তোফায়েল আহমদ::
বলতে গেলে বিষয়টা নিয়ে তেমন মাতামাতি হয়নি। একদম নিরবেই ঘটে গেছে একটি ছোটখাট বিপ্লব। এটি ভোটের বিপ্লব। এরকম ভোটাভুটির ঘটনাও আমাদের জন্য নতুন। গত ২৮ ডিসেম্বরের জেলা পরিষদের নির্বাচন। এই নির্বাচনে সহস্রাধিক ভোটার ছিলেন। তাদের ৯৮৭ জন ভোট দিয়েছেন এক চমৎকার নিরব পরিবেশেই। বলতে গেলে ভোটারগন সবাই কোন না কোন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী। কর্মী বলাটাও ভুল হবে। তারা সবাই তৃণমূলের রাজনৈতিক নেতা।
এমন একটি নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক ময়দানে অনেক কথা আছে। তবে অন্তত কক্সবাজার কেন্দ্রিক ক্ষমতাসীন দলের জন্য এটি বেশ ভাল ফলাফল বয়ে এনেছে বলে মনে করেন অনেকেই। কেননা নানা বিষয় এবং নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন দলীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যেও ছিল অর্ন্তদ্বন্ধ, অর্ন্তজ্বালা, কোন্দল, ব্যথা-বেদনা এবং পছন্দ-অপছন্দ। এই নির্বাচন এসব থেকে নেতৃবৃন্দকে কাছে টেনে এনে দিয়েছে।
সেই সাথে জেলা পরিষদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি নেতা এ,এইচ সালাউদ্দিন মাহমুদ প্রতিদ্বন্ধি প্রার্থী হওয়ায় ক্ষমতাসীন দলটির জন্য সবচেয়ে ভাল ফল এনে দিয়েছে। কেননা তিনি যদি প্রতিদ্বন্ধি না হতেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয় চেয়ারম্যান প্রার্থী মোস্তাক আহমদ চৌধুরীর যাওয়া হত না জেলার ৮টি উপজেলার চেয়ারম্যান-মেম্বারদের ধারেকাছে। তবে এ নির্বাচন নিয়ে সরকারি দলের জনপ্রিয়তা যাচাই করার মত এমন কিছুই ছিলনা। যেহেতু সকল দলের অংশগ্রহন ছিলনা এ নির্বাচনে।
এমনকি ভোটের উপলক্ষ ধরে জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগ থেকে স্থানীয় সাংসদদের সাথেও চেয়ারম্যান-মেম্বারদের মিলনমেলা পরষ্পরের সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটিয়েছে।২৮ ডিসেম্বরের এই নির্বাচন অনেকেরই ছোখে ছোট-খাট ব্যাপার বলে মনে হলেও বাস্তবে দলীয় রাজনীতিতে রেখেছে এটা মস্তবড় ভুমিকা।এই ভোটের অজুহাতেই জেলার গ্রাম-গ্রামান্তরে স্থানীয় সরকারের এক হাজার তিনজন জনপ্রতিনিধির সাথে কোলাকুলি হয়েছে মোস্তাক আহমদ চৌধুরী সহ জেলা আওয়ামী লীগ নেতাদের।
ওদিকে ভোটাধিকার প্রয়োগ নিয়েও উঠেছে অনেক কথা। অনেকেই বলছেন, এই নির্বাচনের ফলে তৃণমূলের ক্ষমতাসীন দলীয় নেতৃবৃন্দের সাথে একাকার হয়ে গেছেন বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াত। তবে অবাক হবার মত ঘটনাটি হচ্ছে-স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতীদের ভোট আওয়ামী লীগের ঘরে আসা। বিএনপি অন্তত দেশের স্বাধীনতাকে বিশ্বাস করে। কিন্তু জামায়াতীরা স্বাধীনতাকে বিশ্বাসও করেনা। তদুপরি একাত্তরের এমন বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে জামায়াতীরা আওয়ামী লীগকে ভোট দিল ?
এমনকি কক্সবাজার সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জিএম রহিমুল্লাহ, টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও জেলা জামায়াত নেতা নুর আহমদ আনোয়ারি, কুতুবদিয়ার উত্তর ধুরুং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও জামায়াত নেতা আ,স,ম শাহরিয়ার সহ ১৮০ জনের মত তৃণমূল জনপ্রতিনিধি জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত। জামায়াত সংশ্লিষ্ট সুত্রে এমন হিসাবটি পাওয়া গেছে। অপরদিকে কমপক্ষে ৪৫০ জনেরও বেশী তৃণমূল জনপ্রতিনিধি বিএনপি’র সাথে জড়িত রয়েছেন। বাদবাকীরা আওয়ামী লীগ সমর্থিত।
উপরের এই হিসাব মতে মোস্তাক আহমদ চৌধুরী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসাবে পাশ করার কথা নয়। জেলা পরিষদের এক হাজার তিন ভোটের মধ্যে কাষ্টিং হয় ৯৮৭ ভোট। তন্মধ্যে মোস্তাক চৌধুরী-৭৬৮ এবং সালাউদ্দিন মাহমুদ পেয়েছেন-২১৯ ভোট। বর্তমান সরকারের প্রতি ভোটারদের বিন্দুমাত্র ক্ষোভ থাকলেও বা সরকারি দলের অভ্যন্তরে অর্ন্তকোন্দল থাকলে আজ ফলাফল হবার কথা ভিন্ন। কিন্তু তা হয়নি। ২৮ ডিসেম্বরের ভোটের যে হিসাবটি তাতে মনে হয়েছে-নিরবে নিভৃতে এক মহামিলনের ঘটনা ঘটেছে। কি বিএনপি, কি জামায়াত আর কি আওয়ামী লীগ সব ভোটের স্রোতের মিলন হয়েছে মোস্তাক আহমদ চৌধুরীর আনারসে।
টেকনাফের ৮১ টি ভোটের মধ্যে সবগুলোই কাষ্টিং হয়ে পড়েছে মোস্তাক আহমদ চৌধুরীর আনারসের প্রতীকে। একারনে একজন বললেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপের কট্টর জামায়াত সমর্থিত ইউপি মেম্বার হাবিবুর রহমানের ভোটও পড়েছে আনারসে। বুথের ভিতর একাকি সীল মারেন ভোটারগন। কে কাকে দিয়েছে তা বলা মুশকিল। তবুও অন্ধকারের ভোট নিয়ে কত কথা থাকে ?
কক্সবাজারে ২০১৬ সালের এটাই মনে হয় একটা সেরা চমকের ঘটনা ছিল। এরকম ভোটের পরিবেশ দীর্ঘমেয়াদী হলে নানা কারনের এমন দুর্ভাগা দেশটির দ্রুত সফলতা আসতে বাধ্য। সেই সাথে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মধ্যে মানসিকতা সৃষ্টি হতেও বাধ্য সহনশীলতা, ভ্রাতৃত্ববোধ সর্বোপরি দেশ গড়ার ক্ষেত্রেও। ২০১৭ সাল-নববর্ষের কামনা, ২৮ ডিসেম্বরের এরকম শান্তির নির্বাচনী পরিবেশ দীর্ঘ হোক।
লেখক-তোফায়েল আহমদ, কক্সবাজারে কর্মরত দৈনিক কালের কন্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার এবং আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) ও বিবিসি’র স্ট্রিঙ্গার।