “ইন্ যালা কা আহাদুন” “যদি তোমার কাছে কেউ এসে থাকে।” অথবা গণনায় বলা হয়। যেমন : “আহাদুন, ইছনাইন, আহাদুন আসরা” “এক, দুই, এগার।” এ সীমিত ব্যবহারগুলো ছাড়া কুরআন করিম নাযিলের পূর্বে আরবি ভাষায় “আহাদ” শব্দটির গুণবাচক অর্থে ব্যবহার অর্থাৎ কোন ব্যক্তি বা জিনিসের গুণ প্রকাশ অর্থে “আহাদ” শব্দের ব্যবহারের কোন নজির নেই। আর কুরআন করিম নাযিলের পর এ শব্দটি শুধুমাত্র আল্লাহ্র সত্তার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। এ অস্বাভাবিক বর্ণনা পদ্ধতি স্বতস্ফ‚র্তভাবে একথা প্রকাশ করে যে, একক ও অদ্বিতীয় হওয়া আল্লাহ্র বিশেষ গুণ। বিশ্ব-জাহানের কোন কিছুই এ গুণে গুণান্বিত নয়। তিনি এক ও একক, তাঁর কোন দ্বিতীয় নেই।
তারপর মুশরিক ও কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁর রব সম্পর্কে যেসব প্রশ্ন করেছিল সেগুলো সামনে রেখে দেখুন, “হুওয়ালÑ লাহু” বলার পর “আহাদ” বলে কিভাবে তার জবাব দেয়া হয়েছে :
প্রথমত. এর মানে হচ্ছে, তিনি একাই রব। তাঁর ‘রবুবিয়াতে’ কারো কোন অংশ নেই। আর যেহেতু ইলাহ্ (মাবুদ) একমাত্র তিনিই হতে পারেন যিনি রব (মালিক ও প্রতিপালক) হন, তাই ‘উলুহীয়াতে’ও (মাবুদ হবার গুণাবলী) কেউ তাঁর সাথে শরীক নেই।
দ্বিতীয়ত. এর মানে এও যে, তিনি একাই এ বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা। এ সৃষ্টিকর্মে কেউ তাঁর সাথে শরীক নয়। তিনি একাই সমগ্র বিশ্ব-রাজ্যের মালিক ও একচ্ছত্র অধিপতি। তিনি একাই বিশ্ব-ব্যবস্থার পরিচালক ও ব্যবস্থাপক। নিজের সমগ্র সৃষ্টিজগতের রিযিক তিনি একাই দান করেন। সংকটকালে তিনি একাই তাদের সাহায্য করেন ও ফরিয়াদ শোনেন। আল্লাহ্র সার্বভৌম কর্তৃত্বের এসব কাজকে তোমরা নিজেরাও আল্লাহ্র কাজ বলে মনে করো, এসব কাজে আর কারো সামান্যতম কোন অংশও নেই।
তৃতীয়ত. তারা একথাও জিজ্ঞেস করেছিল, তিনি কিসের তৈরি? তাঁর বংশধারা কি? তিনি কোন প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত? দুনিয়ার উত্তরাধিকার তিনি কার কাছ থেকে পেয়েছেন? এবং তাঁর পর কে এর উত্তরাধিকারী হবে? আল্লাহ্ তাদের এ সমস্ত প্রশ্নের জবাব একটিমাত্র “আহাদ” শব্দের মাধ্যমে দিয়েছেন। এর অর্থ হচ্ছে : (১) তিনি এক আল্লাহ্ চিরকাল আছেন এবং চিরকাল থাকবেন। তাঁর আগে কেউ আল্লাহ্ ছিল না এবং তাঁর পরেও কেউ আল্লাহ্ হবে না। (২) আল্লাহ্র এমন কোন প্রজাতি নেই, যার সদস্য তিনি হতে পারেন। বরং তিনি একাই আল্লাহ্ এবং তাঁর সমগোত্রীয় ও সমজাতীয় কেউ নেই। (৩) তাঁর সত্তা নিছক “ওয়াহেদ” এক নয় বরং “আহাদ” একক, যেখানে কোন দিক দিয়ে একাধিক্যের সামান্যতম স্পর্শও নেই। তিনি বিভিন্ন উপাদানে গঠিত কোন সত্তা নন। তাঁর সত্তাকে দ্বিখÐিত করা যেতে পারে না। তাঁর কোন আকার ও রূপ নেই। তা কোনো স্থানের গÐিতে আবদ্ধ নয় এবং তার মধ্যে কোনো জিনিস আবদ্ধ হতে পারে না। তাঁর কোনো বর্ণ নেই। কোনো অংগ-প্রত্যংগ নেই। কোনো দিক নেই। তাঁর মধ্যে কোনো প্রকার পরিবর্তন-বিবর্তন ঘটে না। সকল প্রকার ধরন ও প্রকরণ মুক্ত ও বিবর্জিত তিনি একমাত্র সত্তা, যা সবদিক দিয়েই আহাদ বা একক। (এ পর্যায়ে একথাটি ভালোভাবে জেনে নিতে হবে যে, আরবী ভাষায় “ওয়াহেদ” শব্দটিকে ঠিক তেমনিভাবে ব্যবহার করা হয় যেমনভাবে আমাদের ভাষায় আমরা “এক” শব্দটিকে ব্যবহার করে থাকি। বিপুল সংখ্যা সম্বলিত কোন সমষ্টিকেও তার সামগ্রিক সত্তাকে সামনে রেখে “ওয়াহেদ” বা “এক” বলা হয়। যেমন এক ব্যক্তি, এক জাতি, এক দেশ, এক পৃথিবী, এমন কি এক বিশ্ব-জাহানও। আবার কোন সমষ্টির প্রত্যেক অংশকেও আলাদা আলাদাভাবেও “এক”-ই বলা হয়। কিন্তু “আহাদ” বা একক শব্দটি আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো জন্য ব্যবহার করা হয় না। এ জন্য কুরআন করিমে যেখানেই আল্লাহ্র জন্য ওয়াহেদ (এক) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে সেখানেই বলা হয়েছে : “ইলাহুন ওয়াহেদ” এক মাবুদ বা “আল্লাহুল ওয়াহেদুল কাহ্হার”Ñএক আল্লাহ্ই সবাইকে বিজিত ও পদানত করে রাখেন। কোথাও নিছক “ওয়াহেদ” বলা হয় নি। কারণ যেসব জিনিসের মধ্যে বিপুল ও বিশাল সমষ্টি রয়েছে তাদের জন্যও এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। বিপরীত পক্ষে আহাদ শব্দটি একমাত্র আল্লাহ্র জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। কারণ আল্লাহ্ই একমাত্র সত্তা ও অস্তিত্ব যার মধ্যে কোন প্রকার একাধিক্য নেই। তাঁর একক সত্তা সবদিক দিয়েই পূর্ণাংগ।
এরপরের আয়াতে “সামাদ” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে “সোয়াদ মি দাল” ধাতু থেকে। আরবি ভাষায় এ ধাতুটি থেকে যতগুলো শব্দের উৎপত্তি হয়েছে সেগুলোর ওপর নজর বুলালে এ শব্দটির অর্থের ব্যাপকতা জানা যায়। যেমন : “আল-সামাদ” মনস্থ করা, ইচ্ছা করা। বিপুলায়তন বিশিষ্ট উন্নত স্থান এবং বিপুল ঘনত্ব বিশিষ্ট উন্নত মর্যাদা। উচ্চ সমতল ছাদ। যুদ্ধে যে ব্যক্তি ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত হয় না। প্রয়োজনের সময় যে সরদারের শরাণাপন্ন হতে হয়।
“আস-সামাদু” : প্রত্যেক জিনিসের উঁচু অংশ। যে ব্যক্তির ওপরে আর কেউ নেই। যে নেতার আনুগত্য করা হয় এবং তার সাহায্য ছাড়া কোন বিষয়ের ফায়সালা করা হয় না। অভাবীরা যে নেতার শরণাপন্ন হয়। চিরন্তন। উন্নত মর্যাদা। এমন নিবিড় ও নিচ্ছিদ্র যার মধ্যে কোন ছিদ্র, শূন্যতা ও ফাঁকা অংশ নেই, যেখান থেকে কোন জিনিস বের হতে পারে না এবং কোন জিনিস যার মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না। যুদ্ধে যে ব্যক্তি ক্ষুধা-তৃষ্ণার শিকার হয় না।
এই বাক্যের ‘সামাদ’ নিয়ে যা আলোচনা করা হয়েছে তার মধ্যে, ১. জমাট জিনিস, যার পেট নেই। ২. যে লক্ষের দিকে যেতে মনস্থ করা হয়; যে কঠিন জিনিসের মধ্যে কোন দুর্বলতা নেই। ২. এমন গৃহ, প্রয়োজন ও অভাব পূরণের জন্য যার আশ্রয় নিতে হয়। ৪. উঁচু ইমারত। ৫. ঐ লোকটির দিকে যাওয়ার সংকল্প করলো। ৬. ব্যাপারটি তার হাতে সোপর্দ করলো; তার সামনে ব্যাপারটি পেশ করলো; বিষয়টি সম্পর্কে তার ওপর আস্থা স্থাপন করলো। (সিহাহ, কামূস ও লিসানুল আরব)।
এসব শাব্দিক ও আভিধানিক অর্থের ভিত্তিতে “আল্লাহুস সামাদ” আয়াতটিতে উল্লেখিত “সামাদ” শব্দের যে ব্যাখ্যা সাহাবা, তাবেঈ ও পরবর্তীকালের আলেমগণ থেকে উদ্ধৃত হয়েছে নিচে আমরা তা উল্লেখ করছি :
হযরত আলী রা., ইকরামা ও কা’ব আহবার বলেছেন : সামাদ হচ্ছেন এমন এক সত্তা যাঁর ওপরে আর কেউ নেই।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা., হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. ও আবু ওয়ায়েল শাকীক ইবনে সালামাহ বলেছেন : তিনি এমন সরদার, নেতা ও সমাজপতি, যাঁর নেতৃত্ব পূর্ণতা লাভ করেছে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
এ প্রসংগে ইবনে আব্বাসের দ্বিতীয় উক্তি হচ্ছে : লোকেরা কোন বিপদে-আপদে যার দিকে সাহায্য লাভের জন্য এগিয়ে যায়, তিনি সামাদ। তাঁর আর একটি উক্তি হচ্ছে : যে সরদার তার নেতৃত্ব, মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব, ধৈর্য, সংযম, জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণাতায় পূর্ণতার অধিকারী তিনি সামাদ।
হযরত আবু হুরাইরা রা. বলেছেন : যিনি কারো ওপর নির্ভরশীল নন, সবাই তাঁর ওপর নির্ভরশীল, তিনিই সামাদ।
ইকরামার আর একটি বক্তব্য হচ্ছে : যার মধ্য থেকে কোন জিনিস কোনদিন বের হয় নি এবং বের হয়ও না আর যে পানাহার করে না, সে-ই সামাদ। এরই সমার্থবোধক উক্তি সা’বী ও মুহাম্মদ ইবনে কা’ব আল কুরাযী থেকেও উদ্ধৃত হয়েছে।
সুদ্দী বলেছেন : আকাংখিত বস্তু লাভ করার জন্য লোকেরা যার কাছে যায় এবং বিপদে সাহায্য লাভের আশায় যার দিকে হাত বাড়ায়, তাকেই সামাদ বলে।
সাঈদ ইবনে জুবাইর বলেছেন : যে নিজের সকল গুণ ও কাজে পূর্ণতার অধিকারী হয়।
রাবী ইবনে আনাস বলেছেন : যার ওপর কখনো বিপদ-আপদ আসে না।
মুকাতেল ইবনে হাইয়ান বলেছেন : যিনি সকল প্রকার দোষ-ত্রæটি মুক্ত।
ইবনে কাইসান বলেছেন : অন্য কেউ যার গুণাবলীর ধারক হয় না।
হাসান বসরী ও কাতাদাহ বলেছেন : যে বিদ্যমান থাকে এবং যার বিনাশ নেই। প্রায় এই একই ধরনের উক্তি করেছেন মুজাহিদ, মা’মার ও র্মুরাতুল হামদানী।
মুররাতুল হামদানীর আর একটি উক্ত হচ্ছে : যে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী ফায়সালা করে এবং যা ইচ্ছা তাই করে; যার হুকুম ও ফায়সালা পূর্ণবিবেচনা করার ক্ষমতা কারো থাকে না।
ইবরাহীম নাখয়ী বলেছেন : যার দিকে লোকেরা নিজেদের প্রয়োজন পূরণের জন্য এগিয়ে যায়।
আবু বকর আমবায়ী বলেছেন : সামাদ এমন এক সরদারকে বলা হয়, যার ওপরে আর কোন সরদার নেই এবং লোকেরা নিজেদের বিভিন্ন বিষয়ে ও নিজেদের প্রয়োজন পূরণের জন্য যার শরণাপন্ন হয়, অভিধানবিদদের মধ্যে এ ব্যাপারে কোন মতবিরোধ নেই। আয যুজাজের বক্তব্য প্রায় এর কাছাকাছি। তিনি বলেছেন : যার ওপর এসে নেতৃত্ব খতম হয়ে গেছে এবং নিজের প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য প্রত্যেক যার শরণাপন্ন হয়, তাকেই বলা হয় সামাদ।
এখন চিন্তা করুন, প্রথম বাক্যে “আল্লাহু আহাদ” কেন বলা হয়েছে এবং এ বাক্যে “আল্লাহুস সামাদ” বলা হয়েছে কেন? “আহাদ” শব্দটি সম্পর্কে ইতিপূর্বে বলেছি, তা শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট-আর কারো জন্য এ শব্দটি আদৌ ব্যবহৃত হয় না। তাই এখানে “আহাদুন” শব্দটি অনির্দিষ্ট অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। অন্যদিকে “সামাদ” শব্দটি অন্যান্য সৃষ্টির জন্যও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তাই “আল্লাহু সামাদুন” না বলে “আল্লাহুস সামাদ” বলা হয়েছে। এর মানে হচ্ছে, আসল ও প্রকৃত সামাদ হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ। সৃষ্টি যদি কোনো দিক দিয়ে সামাদ হয়ে থাকে তাহলে অন্য দিক দিয়ে তা সামাদ নয়। কারণ তার অবিনশ্বর নয়Ñ একদিন তার বিনাশ হবে। তাকে বিশ্লেষণ ও বিভক্ত করা যায়। তা বিভিন্ন উপাদান সহযোগে গঠিত। যে কোন সময় তার উপাদানগুলো আলাদা হয়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে। কোন কোন সৃষ্টি তার মুখাপেক্ষী হলেও সে নিজেও আবার কারো মুখাপেক্ষী। তার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব আপেক্ষিক, নিরংকুশ নয়। কারো তুলনায় সে শ্রেষ্ঠতম হলেও তার তুলনায় আবার অন্য কেউ আছে শ্রেষ্ঠতম। কিছু সৃষ্টির কিছু প্রয়োজন সে পূর্ণ করতে পারে, কিন্তু সবার সমস্ত প্রয়োজন পূর্ণ করার ক্ষমতা কোনো সৃষ্টি নেই। বিপরীত পক্ষে আল্লাহ্র সামাদ হবার গুণ অর্থাৎ তাঁর মুখাপেক্ষীহীনতার গুণ সবদিক দিয়েই পরিপূর্ণ। সারা দুনিয়া তাঁর মুখাপেক্ষী তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। দুনিয়ার প্রত্যেকটি জিনিস নিজের অস্তিত্ব, স্থায়ীত্ব এবং প্রয়োজন ও অভাব পূরণের জন্য সতেচন ও অবচেতনভাবে তাঁরই শরণাপন্ন হয়। তিনিই তাদের সবার প্রয়োজন পূর্ণ করেন। তিনি অমর, অজয়, অক্ষয়। তিনি রিযিক দেন- নেন না। তিনি একক-যৌগিক ও মিশ্র নন। কাজেই বিভক্তি ও বিশ্লেষণযোগ্য নন। সমগ্র বিশ্ব-জাহানের ওপর তাঁর নেতৃত্বে ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত। তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ। তাই তিনি নিছক “সামাদ” নন, বরং “আস্সামাদ।” অর্থাৎ তিনিই একমাত্র সত্তা যিনি মূলত সামাদ তথা অমুখাপেক্ষিতার গুণাবলীর সাথে পুরোপুরি সংযুক্ত।
আবার যেহেতু তিনি “আস্সামাদ” তাই তাঁর একাকী ও স্বজনবিহীন হওয়া অপরিহার্য। কারণ এ ধরনের সত্তা একজনই হতে পারেন, যিনি কারো কাছে নিজের অভাব পূরণের জন্য হাত পাতেন না, বরং সবাই নিজেদের অভাব পূরণের জন্য তাঁর মুখাপেক্ষী হয়। দুই বা তার চেয়ে বেশি সত্তা সবার প্রতি অমুখাপেক্ষী ও অনির্ভলশীল এবং সবার প্রয়োজন পূরণকারী হতে পারে না। তাছাড়া তাঁর “আস্সামাদ” হবার কারণে তাঁর একক মাবুদ হবার ব্যাপারটিও অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কারণ মানুষ যার মুখাপেক্ষী হয় তারই ইবাদাত করে। আবার তিনি ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই, “আস্সামাদ” হবার কারণে এটাও অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কারণ, যে প্রয়োজন পূরণ করার ক্ষমতা ও সামর্থই রাখে না, কোন সচেতন ব্যক্তি তার ইবাদাত করতে পারে না।
সূরার তৃতীয় আয়াতে যা বর্ণিত হয়েছে তা হচ্ছে,Ñ মুশকিরা প্রতি যুগে খোদায়ীর এ ধারণা পোষণ করে এসেছে যে, মানুষের মতো খোদাদেরও একটি জাতি বা শ্রেণী আছে। তার সদস্য সংখ্যাও অনেক। তাদের মধ্যে বিয়ে-শাদী এবং বংশ বিস্তারের কাজও চলে। তারা আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনকেও এ জাহেলী ধারণা থেকে মুক্ত রাখে নি। তাঁর জন্য সন্তান-সন্ততিও ঠিক করে নিয়েছে। তাই কুরআন করিমে আরববাসীদের আকীদা বর্ণনা প্রসংগে বলা হয়েছে, তারা ফেরেশতাদেরকে মহান আল্লাহ্র কন্যা গণ্য করতো। তাদের জাহেলী চিন্তা নবীগণের উম্মাতদেরকেও সংরক্ষিত রাখে নি। তাদের মধ্যেও নিজেদের সৎ ও শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে আল্লাহ্র পুত্র গণ্য করার আকীদা জন্ম নেয়। এ বিভিন্ন ধরনের কাল্পনিক চিন্তা-বিশ্বাসের মধ্যে দুই ধরনের চিন্তা সবসময় মিশ্রিত হতে থেকেছে। কিছু লোক মনে করেছে, যাদেরকে তারা আল্লাহ্র সন্তান গণ্য করছে তারা সেই মহান পবিত্র সত্তার ঔরসজাত সন্তান। আবার কেউ কেউ দাবী করেছে, যাকে তারা আল্লাহ্র সন্তান বলছে, আল্লাহ্ তাকে নিজের পালকপুত্র বানিয়েছেন। যদিও তাদের কেউ কাউকে (মাআ’যাল্লাহ) আল্লাহ্র পিতা গণ্য করার সাহস করে নি। কিন্তু যখন কোন সত্তা সম্পর্কে ধারণা করা হয় যে, তিনি সন্তান উৎপাদন ও বংশ বিস্তারের দায়িত্বমুক্ত নন এবং তাঁর সম্পর্কে ধারণা করা হয়, তিনি মানুষ জাতীয় এক ধরনের অস্তিত্ব, তাঁর ঔরসে সন্তান জন্মলাভ করে এবং অপুত্রক হলে তার কাউকে পালক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করার প্রয়োজন দেখা দেয়, তখন মানুষের মন তাঁকেও কারো সন্তান মনে করার ধারণা মুক্ত থাকতে পারে না। এ কারণে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যেসব প্রশ্ন করা হয়েছিল তার মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল, আল্লাহ্র বংশধারা কি? দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছিল, কার কাছ থেকে তিনি দুনিয়ার উত্তরাধিকার লাভ করেছেন এবং তাঁর পরে এর উত্তরাধিকারী হবে কে?
এসব জাহেলী মূর্খতা প্রসূত ধারণা-কল্পনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এগুলোকে যদি নীতিগতভাবে মেনে নিতে হয়, তাহলে আরো কিছু জিনিসকেও মেনে নেয়া অপরিহার্য হয়ে পড়ে। যেমন :
এক : আল্লাহ্ এক নয়, বরং আল্লাহ্র কোন একটি জাতি ও গোষ্ঠী আছে। তাদের সদস্যরা আল্লাহ্র গুণাবলী, কার্যকলাপ ও কর্তৃত্ব-ক্ষমতায় তাঁর সাথে শরীক। আল্লাহ্র কেবলমাত্র ঔরসজাত সন্তান ধারণা করে নিলে এ বিষয়টি অপরিহার্য হয় না, বরং কাউকে পালকপুত্র হিসেবে ধারণা করে নিলেও এটি অপরিহার্য হয়। কেননা কারো পালকপুত্র অবশ্যি তারই সমজাতীয় ও সমগোত্রীয়ই হতে পারে। আর (মা’আযাল্লাহ) যখন সে আল্লাহ্র সমজাতীয় ও সমগোত্রীয় হয়, তখনই সে আল্লাহ্র গুণাবলী সম্পন্নও হবে, একথা অস্বীকার করা যেতে পারে না।
দুই : পুরুষ ও নারীর মিলন ছাড়া কোন সন্তানের ধারণা ও কল্পনা করা যেতে পারে না। বাপ ও মায়ের শরীর থেকে কোন জিনিস বের হয়ে সন্তানের রূপ লাভ করেÑ সন্তান বলতে একথাই বুঝায়। কাজেই এ ক্ষেত্রে আল্লাহ্র সন্তান ধারণা করার ফলে (নাউযুবিল্লাহ) তাঁর একটি বস্তুগত ও শারীরিক অস্তিত্ব, তাঁর সমজাতীয় কোন স্ত্রীর অস্তিত্ব এবং তার শরীর থেকে কোন বস্তু বের হওয়াও অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
তিন : সন্তান উৎপাদন ও বংশধারা চালাবার কথা যেখানে আসে সেখানে এর মূল কারণ হয় এই যে, ব্যক্তিরা হয় মরণশীল এবং তাদের জাতির ও গোষ্ঠীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তাদের সন্তান উৎপাদন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কারণ, এ সন্তানদের সাহায্যেই তাদের বংশধারা অব্যাহত থাকবে এবং সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। কাজেই আল্লাহ্র সন্তান আছে বলে মনে করলে (নাউযুবিল্লাহ্) তিনি নিজে যে মরণশীল এবং তাঁর বংশ ও তাঁর নিজের সত্তা কোনটিই চিরন্তন নয় একথা মেনে নেয়া অপরিহার্য হয়ে পড়ে। তাছাড়া সমস্ত মরণশীল ব্যক্তির মতো (নাউযুবিল্লাহ) আল্লাহ্রও কোন শুরু ও শেষ আছে, একথাও মেনে নেয়া অপরিহার্য হয়ে যায়। কারণ, সন্তান উৎপাদন ও বংশ বিস্তারের ওপর যেসব জাতি ও গোত্র নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তাদের ব্যক্তিবর্গ অনাদি-অনন্তকালীন জীবনের অধিকারী হয় না।
চার : কারো পালকপুত্র বলবার উদ্দেশ্য এ হয় যে, একজন সন্তানহীন ব্যক্তি তার নিজের জীবনে কারো সাহায্যের এবং নিজের মৃত্যুর পর কোন উত্তরাধিকারের প্রয়োজন বোধ করে। কাজেই আল্লাহ্ কাউকে নিজের পুত্র বানিয়েছেন একথা মনে করা হলে সেই পবিত্র সত্তার সাথে এমন সব দুর্বলত সংশ্লিষ্ট করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে, যেগুলো মরণশীল মানুষের মধ্যে পাওয়া যায়।
যদিও মহান আল্লাহ্কে “আহাদ” ও “আস্সামাদ” বললে এসব উদ্ভট ধারণাÑকল্পনার মূলে কুঠারাঘাত করা হয়, তবুও এরপর “না তাঁর কোন সন্তান আছে, না তিনি কারো সন্তান”Ñ একথা বলায় এ ব্যাপারে আর কোন প্রকার সংশয়-সন্দেহের অবকাশই থাকে না। তারপর যেহেতু আল্লাহ্র মহান সত্তা সম্পর্কে এ ধরনের ধারণা-কল্পনা শিরকের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলোর অন্তর্ভুক্ত, তাই মহান আল্লাহ্ শুধুমাত্র সূরা ইখলাসেই এগুলোর দ্ব্যর্থহীন ও চূড়ান্ত প্রতিবাদ করেই ক্ষান্ত হন নি, বরং বিভিন্ন জায়গায় এ বিষয়টিকে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন। এভাবে লোকেরা সত্যকে পুরোপুরি বুঝতে সক্ষম হবে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ নিচের কুরআন করিমের কিছু আয়াত থেকে উদ্বৃতি দেয়া হলো :
“আল্লাহ্-ই হচ্ছেন একমাত্র ইলাহ। কেউ তাঁর পুত্র হবে, এ অবস্থা থেকে তিনি মুক্ত-পাক-পবিত্র। যা কিছু আকাশসমূহের মধ্যে এবং যা কিছু যমীনের মধ্যে আছে, সবই তার মালিকানাধীন।” (আন নিসা, ১৭১)
“জেনে রাখো, এরা যে বলছে আল্লাহ্র সন্তান আছে, এটা এদের নিজেদের মনগড়া কথা। আসলে এটি একটি ডাহা মিথ্যা কথা।” (আস সাফ্ফাত, ১৫১-১৫২)
“তারা আল্লাহ্ ও ফেরেশতাদের মধ্যে বংশীয় সম্পর্ক তৈরি করে নিয়েছে অথচ ফেরেশতারা ভালো করেই জানে এরা (অপরাধী হিসেবে) উপস্থাপিত হবে।” (আস সাফ্ফাত, ১৫৮)
“লোকেরা তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে কাউকে তাঁর অংশ বানিয়ে ফেলেছে। আসলে মানুষ স্পষ্ট অকৃতজ্ঞ।” (আয্ যুখরুফ, ১৫)
“আর লোকেরা জিনদেরকে আল্লাহ্র শরীক বানিয়েছে। অথচ তিনি তাদের স্রষ্টা। আর তারা না জেনে-বুঝে তাঁর জন্য পুত্র-কন্যা বানিয়ে নিয়েছে। অথচ তারা যে সমস্ত কথা বলে তা থেকে তিনি মুক্ত ও পবিত্র এবং তার ঊর্ধে তিনি অবস্থান করছেন। তিনি তো আকাশসমূহ ও পৃথিবীর নির্মাতা। তাঁর পুত্র কেমন করে হতে পারে যখন তাঁর কোন সঙ্গিনী নেই? তিনি প্রত্যেকটি জিনিস সৃষ্টি করেছেন।” (আল আনআম, ১০০-১০১)
“আর তারা বললো, দয়াময় আল্লাহ্ কাউকে পুত্র বানিয়েছেন। তিনি পাক-পবিত্র। বরং (যাদেরকে এরা তাঁর সন্তান বলছে) তারা এমন সব বান্দা যাদেরকে মর্যাদা দান করা হয়েছে।” (আল আম্বিয়া, ২৬)
“লোকেরা বলে দিয়েছে, আল্লাহ্ কাউকে পুত্র বানিয়েছেন আল্লাহ্ পাক-পবিত্র। তিনি তো অমুখাপেক্ষী। আকাশসমূহে ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই তাঁর মালিকানাধীন। এ বক্তব্যের সপক্ষে তোমাদের প্রমাণ কি? তোমরা কি আল্লাহ্র সম্পর্কে এমন সব কথা বলছো, যা তোমরা জনো না?” (ইউনুস, ৬৮)
“আর হে নবী! বলে দাও, সেই আল্লাহ্র জন্য সব প্রশংসা যিনি না কাউকে পুত্র বানিয়েছেন, না বাদশাহীতে কেউ তাঁর শরীক আর না তিনি অক্ষয়, যার ফলে কেউ হবে তাঁর পৃষ্ঠপোষক।” (বনী ইসরাঈল, ১১১)
“আল্লাহ্ কাউকে পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন নি এবং তাঁর সাথে দ্বিতীয় কোন ইলাহও নেই।” (আল মু’মিনূন, ৯১)
যারা আল্লাহ্র জন্য ঔরসজাত সন্তান অথবা পালকপুত্র গ্রহণ করার কথা বলে, এ আয়াতগুলোতে সর্বতোভাবে তাদের এহেন আকীদা-বিশ্বাসের প্রতিবাদ করা হয়েছে। এ আয়াতগুলো এবং এ বিষয়বস্তু সম্বলিত অন্য যে সমস্ত আয়াত কুরআনের বিভিন্ন স্থানে পাওয়া যায়, সেগুলো সূরা ইখলাসের অতি চমৎকার ব্যাখ্যা।
সূরার চতুর্থ আয়াতের ‘কুফূ’ নিয়ে আলোচনা করলে আমরা একটি সিদ্ধান্তে আসতে পারি। আরবি ‘কুফূ’-এর অর্থ হচ্ছে, নজীর, সদৃশ, সমান, সমমর্যাদা সম্পন্ন ও সমতুল্য। বিয়ের ব্যাপারে আমাদের দেশে ‘কুফ‚’ শব্দের ব্যবহার আছে। এ ক্ষেত্রে এর অর্থ হয়, সামাজিক মর্যাদার দিক দিয়ে ছেলের ও মেয়ের সমান পর্যায়ে অবস্থান করা। কাজেই এখানে এ আয়াতের মানে হচ্ছে : সারা বিশ্ব-জাহানের আল্লাহ্র সমকক্ষ অথবা তাঁর সমমর্যাদা সম্পন্ন কিংবা নিজের গুণাবলী, কর্ম ও ক্ষমতার ব্যাপারে তাঁর সমান পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে এমন কেউ কোনো দিন ছিল না এবং কোনো দিন হতেও পারবে না।
উপসংহার :
আমরা আমাদের সাদা চোখে দেখতে পাই, সূরা আল ইখলাস কুরআন করিমের মজিদের একটি সূরা মাত্র। কিন্তু এর গভীরতা কত বেশি, সূরার বাস্তবতা, সূরার মর্মার্থ, সূরার মর্যাদা সম্পর্কে আমরা মোটেই ধারণা রাখি না। প্রকৃত অর্থে, সূরা আল ইখলাস রাব্বুল আলামীন বা আল্লাহ সোবহানুতালা সম্পর্কে একটি সুনির্দিষ্ট ধারণা আমাদেরকে দেয়। কিন্তু আমরা এ বিষেয়ে ওয়াকিবহাল নই। কারণ আমাদের মাতৃভাষা আরবি নয়। মায়ের জটর থেকে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণের পরে যখন মুখে কথা ফোঁটে তখন আমরা আমাদের মাতৃভাষাতেই কথা বলা শুরু করি।
যারা প্রকৃত অর্থে নায়েবে রাসূল সা., যারা কুরআন মজীদ সম্পর্কে বিশেষভাবে জ্ঞান রাখেন, মসজিদের খতিব, ইমাম সাহেবদের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিত আমার মতো অজ্ঞদেরকে সূরা আল ইখলাস শুধু নয়, কুরআনের বিভিন্ন সূরায় বর্ণিত শাস্তি ও পুরস্কার সম্পর্কে বেশি বেশি ধারণা বা বয়ান দেওয়া।
একই সাথে যাদের পক্ষে সম্ভব পরিবারের সদস্যদেরকে বেশি বেশি কুরআন মজীদ ও হাদিস পাঠ এবং এর ভাবার্থ, মর্মার্থ সম্পর্কে অবগত ও ওয়াকিবহাল করার মাধ্যমে প্রতিটি পরিবারকে ইসলামী আদর্শে দীক্ষা প্রদান ও অভ্যাস গড়ে তোলা অপরিহার্য।
বিশেষ ভাবে বলতে হয় যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূরা আল ইখলাস সম্পর্কে যেভাবে বলেছেন : “সূরা আল ইখলাস কুরআন করিমের এক তৃতীয়াংশের সমান। এই সূরার ভালোবাসা একজন মুমীনকে জান্নাতে পৌঁছে দিবে।”
হাদিসের বর্ণনা মতে যেখানে স্বয়ং আল্লাহ্ তা’আলা সূরা ইখলাসের ভালোবাসা মুমীনের ঠিকানা জান্নাত বলেছেন। সুতরাং আসুন আমরা বেশি বেশি সূরা আল ইখলাস পাঠ করতে অভ্যস্ত হই। সূরা আল ইখলাসের গুরুত্ব অনুধাবন করি। সূরা ইখলাসকে ভালোবাসি। কারণ সূরা ইখলাসকে ভালোবাসা মানে আল্লাহকে ভালোবাসা। আমরা এর গুরুত্বকে নিজেদের পরিবারে, সমাজে, তথা রাষ্ট্রে ছড়িয়ে দিই।
মহান রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে এব্যাপারে বেশি বেশি আমল করার তওফিক দান করুন। আমিন। সুম্মা আমিন।
লেখক : গবেষক, ইতিহাস লেখক, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমী।
সাহায্যকারীগ্রন্থ
তাফসীরে ইবনে কাছীর, আল্লামা ইবনে কাছীর র., অনুবাদ : অধ্যাপক মাওলানা আখতার ফারুক, একাদশ খÐ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, দ্বিতীয় সংস্করণ, আগস্ট ২০১৩।
পবিত্র কোরআনুল করীম, মূল : তফসীর মাআরেফুল ক্বোরআন, হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ সাফী রহ., অনুবাদ ও সম্পাদনা : মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। খাদেমুলÑহারামাইন শরীফাইন বাদশাহ ফাহদ কোরআন মুদ্রণ প্রকল্প কর্তৃক সংরক্ষিত । পোস্ট বক্স নং-৩৫৬১ মদীনা মোনাওয়ারা।
তাফহীমুল কুরআন, ১৯শ খÐ, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী র., অনুবাদ : আবদুল মান্নান তালিব। আধুনিক প্রকাশনী, ঢাকা। ২৩তম প্রকাশ মার্চ ২০১০।
পাঠকের মতামত