নিউজ ডেস্ক::
কাউকে না কাউকে উদ্যোগ নিয়ে দেশকে বর্তমান সংকট থেকে বের করে আনতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রম। তিনি বলেছেন, সরকারকে আরও নমনীয় হতে হবে। জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকার ফল কখনও শুভ হয় না। সরকার যদি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয়, তাহলে সমস্যাগুলোর সমাধান সহজ। একে অপরকে ঘায়েল করার মনোভাব পরিহার করতে হবে। যদি কেউ মনে করেন, ২০১৪ আর ২০১৮ একই ধরনের হবে, তাহলে তারা বড় ভুল করবেন। এবার কেউ আর কাউকে ছাড় দেবে না।
আন্দোলনের হুমকি দিয়ে ২০ দলীয় জোটের এই শীর্ষ নেতা বলেন, এবারের আন্দোলনে জ্বালাও-পোড়াও হবে না। জনগণের জানমালের কোনো ক্ষতি হবে না। তবে আন্দোলন সফল হবে।
চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আগামী নির্বাচন নিয়ে গত বৃহস্পতিবার মহাখালীর ডিওএইচএসের বাসভবনে সমকালকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে অলি আহমদ এসব কথা বলেন। আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে জোট ভাঙনের শঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন অলি আহমদ। একই সঙ্গে তিনি এও বলেছেন, বিএনপিকে বিচক্ষণতার সঙ্গে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে মূল্যায়ন জানতে চাইলে সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন দল থাকবে, মত থাকবে, ধর্ম থাকবে। ধর্ম পালনের প্রক্রিয়া পৃথক হতে পারে। কিন্তু মনুষ্যত্বের ব্যাপারে কারও ভিন্নমত থাকা উচিত নয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সমাজে ক্রমে মনুষ্যত্বের লোপ পাচ্ছে। কারও প্রতি আমরা কেউ শ্রদ্ধাশীল নই। যেন আমি যা বলব- তাই সঠিক। অন্য কারও কিছু বলার অধিকার নেই। সহনশীলতা নেই বললেই চলে। মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে আমরা একে অপরকে দোষারোপ বা ঘায়েল করতে দ্বিধাবোধ করছি না। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের মনুষ্যত্ব জাগ্রত না হয়, তত দিন পর্যন্ত এ দেশে ভালো কিছু আশা করা যায় না। জনগণের কোনো দাম নেই। ক্ষমতাই যেন সবকিছু।
তিনি বলেন, নিঃসন্দেহে আমরা সংকটের মধ্য দিয়েই যাচ্ছি এবং দিন যতই যাবে- সংকট আরও তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। আমার প্রত্যাশা থাকবে, বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আসন্ন সংকট থেকে উত্তরণের ব্যবস্থা করবেন। সংকট নিরসনে আলোচনাই উত্তম পন্থা।
ড. অলি আহমদ বলেন, বিগত কয়েক বছরে বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার রাজনৈতিক মামলা হয়েছে। আমি নিজেও হাজতে ছিলাম। বিনা কারণে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে জেলে নিক্ষেপ করা হয়েছে। এ মামলায় তিনি আদৌ কোনো দোষী নন। সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি লক্ষ্যে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়া উচিত। সব রাজনৈতিক নেতাকর্মীর মামলা প্রত্যাহার করা উচিত।
ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সবার অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কীভাবে সম্ভব- জানতে চাইলে অলি আহমদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সরকারি দল এবং বিরোধী দলের নেতারা দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। অনেকে দেশ শাসনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন এবং আছেন। সময় এসেছে নিজের ব্যক্তিগত এবং দলের স্বার্থ না দেখে জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার। তাহলে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন এ দেশের জনগণকে মুক্তি দিতে পারে এবং এতে সব অনিশ্চয়তা কেটে যাবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরি হবে।
এলডিপির সভাপতি বলেন, সবার অংশগ্রহণে নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনই এখন দেশবাসীর প্রত্যাশা। এক্ষেত্রে সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে নির্বাচনের তিন মাস আগে বর্তমান সংসদ ভেঙে দেওয়া; নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শক্রমে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকালীন সরকার গঠন; নির্বাচন কমিশনকে ঢেলে সাজানো এবং সর্বোপরি প্রশাসনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করা জরুরি।
সরকারি দলের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে বলা হচ্ছে, নির্বাচনের আগে কোনো সংলাপের প্রয়োজন নেই। সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে নির্বাচন হবে। নির্বাচনে কে আসবে বা কে না আসবে- সেটা তাদের দেখার বিষয় নয়? এ ব্যাপারে অলি আহমদ বলেন, সরকারকে আরও নমনীয় হতে হবে। তাদের কর্মকাণ্ডে জনগণের আশা-আশাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। জনবিচ্ছিন্ন হলে চলবে না। জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকার ফল কখনও শুভ হয় না। 'বিকাশ' এমপির মাধ্যমে জনগণের আশা-আশাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে না এবং এতে জনসমর্থনও থাকবে না। দেশ পরিচালনা করার জন্য জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি প্রয়োজন। বিনা ভোটে নির্বাচিতদের কোনো দায়-দায়িত্ব থাকে না।
সরকার যদি ২০ দলীয় জোটের দাবি না মানে তাহলে কী করবেন- নির্বাচন বর্জন, নাকি প্রতিহত করতে আন্দোলনে নামবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির সাবেক জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বলেন, ইতিমধ্যে পত্রপত্রিকায় দেখেছেন যে, সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যুগপৎ আন্দোলনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। সরকারের পক্ষে খুব সহজে এ সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় নেই। বিরোধী দলগুলো যুগপৎভাবে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সক্রিয়ভাবে মাঠে নামার প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। এর উদ্দেশ্য একটাই- ন্যায্য দাবি মানতে সরকারকে বাধ্য করা।
বিকল্পধারার চেয়ারম্যান অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে 'বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য' গড়ার উদ্যোগ সম্পর্কে ২০ দলীয় জোটের শীর্ষস্থানীয় এ নেতা বলেন, তিনি মনে করেন, অনেকে আলাদা নির্বাচনে গেলে তাদের পক্ষে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আসা সম্ভবপর নাও হতে পারে। এ ছাড়া সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য এ ধরনের ঐক্যের বিকল্প নেই।
কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ের মতো সাংগঠনিক শক্তি বিএনপি, ২০ দলীয় জোট এবং সম্ভাব্য বৃহত্তর ঐক্য জোটের কি আছে- জানতে চাইলে অলি আহমদ বলেন, অবশ্যই সেই শক্তি আছে। জনগণই তাদের দাবি আদায়ের জন্য মাঠে নামবে।
কবে নাগাদ যুগপৎ আন্দোলনে যাবেন- জানতে চাইলে জোটের শীর্ষ এ নেতা বলেন, এ বিষয়গুলো নিয়ে আরও বিশদভাবে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে আন্দোলনের সঠিক সময় নির্ধারণ করতে হবে। তবে এবারের আন্দোলনে জ্বালাও-পোড়াও হবে না। জনগণের জানমালের কোনো ক্ষতি হবে না। সরকার যদি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয়- তাহলে সমস্যাগুলোর সমাধান সহজ। একে-অন্যকে ঘায়েল করার মনোভাব পরিহার করতে হবে।
শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায় সম্ভব হবে কি-না- জানতে চাইলে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী অলি আহমদ বলেন, একেবারেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন হবে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে পৃথিবীতে অনেক বড় বড় দাবি-দাওয়া অর্জন হয়েছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনও শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছিল।
সরকারি দল ও বিরোধী দলের নেতারা তো হুমকি-পাল্টা হুমকি দিয়ে কথা বলছেন? নির্বাচন ঘনিয়ে এলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে কি-না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আমাদের সবাইকে উস্কানিমূলক এবং অশালীন বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
দল ও জোটের ভাঙনের শঙ্কা ব্যক্ত করে ২০ দলীয় জোট নেত্রী খালেদা জিয়া কারাগার থেকে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন। এ ব্যাপারে জোটের অন্যতম শরিক এলডিপির সভাপতি বলেন, জোট ভাঙনের কথা কেউ উচ্চারণ করেছেন বা বলেছেন- এ কথা তার জানা নেই। এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো আলামত তিনি দেখেননি। তবে বিএনপিকে বিচক্ষণতার সঙ্গে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের টেলিফোন করা নিয়ে গুঞ্জন সম্পর্কে প্রশ্ন করলে অলি আহমদ বলেন, আমরা রাজনীতি করি, সুতরাং একজন আরেকজনকে টেলিফোন করতেই পারি। বরং না করাটাই অবাস্তব। রাজনীতিতে ভিন্নমত ও পথ থাকতে পারে- তবে মনুষ্যত্ব লোপ পাওয়া ঠিক না। তা ছাড়া ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে আগেও বহুবার কথা হয়েছে, এটা প্রথম নয়। তবে নির্বাচনে যাওয়া-না যাওয়া, জোট ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে কোনো আলাপ হয়নি। সুত্র: সমকাল