ডেস্ক রিপোর্ট ::
সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে দেশের বিদ্যুৎ খাতে। কক্সবাজারের টেকনাফে চালু হয়েছে দেশের প্রথম সোলার পার্ক, যেখান থেকে প্রথমবারের মতো জাতীয় সঞ্চালন গ্রিডে যোগ হয়েছে সৌরবিদ্যুৎ। ২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার এ সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাস্তবায়ন করেছে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী (আইপিপি) প্রতিষ্ঠান জুলস পাওয়ার লিমিটেড (জেপিএল)। টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন শ্রেণীর গ্রাহকের মোট বিদ্যুৎ চাহিদার ৮০ শতাংশই সরবরাহ হবে এই সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে।
বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা-২০১০ অনুযায়ী, স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিকালে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৪ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ২ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০২১ সালের মধ্যে ২ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ধরা হয়েছে ১ হাজার ৪৭০ মেগাওয়াট।
জানা গেছে, নবায়নযোগ্য জ্বালানির সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এরই মধ্যে নেয়া হয়েছে বিভিন্ন প্রকল্প। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি), টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা) এবং ব্যক্তি খাতের বিভিন্ন কোম্পানির আওতায় নির্মাণাধীন রয়েছে ৩৪টির মতো সোলার পার্ক বা সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প। এসব প্রকল্পেরই একটি কক্সবাজারের টেকনাফে জুলস পাওয়ার লিমিটেডের ২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার সোলার পার্ক।
প্রকল্পটি সম্পর্কে জুলস পাওয়ারের পরিচালক (পরিচালন) রায়ান মঈন বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের যে প্রভাব, তা মোকাবেলায় ক্লিন এনার্জির মাধ্যমে দেশের পাশে দাঁড়াতে পারা খুবই আনন্দের ও গর্বের। সোলার পার্কের প্রথম প্রকল্প হিসেবে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাস্তবায়নে আমাদের অনেক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে হয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালার জটিলতাসহ নানা সমস্যা ছিল। তবে সরকারের আন্তরিকতায় প্রকল্পটি দ্রুততার সঙ্গেই শেষ করা গেছে। ভবিষ্যতে নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক প্রকল্পে জুলস পাওয়ার আরো বিনিয়োগে আগ্রহী এবং পরবর্তী সময়ে অন্য যারা এ খাতে বিনিয়োগ করতে আসবেন, এ সফলতা তাদের জন্য কাজটিকে আরো সহজ করে দেবে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে গত বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি জেপিএলের সঙ্গে বিপিডিবির চুক্তি হয়। এর মাত্র ১৮ মাসের মধ্যে প্রকল্পটি সম্পন্ন হয়। দেশের প্রথম সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র হিসেবে চলতি মাসের ১১ তারিখ থেকে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করেছে জেপিএলের টেকনাফ সোলার পার্ক। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ কিনে জাতীয় সঞ্চালন গ্রিডের মাধ্যমে গ্রাহকের কাছে সরবরাহ করবে।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী খালেদ মাহমুদ বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের অনেক প্রকল্প রয়েছে, যা চালু হচ্ছে হচ্ছে করেও চালু করা যাচ্ছে না। তবে এর মধ্যে এ প্রকল্পটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করেছে। গত বৃহস্পতিবার থেকে তারা প্রথমবারের মতো জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ দেয়া শুরু করেছে।
টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের আলীখালী এলাকায় যুক্তরাজ্যের প্রোইনসোর সঙ্গে যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে জুলস পাওয়ার লিমিটেড। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ইপিসি সেবা দিয়েছে টেকনাফ সোলারটেক এনার্জি লিমিটেড (টিসিইএল)।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, কেন্দ্রটি থেকে বছরে ৪৩ হাজার মেগাওয়াট আওয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে টেকনাফের মোট চাহিদার ৮০ শতাংশ সরবরাহ করা যাবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির মাধ্যমে আগামী ২০ বছর চার লাখ টন কার্বন নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্র। প্রকল্পটিতে অর্থায়ন করেছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক বাংলাদেশ ও ওয়ান ব্যাংক লিমিটেড।
এ বিষয়ে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নাসের এজাজ বিজয় বলেন, এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র এটিই প্রথম। যারা এ প্রকল্পের স্পন্সর ও যারা বাস্তবায়ন করেছে, তাদের আমি ধন্যবাদ দিতে চাই। কারণ এটি একটি ইনোভেটিভ কাজ এবং এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশেষ মাইন্ডসেট দরকার হয়।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের আলীখালী এলাকায় কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের পূর্ব পাশে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির অবস্থান। নাফ নদীর তীরে সারি করে বসানো হয়েছে ৮৭ হাজার সৌর প্যানেল। এ প্যানেলগুলোর মাঝখানে রয়েছে পাঁচটি সাবস্টেশন। একই সঙ্গে প্রকল্পে যাতায়াতের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে কয়েকটি রাস্তাও। কর্তৃপক্ষ জানায়, এসব সৌর প্যানেল থেকে উৎপাদিত ২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রথমে মূল স্টেশনে রাখা হয়। পরে হ্নীলা ইউনিয়নের লেদায় অবস্থিত পল্লী বিদ্যুতের সাবস্টেশনে সরবরাহ করা হবে।
টেকনাফে দেশের প্রথম সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু হওয়ার ঘটনায় বেশ উচ্ছ্বসিত স্থানীয় বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিরা। এর মধ্যদিয়ে সেখানে লোডশেডিং পরিস্থিতির উন্নয়ন হবে বলে প্রত্যাশা তাদের।
এ প্রসঙ্গে টেকনাফ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাফর আলম বলেন, টেকনাফ উপজেলাটি মূলত বাণিজ্যিক এলাকা। এ উপজেলায় রয়েছে একটি স্থলবন্দরও। যার কারণে টেকনাফে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রয়োজন। কিন্তু সব সময় তা পাওয়া যাচ্ছে না। এ কেন্দ্রটি টেকনাফ উপজেলায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। দূর হবে দীর্ঘদিনের লোডশেডিং সমস্যাটি।
টেকনাফ পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মিনারুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘লো-ভোল্টেজের কারণে দীর্ঘদিন ধরে টেকনাফে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে রাখতে হতো। সোলারটেক এনার্জি প্রকল্পটি চালু হওয়ার পর এ সমস্যাটি এখন আর নেই।’
প্রসঙ্গত, সোলার হোম সিস্টেম (এসএইচএস) বা আবাসিক ঘরবাড়ির ছাদে সোলার প্যানেল স্থাপনে অসামান্য অগ্রগতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে এখন পর্যন্ত বিতরণ লাইনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পৌঁছানো যায়নি, এমন এলাকায় ৫৩ লাখ সোলার প্যানেল স্থাপন করা হয়েছে। সূর্যের আলো ব্যবহার করে এসব সোলার প্যানেল থেকে দৈনিক উৎপাদন হচ্ছে ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। তবে এ প্রথম টেকনাফ থেকে সূর্যের আলো দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন শেষে তা জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ শুরু হয়েছে।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বলেন, দুয়েকদিনের মধ্যে পরীক্ষামূলক অপারেশন শেষ হবে। পরে বাণিজ্যিকভাবে চালুর তারিখ নির্ধারণ করা হবে। ২০ মেগাওয়াটের এ প্রকল্পটি সোলার পাওয়ার হিসেবে একটি বড় প্রকল্প। তাই এটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন প্রধানমন্ত্রীর হাত দিয়ে হবে।
পাঠকের মতামত