বিশ্ববাজারের সঙ্গে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করতে সরকারের যে নতুন ফর্মুলা কার্যকর করার কথা সেটি হচ্ছে না। সমন্বয় করতে গেলে এই মুহূর্তে দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য অনেক বেড়ে যাবে। যে কারণে এই ইস্যুতে সরকার আগের অবস্থান থেকে সরে আসছে। পাশাপাশি মূল্য সমন্বয়ের নতুন ফর্মুলা কার্যকর হলে যে পরিস্থিতি দাঁড়াবে তা প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করা হয়েছে।
একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়কে। কারণ আইএমএফ’র শর্ত অনুযায়ী ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের আগে কার্যকর ফর্মুলায় জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ের কথা ছিল।
এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে ফের বেড়েছে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম। রাশিয়া ও সৌদি আরব জ্বালানি তেলের সরবরাহ আরও কমানোর ঘোষণা দেওয়ায় বাজার ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠেছে। প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেল বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৯৭ মার্কিন ডলার। এ দাম আরও বাড়ার পূর্বাভাসও দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো।
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সোমবার যুগান্তরকে জানান, জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ের জন্য নতুন ফর্মুলা এই মুহূর্তে কার্যকর করা হচ্ছে না। এটি আইএমএফ’র শর্ত ছিল দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মন্ত্রী বলেন, শর্ত থাকলে থাকবে, তবে সম্ভব নয়। সম্ভব না হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন বিশ্ববাজারে মূল্য অনেক বেশি। এই মুহূর্তে নতুন ফর্মুলা অনুযায়ী জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করা হলে দেশের বাজারে দাম অনেক বেড়ে যাবে। আইএমএফ সেটি মানবে কিনা যোগ করলে মন্ত্রী বলেন, সংস্থাটি না মানলে আমার দেখার বিষয় নয়। ঋণটি আমি নেইনি, নিয়েছে সেন্ট্রাল ব্যাংক। সেটি সেন্টাল ব্যাংক বুঝবে।
যোগাযোগ করা হলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ে নতুন ফর্মুলা কার্যকর আইএমএফ’র ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের আগেই বাস্তবায়নের কথা ছিল। প্রথম হচ্ছে ফর্মুলাটি প্রণয়ন এবং দ্বিতীয় হচ্ছে এর বাস্তবায়ন। এখানে তিন মাস অন্তর, না প্রতিমাসে সমন্বয় হবে সেটি সেখানে উল্লেখ থাকতে হবে।
আইএমএফ সরকারের অবস্থান জানতে পারলে হয়তো বলতে পারে ফর্মুলাটি চূড়ান্ত করার জন্য। আর এজন্য একটি সরকারের নির্দেশনা থাকতে হবে অর্থাৎ গেজেট জারি করা। ফর্মুলা যদি গত তিন মাসের মূল্য নিয়ে গড় করে, তাহলে বিশ্ববাজারে গত তিন মাসে মূল্য কম ছিল। সম্প্রতি এটি বেড়েছে। সেক্ষেত্রে যেভাবে বাড়ার আশঙ্কা সেটি হওয়ার কথা নয়।
আগামী অক্টোবরে আইএমএফ’র একটি প্রতিনিধিদল ঢাকা সফরে আসছে। এ দলটির কাজ ঋণের শর্তের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা। কারণ নভেম্বরে আইএমএফ ঋণের দ্বিতীয় ছাড় করা হবে। এর আগে সংস্থার পক্ষ থেকে যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে তা কতটুকু পরিপালন করা হয়েছে সেটি পর্যবেক্ষণ করা হবে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণের বিপরীতে আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছে, তার একটি হচ্ছে জ্বালানি তেলের ওপর থেকে ভর্তুকি কমিয়ে আনা। জ্বালানির মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া। এতে জ্বালানি তেলে ভর্তুকি দেওয়ার প্রবণতা কমে আসবে। এর আগে গত মে মাসে আইএমএফ প্রতিনিধিদল জ্বালানি বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করে মূল্য সমন্বয় করার তাগিদও দিয়ে গেছে।
এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত বিদ্যুৎ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, আইএমএফ’র শর্ত অনুযায়ী জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করতে নতুন ফর্মুলা প্রণয়ন করা হয়েছে। সেখানে মাসিক মূল্য সমন্বয়ের পাশাপাশি সাপ্তাহিক ভিত্তিতে করার চিন্তা করছে সরকার। কারণ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রতি সপ্তাহে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করা হয়। সে ফর্মুলা কার্যকর করতে বিপিসিকে একটি চিঠি দিয়েছে মন্ত্রণালয় থেকে। সেখানে বিদ্যমান ব্যবস্থায় জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে সার্ভিস চার্জ ৫ শতাংশ এবং ৫ শতাংশ কল্যাণ চার্জ নেওয়া হচ্ছে, সেটি প্রত্যাহার করতে বলা হয়।
এছাড়া পর্যালোচনা করে আরও দেখা গেছে, প্রতি লিটার ডিজেল বিক্রিতে ৯ টাকা লোকসান এবং অকটেনে মুনাফা হচ্ছে ১৬ টাকা। এখানে আয় ও লোকসান সমন্বয় করার সিদ্ধান্ত। কিন্তু বর্তমানে বিশ্ববাজারে যেভাবে দাম বাড়ছে, এই ফর্মুলা অনুযায়ী সমন্বয় হলে দেশের বাজারে আরও বেশি বাড়বে। কিন্তু এরই মধ্যে জাতীয় নির্বাচন চলে আসছে। ফলে এই মুহূর্তে সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়াতে চাচ্ছে না।
যে কারণে নতুন ফর্মুলায় কার্যকর করা থেকে মন্ত্রণালয় সরে আসছে। এর আগে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কম দামে তেল কিনে বেশি দামে বিক্রি করে গত পাঁচ বছরে বিপিসি ৪৬ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে। বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়লে দেশে বাড়ে। কিন্তু কমলে কমে না। বর্তমানে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ১০৯ টাকা। এছাড়া লিটারপ্রতি কেরোসিন ১০৯ টাকা, অকটেন ১৩০ টাকা এবং পেট্রোলের দাম ১২৫ টাকা।
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে ব্যবহৃত মোট জ্বালানি তেলের ৭৩ দশমিক ১১ শতাংশ ডিজেল, পেট্রোল ৫ দশমিক ৮৬ এবং অকটেন ৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ। বর্তমানে দেশে বছরে জ্বালানি তেলের চাহিদা রয়েছে ৭০ থেকে ৭২ লাখ টন। এর মধ্যে ডিজেলের চাহিদা ৪৮ থেকে ৪৯ লাখ টন, যার ৮০ শতাংশ সরকার আমদানি করে।
বর্তমানে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি হচ্ছে। আর পরিশোধিত তেল আমদানি হয় সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, আরব আমিরাত, কুয়েত, থাইল্যান্ড ও ভারত থেকে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর সাশ্রয়ী দামে ভারত থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে ডিজেল আমদানি হচ্ছে।