সরকার সুন্দরবনের পাশে রামপালে একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে চায়। শুধু চায় না, রীতিমত বদ্ধপরিকর। কিছু বাম সংগঠন এবং সুন্দরবন রক্ষা কমিটি এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রতিবাদ করে আসছে। তাদের যুক্তি হলো, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হলে সুন্দরবনের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হবে। ইউনেসকোর পক্ষ থেকে একাধিকবার সুন্দরবন নিয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে সরকারকে চিঠি দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ ডাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোরও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সুন্দরবন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারের পক্ষ থেকে বারবার আশ্বস্ত করে বলা হচ্ছে, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে সর্বাধুনিক সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। ফলে সুন্দরবনের ক্ষতি কম হবে বা হবেই না। রামপাল বিতর্কের একটা বিষয় আমার খুব ভালো লাগছে। দুই পক্ষই যুক্তি ও তথ্য দিয়ে নিজ নিজ অবস্থান তুলে ধরছেন। যুক্তির পাল্টা যুক্তি, তথ্যের পাল্টা আরো তথ্য। পক্ষে-বিপক্ষের তথ্য-উপাত্ত, যুক্তি এত বেশি টেকনিক্যাল; আমাদের মত মূর্খ আমজনতার পক্ষে তা বোঝা মুশকিল। কয়লা ঢেকে আনা হবে না খোলা, কোন সময় বাতাস কোন দিকে বইবে, সে বাতাস কতটা কয়লা নিয়ে সুন্দরবনে যাবে, এতকিছু বোঝা সত্যি কঠিন। দুই পক্ষের যুক্তি শুনে আমি দ্বিধায় পড়ে যাই, সব যুক্তিই অকাট্য মনে হয়। তবে রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলেই রাতারাতি সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে বা সুন্দরবনে এসিড বৃষ্টি হবে এটা যেমন সত্যি নয়; তেমনি বিদ্যুৎকেন্দ্র হলেও সুন্দরবনের কোনো ক্ষতিই হবে না; এই দাবিও বিশ্বাসযোগ্য নয়। সব দেখেশুনে আমার মনে হয়েছে রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা ঠিক হবে না। এখন সরকার বলছে ক্ষতি হবে না। কিন্তু স্থাপনের পর যদি দেখা যায়, ক্ষতি হচ্ছে, তখন কী হবে? আর ক্ষতি তো হবে দীর্ঘমেয়াদী। তাই আমার দাবি হলো, বিদ্যুৎকেন্দ্র চাই, তবে অবশ্যই রামপালে নয়। দেশের অন্য যে কোনো জায়গায় হোক আপত্তি নেই। তবে দেশের যেখানেই হোক, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে পরিবেশের কিছু না কিছু ক্ষতি হবে। কিন্তু উন্নয়নের জন্য, অগ্রগতির জন্য চাই বিদ্যুৎ। তাই পরিবেশের ক্ষতি মেনে নিয়েও বিদ্যুৎকেন্দ্র করতেই হবে। চেষ্টা করতে হবে ক্ষতি যতটা কমিয়ে রাখা যায়। তবে এই কম ক্ষতির যুক্তি আমি সুন্দরবনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে রাজি নই। সুন্দরবন হলো আমাদের জন্য সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ। আর সুন্দরবন শুধু আমাদের নয়, বিশ্বের সম্পদ। তাই তো সুন্দরবন বাঁচানোর দাবি দেশে-বিদেশে সর্বত্র। আপনার টাকা থাকলে আপনি হাজার মাইল কৃত্রিম বন সৃষ্টি করতে পারবেন। কিন্তু লক্ষ কোটি টাকা দিয়েও এক টুকরো সুন্দরবন বানাতে পারবেন না। শেখ হাসিনার দেশপ্রেম নিয়েও আমার কোনো সংশয় নেই, সুলতানা কামাল-আনু মুহাম্মদের দেশপ্রেম নিয়েও কোনো প্রশ্ন নেই। সবার কাছে অনুরোধ সুন্দরবন নিয়ে বাজি ধরবেন, জেদাজেদি করবেন। আমরা যেমন উন্নয়ন চাই, বিদ্যুৎ চাই; তেমনি সুন্দরবনও চাই।
রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার অর্ধদিবস হরতাল ডেকেছিল বাম সংগঠনগুলো। বাংলাদেশে বামদের যা শক্তি তাতে তোপখানা রোড আর শাহবাগসহ রাজধানীর দুয়েকটি জায়গায় তারা তৎপরতা চালিয়েছে। অর্ধদিবস হরতাল মানে দুপুরের পরেই শেষ। কিন্তু শাহবাগে পুলিশ সকাল থেকেই মারমুখী ছিল। যেন বাংলাদেশে আর কখনো কোনো দল হরতাল করতে রাস্তায় নামেনি। রাজপথে আন্দোলনের ব্যাপারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অভিজ্ঞতা সবচেয়ে বেশি। সেই আওয়ামী লীগ আজ বামদের যৌক্তিক দাবিতে ডাকা হরতাল ঠেকাতে জলকামান, টিয়ার গ্যাস আর বর্বর পুলিশ নিয়ে মাঠে নামবে কেন? রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পক্ষের কেউ কেউ বলছেন, কোন পক্ষে লোক বেশি সেটা যাচাই করা হোক। কিন্তু একটা অন্যায্য কথা বেশি লোক বললেই সেটা ন্যায্য হয়ে যাবে না। আর ন্যায়ের পক্ষে যদি একজন লোকও থাকে, তাহলে তার কথা শুনতে হবে। এটাই ন্যায্যতার গণতন্ত্র।
মারমুখী পুলিশ শুধু হরতাল সমর্থকদের পিটিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। হরতাল সমর্থকদের পেটানোর ছবি তুলছিলেন এটিএন নিউজের ক্যামেরাপারসন আব্দুল আলিম। এ অপরাধে পুলিশ শাহবাগ থানার ভেতরে নিয়ে তাকে পেটাতে থাকে। বাধা দিতে গেলে রিপোর্টার ঈশান দিদারকেও পিটিয়েছে পুলিশ। ঈশান টেলিফোনে কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলেছে, ২০/৩০ জন পুলিশ মিলে তাদের মাটিতে ফেলে বুট ও রাইফেল দিয়ে এই দুই সাংবাদিককে বেধড়ক পিটিয়েছে। এখন তাদের ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হয়েছে। আলিমের আঘাত, ঈশানের আঘাতও কম নয়। আমাদের ক্যামেরাম্যান বা রিপোর্টার যদি বেআইনী কিছু করে থাকে, পুলিশ তাদের আটক করতে পারতো। এমনও নয় রাস্তায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মাঝখানে পড়ে তারা মার খেয়েছে। ঠাণ্ডা মাথায় থানার ভেতরে নিয়ে ২০/৩০ জন মিলে ২ জন নিরস্ত্র সাংবাদিককে বর্বরভাবে পিটিয়েছে। কেন? এই প্রশ্নের জবাব অবশ্যই দিতে হবে। আমি জানি এ নিয়ে অনেক হই চই হবে, তারপর হয়তো অভিযুক্তদের ক্লোজ করা হবে। কিন্তু লোক দেখানো ক্লোজ তো কোনো শাস্তি নয়। কয়েকদিন রেস্ট নিয়ে আবার নতুন পোস্টিং, আবার নতুন উদ্যমে চলবে মারপিট, চলবে বেআইনী কর্মকাণ্ড, চলবে বিচারবহির্ভূত ক্রসফায়ার, চলবে গুম ও গ্রেপ্তার বাণিজ্য। পুলিশ এমন করার সাহস পাচ্ছে, কারণ পুলিশ মনে করে, এ সরকারকে তারাই টিকিয়ে রেখেছে। তাই তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। দেশটাকে তারা পুলিশী রাষ্ট্র মনে করে অথবা বানাতে চায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে আইনের লোক যখন আইন নিজের হাতে তুলে নেয়, তখন সেটা অনেক বড় অপরাধ। এটা নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে। নইলে আইনশৃঙ্খলা বিশৃঙ্খলায় পরিণত হবে।
বর্তমানে দেশে পুলিশ সপ্তাহ চলছে। চারদিকে পুলিশের কত প্রশংসা, কত মেডেল। দুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী রাজারবাগে গিয়ে পুলিশকে অনেক আশ্বাস দিয়ে এসেছেন। কিন্তু পুলিশ প্রমাণ করেছে তারা বদলাবে না। বরং পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তাদের বলছি, পুলিশ সপ্তাহে পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করা এমন কাজ কারা করেছে, তাদের খুঁজে বের করে শাস্তি দিন। এই কয়েকজনের জন্য আপনারা সবাই গালি শুনবেন না। এরাই আপনাদের শত্রু, এদের শাস্তি দিলেই বাহিনীর ভাবমূর্তি ও মনোবল উজ্জ্বল হবে। এদের আড়াল করবেন না। আর সরকারকেও বলি দেশটাকে পুলিশী রাষ্ট্র বানাবেন না, সবকিছু নিজের হাতেই রাখুন, পুলিশের হাতে দেবেন না। ভাবুন তো শাহবাগের পুলিশী অ্যাকশন না হলে বামদের অর্ধদিবস হরতাল পত্রিকার সিঙ্গেল কলাম নিউজ হতো। পুলিশ সেটাকে লিড নিউজ বানিয়ে দিল। তাতে কার লাভ হলো? লাভ-ক্ষতির হিসাব সরকার কষুক। তবে লাঠি দিয়ে যে সবসময় দমন করা যায় না, এটা আশা করি আওয়ামী লীগকে শেখাতে হবে না।
কেউ ভাববেন না, সাংবাদিকদের হামলা হয়েছে বলেই আমি লিখতে বসেছি। এটা ঠিক যে দুজন মার খেয়েছে, সে দুজনই আমার সহকর্মী, ছোট ভাইয়ের মত। তাই মারটা একদম গায়ে লেগেছে। তবে আমি সবসময় রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিপক্ষে। আমি সবসময় র্যাব-পুলিশের সব ধরনের বেআইনী ও বিচার বহির্ভূত কর্মকাণ্ডের বিপক্ষে। আমি আইনের শাসন চাই, মানবিক সমাজ চাই।
প্রভাষ আমিন : সাংবাদিক, কলাম লেখক।
সুত্র : পরিবর্তন