সীমান্তে উত্তেজনার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে কিছুটা ফাটল ধরেছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের সময় বাংলাদেশেও কয়েক দফায় এসে পড়েছে মর্টার শেল, আকাশসীমা লঙ্ঘনের ঘটনাও ঘটেছে কয়েক দফায়। মিয়ানমার ইস্যুতে সঙ্গে যোগ হয়েছে নাব্যতা সংকট। এতে চলতি বছর টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে পর্যটন জাহাজ চলাচল বন্ধ রেখেছে সরকার। সেন্টমার্টিনে পর্যটক যাতায়াত স্বাভাবিক রাখতে এজন্য বিকল্প রুট খুঁজছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।
জানা গিয়েছে, প্রতি বছর উত্তাল সাগরের কারণে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনগামী জাহাজের চলাচল বন্ধ রাখা হয়। অক্টোবর থেকে ফের জাহাজ চলাচলের অনুমতি দেয় প্রশাসন। কিন্তু চলতি বছর চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার থেকে পর্যটনগামী জাহাজ চলাচলের অনুমতি দেয়া হলেও টেকনাফ থেকে জাহাজ চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়নি। মূলত মিয়ানমারের সঙ্গে সাম্প্রতিক বৈরী সম্পর্কের কারণে টেকনাফ থেকে সরাসরি জাহাজ চলাচলের অনুমতি দেয়া হচ্ছে না।
সর্বশেষ গত ২৭ সেপ্টেম্বর সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটক যাতায়াতের বিষয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে সবগুলো সংস্থাই নাফ নদীর নাব্যতা সংকটের কারণে এ রুটে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচলের বিষয়ে আপত্তি তোলে। তবে টেকনাফ উপজেলা প্রশাসনসহ বেশ কয়েকটি স্থানীয় সংস্থা জীবন-জীবিকার স্বার্থে পর্যটকদের সেন্টমার্টিনে প্রবেশের বিকল্প পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানানো হয়। বৈঠকে নাব্যতা সংকটের কারণে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটের জাহাজ চলাচল বন্ধ রেখে শুধু চট্টগ্রাম-সেন্টমার্টিন ও কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন রুটের জাহাজ চলাচল উন্মুক্ত করতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নাব্যতার কারণে জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও ওই বৈঠকে এ-সংক্রান্ত সরকারি সংস্থা বিআইডব্লিউটিএ উপস্থিত ছিল না।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক, চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার, পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান, টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, এনএসআই ও ডিজিএফআই ও বিজিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। বৈঠকে বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে সেন্টমার্টিনে পর্যটক সমাগম সীমিত রাখার কথা বলা হয়। এক্ষেত্রে সেন্টমার্টিন দ্বীপে বসবাসকারী অধিবাসীদের জীবন-জীবিকা পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল থাকায় শুধু তিন-চার মাসের শীতকালীন মৌসুমে বিকল্প উৎস দিয়ে হলেও পর্যটক চলাচল চালু করার বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়।
জানতে চাইলে সী ক্রুজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি তোফায়েল আহম্মেদ বণিক বার্তাকে বলেন, রাষ্ট্রীয় সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে, নাব্যতা সংকটের কারণে টেকনাফ থেকে সরাসরি সেন্টমার্টিন পর্যন্ত জাহাজ বন্ধ রয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে সপ্তাহে মাত্র একদিন ও কক্সবাজার থেকে প্রতিদিন একটি করে জাহাজ সেন্টমার্টিনে পর্যটক নিয়ে যায়। কিন্তু সেন্টমার্টিনের পর্যটনকে কেন্দ্র করে সার্বিকভাবে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের জীবিকা নির্ভর করে। এজন্য আমরা টেকনাফের বর্তমান ঘাট বাদ দিয়ে অর্থাৎ নাফ নদী বাদে সাবরাং এক্সক্লুসিভ জোনের ভেতর দিয়ে বন্ধ জাহাজগুলো চলাচলের অনুমতি চেয়েছি। এরই মধ্যে সরকারি সবগুলো সংস্থার কাছে আমাদের প্রস্তাবটি পাঠানো হয়েছে। আশা করি শিগগিরই এ বিষয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।
বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গিয়েছে, নাব্যতা সংকটের কারণে নাফ নদী দিয়ে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটের জাহাজ চলাচল বন্ধ রয়েছে। এ রুটে প্রতিদিন ১০টি জাহাজ সেন্টমার্টিনে পর্যটক নিয়ে ফিরে আসে। এসব জাহাজের বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ ছাড়াও সেন্টমার্টিনের মানুষের জীবন-জীবিকার স্বার্থে বিকল্প রুট দিয়ে এ জাহাজগুলো চালানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে টুয়াকের পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে। শিগগিরই এ-সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।
বিআইডব্লিউটিএ ও ক্রুজ অ্যাসোসিয়েশন সূত্র বলছে, প্রতি বছরের ১ নভেম্বর থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে ১০টি জাহাজে প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার পর্যটক ভ্রমণ করে। সাম্প্রতিক ঘটনায় চলতি শীত মৌসুমে টেকনাফ থেকে জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকায় ১১ অক্টোবর বিআইডব্লিউটিএর কাছে বিকল্প রুটের মাধ্যমে পর্যটনবাহী জাহাজ চলাচলের আবেদন করে সী ক্রুজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ অক্টোবর নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে পত্র দেয় বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক। চিঠিতে সী ক্রুজ অ্যাসোসিয়েশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে টেকনাফের মেরিন ড্রাইভের শেষ অংশে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) কর্তৃক নির্মাণাধীন সাবরাং পর্যটন এক্সক্লুসিভ জোনের অভ্যন্তরে অস্থায়ী জেটি নির্মাণ সাপেক্ষে বন্ধ পর্যটন জাহাজগুলো চলাচলের বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বণিক বার্তাকে বলেন, নাব্যতা সংকটসহ সরকারি সিদ্ধান্তের কারণে টেকনাফ থেকে সরাসরি সেন্টমার্টিনে জাহাজ চলাচল বন্ধ রয়েছে। সরকারের সবগুলো সংস্থার সমন্বয়ে নেয়া এ সিদ্ধান্ত মেনে শুধু চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত পর্যটক পরিবহন করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত বিকল্প ঘাট দিয়ে বন্ধ জাহাজগুলো চালানোর সিদ্ধান্ত হয়নি। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত এলে আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গিয়েছে, নাব্যতা কম থাকার কারণে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত জাহাজ চলাচল করতে অন্তত পাঁচ কিলোমিটার পথ মিয়ানমারের সীমান্ত ঘেঁষা নাফ নদী দিয়ে চলাচল করতে হয়। এর আগে মিয়ানমারের সঙ্গে আন্তঃদেশীয় সম্পর্ক ভালো থাকায় জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে মিয়ানমারের কোনো আপত্তি ছিল না। বর্তমানে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণে নাফ নদী দিয়ে জাহাজ চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত টেকনাফ থেকে সরাসরি সেন্টমার্টিনে জাহাজ চলাচল সম্ভব নয়। এজন্য মেরিন ড্রাইভের শেষ অংশ থেকে জেটি নির্মাণের মাধ্যমে সেন্টমার্টিনে পর্যটক চলাচল করার পরিকল্পনা করছে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ। সুত্র: বণিক বার্তা