তিন বছর ধরে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডাটিরিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) ও জামায়াত-শিবির হুমকি দিচ্ছিল পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারকে। ওই সময় তিনি কক্সবাজারে ছিলেন। হুমকির ব্যাপারে সদর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন তিনি। তবে বিষয়টি পুলিশের অন্য কর্মকর্তাদের খুব ভাবিত করেনি। ফলে জিডি নিয়ে তদন্ত হয়নি। পাঁচ দিন আগে তাঁর স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু চট্টগ্রামে নির্মমভাবে খুন হন। এরপর সেই জিডি ও হুমকির সূত্র ধরে অনুসন্ধান শুরু করে পুলিশ।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের দায়িত্ব নিয়ে বাবুল আক্তার জঙ্গি নির্মূলের কাজ শুরু করেন। ওই অঞ্চলে সক্রিয় আরএসওর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে নাশকতার বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেপ্তার করেন তিনি। রামু বৌদ্ধ মন্দিরে আগুনের ঘটনা ও যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর মুক্তির দাবির সূত্রে কক্সবাজারে জামায়াত-শিবির এবং আরএসওর জঙ্গিদের নাশকতার চেষ্টা তাঁর ভূমিকায় প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয় জেলা পুলিশ। জামায়াত-শিবির ও আরএসও তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়ে বাবুল আক্তারসহ সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের নাস্তিক আখ্যা দিয়ে ফেসবুকে প্রচারণা চালায়। তাঁকে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়। পুলিশ এখন সেসব খতিয়ে দেখছে।
কক্সবাজার থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) (বর্তমানে চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানার ওসি) জসিম উদ্দিন বলেন, ‘২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারে পরিকল্পনামতো তাণ্ডব চালাতে ব্যর্থ হয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার, সদর থানার অপারেশন অফিসার সাহেদ উদ্দিন ও আমাকে নাস্তিক আখ্যা দিয়ে প্রচারণা চালিয়েছিল জামায়াত-শিবির। প্রতিদিন ফোনে আমাদের হত্যার হুমকি দেওয়া হতো।’
হুমকির বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার সদর থানার অপারেশন অফিসার আবদুর রহিম জানান, বাবুল আক্তার কক্সবাজারে চাকরি করার সময় তাঁকে বিভিন্ন সময় হুমকি দেওয়া হয়েছে। হুমকিদাতাদের খুঁজে বের করতে পুলিশের বিশেষ টিম কাজ করছে।
২০১২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামুর বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। ওই ঘটনায় জামায়াত নেতা উখিয়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান শাহজালাল চৌধুরী, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান সাবেক শিবির ক্যাডার তোফায়েল আহমেদ এবং আরএসওর সাবেক প্রধান সালাহুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করেন বাবুল আক্তার। এর পর থেকে আরএসও এবং জামায়াত-শিবিরের টার্গেটে পরিণত হন তিনি।
যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচার ঠেকাতে ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারে ব্যাপক নাশকতার প্রস্তুতি নেয় জামায়াত-শিবির ও রোহিঙ্গা জঙ্গিরা। তারা কক্সবাজারকে সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা করে। কিন্তু পুলিশ বিষয়টি জেনে যায়। পরিকল্পনা অনুসারে ১৫ ফেব্রুয়ারি, সেদিন ছিল জুমাবার, নামাজ পড়ার নামে শহরের বাজারঘাটা থেকে আলিরজাহান পর্যন্ত তিন কিলোমিটার এলাকার ভেতর প্রতিটি মসজিদে অবস্থান নেয় জামায়াত-শিবির ও রোহিঙ্গারা। জুমার নামাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাণ্ডব শুরু করে তারা। তবে আগেই বাবুল আক্তারের নেতৃত্বে পুলিশ সন্দেহে থাকা মসিজদগুলোর সামনে অবস্থান নিয়েছিল। তারা প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেয়। পুলিশের পাল্টা হামলায় জামায়াত-শিবিরের তিনজন মারা যায়। জামায়াত-শিবির ও রোহিঙ্গাদের হামলায় শতাধিক পুলিশ সদস্য আহত হয়। বাবুল আক্তার গুলিবিদ্ধ হন। তবে নাশকতার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
নাশকতাকারীরা ওই বছরের ২৫ মার্চ কক্সবাজারের বিচার বিভাগীয় হাকিমের আদালতে বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি করে ১০০ জনের বিরুদ্ধে খুনের তিনটি মামলা করে। পুলিশ কর্মকর্তাদের পাশাপাশি কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান, জেলা ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের আজাদকেও আসামি করা হয়। তবে ওই দিনই হাকিম সাইফুল ইসলাম মামলাগুলো খারিজ করে দেন।
এর পর বাবুল আক্তারকে জামায়াত-শিবির নিয়ন্ত্রিত বাঁশের কেল্লা ফেসবুক পেজ থেকে হত্যার হুমকি দেওয়া শুরু হয়। হুমকি পেয়ে তিনি কক্সবাজার সদর থানায় জিডি করেন।
জানা গেছে, ২০১৩ সালে কক্সবাজারে দায়িত্ব পালনের সময় বাবুল আক্তার বেশ কয়েকবার ফোনেও হুমকি পান। তাঁর স্ত্রী মিতুকে হত্যার ঘটনার তদন্তে ওই সব হুমকির বিষয়ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
কক্সবাজারে তাণ্ডবের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে তিনটি মামলা করেছিল। সেগুলোর বিচার শুরু হয়েছে। মামলা তিনটিতে পুলিশের দাখিল করা চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ষড়যন্ত্রের নীলনকশাকারী আরএসও নেতা হাফেজ সালাহুল ইসলাম ও কক্সবাজার জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি জি এম রহিম উল্লাহ। কক্সবাজার শহরের কাছে লিংক রোড মুহুরিপাড়ায় সালাহুলের ইমাম মুসলিম (রা.) ইসলামিক সেন্টার মাদ্রাসায় এ পরিকল্পনা করা হয়। শহরে তাণ্ডব চালানোর জন্য উখিয়া ও টেকনাফের দুটি শরণার্থী শিবির থেকে রোহিঙ্গাদের ওই মাদ্রাসায় জড়ো করা হয়েছিল। ওই সব মামলার আসামিপক্ষ মিতু হত্যায় জড়িত কি না অনুসন্ধান করছে পুলিশ।
সুত্র কালের কন্ঠ
পাঠকের মতামত