আবারও বেড়েছে রডের দাম। এক সপ্তাহের ব্যবধানে টনপ্রতি বেড়েছে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত। সোমবার (২২ আগস্ট) কোম্পানির মানভেদে (৬০ গ্রেডের ওপরে) খুচরায় প্রতি টন রড বিক্রি হচ্ছে ৯১ থেকে ৯৬ হাজার টাকা পর্যন্ত। যা গত সপ্তাহে টনপ্রতি তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত কম ছিল।
রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলছেন, ডলার সংকট, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, রড তৈরির কাঁচামাল স্ক্র্যাপের দাম বিশ্ববাজারে বেড়ে যাওয়া এবং জাহাজ আমদানি কমে যাওয়ায় দেশে রডের দাম বেড়েছে।
তবে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কর্মকর্তারা বলছেন, সিন্ডিকেটের কারসাজির কারণে দফায় দফায় বাড়ছে রডের দাম। গত চার মাসে তিনবার রডের দাম বাড়িয়েছে কোম্পানিগুলো।
এদিকে, অস্বাভাবিকহারে রডের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন বাড়ি নির্মাণকারী, আবাসন ব্যবসায়ী ও সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো।
নগরীর ষোলশহরের পাইকারি রড বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান আলমার্স ট্রেডিংয়ের মালিক ইমাম হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সোমবার বিএসআরএম স্টিলসের রড মিলগেটে প্রতি টন বিক্রি হচ্ছে ৯৩ হাজার টাকা, কেএসআরএম রডের টন বিক্রি হচ্ছে ৯০ হাজার টাকা, বায়েজিদ স্টিলের রডের টন বিক্রি হচ্ছে ৮৯ হাজার টাকা এবং অন্যান্য কোম্পানির রডের টন প্রায় এক থেকে দুই হাজার টাকা কম-বেশিতে বিক্রি হচ্ছে। তবে খুচরা ব্যবসায়ীরা মিলগেট থেকে নিজ খরচে পরিবহন করে নিয়ে যান। সেক্ষেত্রে প্রতি টনের দাম দুই থেকে তিন হাজার টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করেন তারা।’
তিনি আরও বলেন, ‘রডের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় আমাদের বিক্রি কমেছে। আগে প্রতি মাসে ৫০ থেকে ৬০ টন রড বিক্রি হতো। বর্তমানে ২০ থেকে ৩০ টন রড বিক্রি হয়। দিন দিন দাম যত বাড়ছে রড বিক্রি তত কমছে।’
রাউজান উপজেলার পাহাড়তলী চৌমুহনী বাজারে খুচরায় রড-সিমেন্ট বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান আল মদিনা ট্রেডার্সের মালিক জি এম মোস্তফা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বর্তমানে বিএসআরএম রডের টন ৯৫ থেকে ৯৬ হাজার, কেএসআরএম ৯৩ হাজার ও বায়েজিদ স্টিলের রড ৯১ হাজার টাকায় বিক্রি করছি। এক সপ্তাহের ব্যবধানে রডের টনপ্রতি তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম বাড়িয়েছে কোম্পানিগুলো।’
রড নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম’র সিনিয়র জিএম (বিক্রয় ও বিপণন) মো. জসিম উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নানা কারণে রডের দাম বেড়েছে। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হলো ডলার সংকট। এ কারণে ব্যাংকে এলসি খোলা যাচ্ছে না। তিন-চার মাস আগে ব্যাংকে যেসব এলসি খোলা হয়েছিল, তখন ডলারের দাম ছিল ৮৬ থেকে ৮৭ টাকা। ওই এলসির অনুকূলে এখন ব্যাংকগুলোকে পরিশোধ করতে হচ্ছে ১১০ টাকা হারে। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রতি ডলারে ২৫ টাকা করে বাড়তি গুনতে হচ্ছে আমদানিকারকদের। তার ওপর তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় দ্বিগুণ হয়েছে জাহাজ ভাড়া। বেড়েছে উৎপাদন ব্যয়। পাশাপাশি শিপ ব্রেকার্সগুলোতে রডের কাঁচামাল সংকট রয়েছে। কমেছে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি। ইয়ার্ডে প্রতি টন স্ক্র্যাপ কিনতে হচ্ছে ৬৫ হাজার টাকায়। জাহাজের প্লেট কিনতে হচ্ছে ৮০ হাজার টাকায়। এসব কারণে বেড়েছে রডের দাম।’
রড নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম’র উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেন গুপ্ত বলেন, ‘ডলার, জ্বালানি তেল এবং স্ক্র্যাপের দাম বাড়ায় রডের দাম বেড়েছে। আমদানি খরচ কিংবা কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়াতে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। ফলে রডের বাজারে প্রভাব পড়েছে।’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দাম বৃদ্ধির বিষয়টি সামাজিক সংক্রমণ হয়ে উঠেছে। কার আগে কে দাম বাড়াবে এ ধরনের প্রতিযোগিতা চলছে। রডের দাম অস্বাভাবিকহারে বাড়ানো অযৌক্তিক। প্রথমে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব ও কাঁচামাল সংকট বলে রডের দাম বাড়ানো হলো। এরপর জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধির অজুহাতে রডের দাম আরেক দফায় বাড়ানো হলো। এখন জ্বালানি তেল ও ডলার সংকটের কথা বলে আরেক দফায় বাড়ানো হলো। জ্বালানি তেলের সঙ্গে রডের কি সম্পর্ক আছে তা বুঝতে পারলাম না। দায়িত্বশীলদের নজরদারির অভাবে নিজেদের ইচ্ছে মতো রডের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে নির্মাণকাজে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে।’
লাগামহীন রডের দামে নির্মাণকাজ কমেছে জানিয়ে চট্টগ্রাম সম্মিলিত ঠিকাদার ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান টিটু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি এলজিইডির ঠিকাদার হিসেবে বহু বছর ধরে কাজ করছি। এখন নির্মাণসামগ্রীর দাম অতীতের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। ৪০৬ টাকার সিমেন্ট এখন বিক্রি হচ্ছে ৫১০ টাকায়, টন বিক্রি হয়েছে ৯৩-৯৫ হাজার টাকায়। এখন ঠিকাদারি কাজ করে চলা যাচ্ছে না। নির্মাণকাজ কাজ কমেছে। লোকসান গুনতে হচ্ছে। এলজিইডির অধীনে ১৫ উপজেলার মধ্যে প্রায় হাজার কোটি টাকার কাজ চলমান। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ কাজই বন্ধ রয়েছে। সম্প্রতি এলজিইডি থেকে আগের দাম থেকে ১৭ শতাংশ বাড়িয়ে শিডিউল দিয়েছে। এই শিডিউল রডের বাজারের সঙ্গে বাস্তবসম্মত নয়, তবু কাজ চালিয়ে নিচ্ছি। সুত্র: বাংলাট্রিবিউন