ডেস্ক নিউজ
প্রকাশিত: ১২/০২/২০২৫ ১০:৪৬ এএম

আমার দেশ::
জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে জুলাই গণহত্যায় জড়িত মূল হোতাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। এই রিপোর্টটি আজ বাংলাদেশ সময় বেলা আড়াইটায় জেনেভায় অবস্থিত জাতিসংঘ কার্যালয় থেকে প্রকাশ করা হবে।

একাধিক কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, রিপোর্টে গণহত্যায় জড়িত মূল হোতাদের বিস্তারিত পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ছাত্রদের বিরুদ্ধে অপারেশন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সরাসরি ভূমিকা রেখেছেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

শেখ হাসিনা নিজেই বিক্ষোভকারীদের হত্যা ও লাশ গুম করার নির্দেশ দেন। রিপোর্টে জুলাই-আগস্ট গণহত্যায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও একাধিক মন্ত্রী এবং পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকার কথাও বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

বাংলাদেশে সংঘটিত জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের সময় মানবাধিকার লঙ্ঘনবিষয়ক এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে বলে আগেই সংস্থাটির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।

গত বছরের ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত হত্যাকাণ্ডসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং জাতিসংঘ কার্যালয়ের একাধিক সূত্র আমার দেশকে জানিয়েছে, জুলাই হত্যাকাণ্ডে ১ হাজার ৪০০-র মতো মানুষ নিহত হয়েছেন। আহতের সংখ্যা হাজার হাজার। এসব হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় তখন কার কী ভূমিকা ছিল তা সবিস্তারে তুলে ধরা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, জুলাই হত্যাকাণ্ডে তৎকালীন সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব, বিভিন্ন বাহিনীর প্রধান, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পদস্থ দায়িত্বশীল ব্যক্তি, সরকারদলীয় অস্ত্রধারীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা হত্যাকাণ্ড বা মানবাধিকর লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা সরাসরি যুক্ত ছিল। রাজনৈতিক নেতৃত্বের নির্দেশেই জুলাই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। জাতিসংঘের দৃষ্টিতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের এসব ঘটনা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো আমার দেশকে জানিয়েছে, জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনে বহুল আলোচিত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এসেছে। প্রতিবেদনে আবু সাঈদকে পুলিশের গুলি, গুলিতে শরীর থেকে রক্ত ঝরা এবং তার মৃত্যুর দৃশ্যের ছবিগুলো সন্নিবেশ করা হয়েছে। আবু সাঈদকে পুলিশ গুলি করার সময় তার কাছে কোনো অস্ত্র ছিল না, সেটিও উল্লেখ করা হয়েছে।

হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণসহ রাজধানী ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলি করে মানুষ হত্যার ঘটনা গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। ‘গুলি করার পরও মানুষ সরে যায় না’ এই বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তাদের আলাপচারিতার ভিডিও ফুটেজও যুক্ত করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে রাস্তায় দায়িত্ব পালন করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরার পাশাপাশি ছাদ থেকে শিক্ষার্থীদের ফেলে দেওয়ার ঘটনা পর্যন্ত তুলে ধরা হয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা আমার দেশ-এর সঙ্গে আলাপে বলেন, জাতিসংঘ রিপোর্টে জুলাই অভ্যুত্থানের বিবরণ তুলে ধরে বলা হয়েছে, ওই বিক্ষোভ-সমাবেশে নারী-শিশুসহ হাজার হাজার বাংলাদেশি অংশ নেয়। বিক্ষোভ দমাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি তৎকালীন সরকারের অস্ত্রধারী নেতাকর্মীদের জমায়েত করার বিষয়টি উঠে এসেছে। ওই কর্মকর্তা আরো জানান, জুলাই অভ্যুত্থানের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি ডিজিএফআই, এনএসআই, এমটিএমসি, এসবি, ডিবি, সিটিটিসির ভূমিকা কী ছিল সে বিষয়টিও বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।

উল্লেখ্য, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার উৎখাত হয়। এরপর ৮ আগস্ট প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দায়িত্ব গ্রহণ করে অন্তর্বর্তী সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত হত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো তদন্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার তুর্ককে চিঠি দিয়ে এই তদন্ত কাজে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানান।

অন্তর্বর্তী সরকারের ওই চিঠিতে সাড়া দিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান রুরি ম্যানগোভেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি অগ্রবর্তী দল গত বছরের ২২ আগস্ট থেকে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকা সফর করেন। এরপর তদন্ত করার জন্য জাতিসংঘের মূল দল তথা তথ্যানুসন্ধান দল এক মাসের বেশি সময় বাংলাদেশে অবস্থান করে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া গত জুলাই-আগস্টের মানবতাবিরোধী অপরাধ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ ১৫ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্ত করে। তদন্তের স্বার্থে সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করেছে।

গত মাসের শেষদিকে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের একটি খসড়া প্রতিবেদন বাংলাদেশ সরকারের কাছে পাঠিয়ে সে বিষয়ে সরকারের মতামত চাওয়া হয়। সরকারের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় মতামত পাওয়ার পর চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করে জাতিসংঘ মিশন।

জাতিসংঘের এই তদন্ত প্রতিবেদন তৈরির ব্যাপারে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন উৎস থেকে জুলাই গণহত্যাসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেসব তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে তা জাতিসংঘের তদন্ত কমিশনকে দেওয়া হয়েছে। সরকারের কাছ থেকে দেওয়া তথ্য-প্রমাণ, কমিশনের নিজস্ব উদ্যোগে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহসহ ভুক্তভোগী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং বিগত সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে

আলোচনার মাধ্যমে যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশে লুকিয়ে থাকা এবং পালিয়ে দেশের বাইরে অবস্থান নেওয়া আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে এবং ই-মেইলে যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের মতামত নেওয়া হয়েছে।

এই তদন্ত প্রতিবেদনের গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকায় কর্মরত জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার দেশকে বলেন, নির্ভরযোগ্য তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আমরা এই প্রতিবেদন তৈরি করেছি। প্রতিবেদনটি শতভাগ বস্তুনিষ্ঠ করতে আমরা প্রতিটি ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাই করেছি। বিভিন্ন অংশীজনের মতামতসহ আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের মতামতকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বিচারকাজ শুরু হয়েছে। বিচার প্রক্রিয়ায় এই প্রতিবেদনটি গুরুত্বপূর্ণ এভিডেন্স হিসেবে বিবেচিত হবে বলে আমরা মনে করি।

পাঠকের মতামত