আদিল চৌধুরী::
মানব হৃদয়ে কবিতার উন্মেষ কখন হয়? হৃদয়ের গোলাব কখন ফুটে? হৃদয় গোলাব ফোঁটার সাথে কবিতার উদ্ভূত একটি সম্পর্ক আছে বলেন ভুক্তভোগীরা। সৃষ্টির আদি হতে এ পর্যন্ত কবিকূল সুখকে গোলাবের মত কল্পনা করেছেন। গোলাব সুখ তূল্য। সুখ গোলাব তূল্য। কবির কূল সুখ রূপী গোলাবকে কল্পনায় ধরতে চেয়ে থাকেন। বাস্তবে কিংবা কল্পনায় সুখ রূপী সে গোলাব অধঁরাই থেকে যায়। অধঁরা থাকার বেদনার কাছে কবিকুল নিজেকে সমর্পন করেন। এটিই বাস্তবতা। এই না পাওয়ার বেদনা নিয়ে কবিরা সামনে অগ্রসর হন।
কবি কবীর আহমদ, কবি কল্পনার অধঁরা সুখকে- সেই পুরানো নিয়মেই গোলাব ফুলের মতই কল্পনা করেছেন সম্ভবত। সুখকে ফুটন্ত টকটকে লাল গোলাবের মত দেখছেন কবি কবীর আহমদ। কবি গোলাব গাছের কাঁটার কথা ভাবতে নারাজ। এ কারণে বার বার ধাক্কা খেয়েছেন পরিস্থিতির কাছে। কাঁটার আঘাতে রক্তাক্ত হয়েছে হাত। কবির কাছে গোলাব অধঁরা রয়েই গেছে। গোলাব ধরতে না পারার বেদনাই কবি কবীর আহমদের কাব্য- কবিতায় মহত্ব ছড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করি। আমার একটি কবিতা দিয়ে কবি কবীর আহমদের মানস ভুবনের পর্দা উন্মোচনের চেষ্টা করব-
বসন্ত এসে গেলেই কিবা লাভ
বাগানের মাটি যদি হয় কঠিন পাথর
পাথুরে মাটিতে গোলাবের চাষ হয়!
কোথায় শুনেছ তুমি?
গোলাবের বাগান বানাবে তুমি?
পাথরকে মাটিময় করো তবে।
কাদাময় মাটিতেই গোলাব জন্ম হয়।
গোলাবের বাগান কেন নয়?
হবে হবেই, বিশাল গোলাব বাগান হবে।
গোলাব বাগান পাথুরে পাহাড় নয়।
মনজুড়ে চেপে থাকা পাথর সরাও
মনের জমিতে মাটি রাখ ঢের
গোলাব বাগান পাবে তুমি
স্বপন বিভায়, আর হাতের ছোঁয়ায়
জেনে রেখো সখা
মাটির মত নরম হৃদয়ে
টকটকে প্রেমের গোলাব ফুটে
প্রভাত কালের এইতো সময়।
(হে বৃষ্টি তুমি দরশে, হে দরশেতুমি বৃষ্টি)।
সম্প্রতি আমার হাতে এসেছে, কবি কবীর আহমদের ‘কফিনে পঞ্চাশ বছরের কবিতা’ কাব্য গ্রন্থটি। কাব্য গ্রন্থটি ৫২টি কবিতায় সমৃদ্ধ। কাব্যের প্রথম কবিতা- ‘তুমি আমার’। এ কবিতায় কবি জীবন দেবতার প্রতি অর্ঘ্য নিবেদন করেছেন। এ কাব্যের দ্বিতীয় কবিতায় উৎসারিত হয়েছে বিগত যৌবনের জন্য হাঁহাকার। আহাজারির মত শুনতে এ কবিতার একটি অংশ যেমন- ‘ভাঙ্গা তানপুরা সুর সুরাতান/বেমিল বেসামাল মন প্রাণ’।/ বার্ধক্যে এসে কবি যৌবনের মিল খুঁেজ না পেয়ে বেসামাল হয়ে পড়েন। বিগত যৌবনের সুখ স্মৃতি কবিকে স্মৃতি কাতর করে ছেড়েছে।
এ কাব্যের কবি, শুধুই কি কবি? একই সাথে তিনি চিকিৎসকও। তিনি কেমন নিধানের চিকিৎসক? তিনি হোমিও নিধানের বর পুত্রও বটেন। এ পথের চিকিৎসকগণ সূক্ষ্মস্তরে বিচরণ করতে বড়ই ভাল বাসেন। কবি তাই ক্ষয়িষ্ণু বার্ধক্যে এসেও অবগাহন করতে চান সুক্ষ্ম স্তরে। স্থূল স্তরে তার মন বসে না। গুনীরা বলেন মানব চরিত্রের সুক্ষ্ম স্তরটিই নাকি মানবের মূল পরিচয়। এ কারণেই সম্ভবত কবি সুক্ষ্ম স্তরের সন্ধান করতে যেয়ে মরমীয়া বাদের প্রতি সমর্পিত হয়ে ওঠেন। ‘নিঃসীম অপার’ কবিতাটি তার উজ্বল দৃষ্টান্তও বটে। যেমন ‘সাকার আকার আলো অন্ধকার/ জানা অজানা সীমাহীন, নি:সীম অপার’/মারমীয়া সুরের এ কবিতাটি খলিল জীবরানের মরমীয় বাদের স্বগোত্রীয়ও বটে। এ কাব্যে রঙ ধুসর। কবির মনে গেরুয়া বৈরাগ্য। কারণ তিনি জীবনের গভীর হতে গভীরতর সুক্ষ্ম স্তরে গিয়ে তুলে আনতে চান কঠোর সত্যকে। এ সত্য আরো প্রকট হয়ে ওঠে ‘এই শীতে’ কবিতায়। যেমন ‘ধরণী জুড়ে গোপন হাঁহাকার, মরমী ব্যথা/ আত্ম সুরে কাঁদে প্রাণ, প্রাণ বায়ু যায় উডে/ সেও হয় নিঃসঙ্গ পথিক’/- কবি তাই জীবনের কঠোর সত্যের মুখোমুখী হয়ে শান্তির আন্বেষায় অস্থির হয়ে ওঠেন। অস্থিরতা রয়েছে কবির দেহ এবং মনেও। ‘অন্তরে অনল দহন, মন চায় শীতল ছায়া/ জ্বলে আর মনে পড়ে তোমার মায়া।’/ কবিতার এ চরণ দু’টি কবির যাতনাকে ধারন করে যেন উচ্চারণ করতে চায় কবিতা কোন বিলাস আনন্দ নয়। নয় কোন লাস্যময়ী লীলা সহচরি।
‘কালের করাত’ কবিতায় কবির দেহও মনে এসেছে ক্লান্তি এবং যুগপৎ হতাশাও। উদাহরণ আনা যেতে পারে যেমন- ‘ভুলে যাওয়া স্বপ্ন, অস্তমিত করুন অরুন/ অথচ সন্ধ্যা নেমে গেছে/ কোলাহল থেমে গেছে/নেমেছে দারুন অবসাদ।’/ বয়সের ভারে কবি ক্লান্ত। অবসাদ গ্রস্থ। জীবনের জমা খরচের খতিয়ান কবির চোখের সামনেই যেন মূর্তমান। কবির দীঘল জীবনে জামা খরচের খতিয়ান যেন কোন ভাবে মিলে না। কবি এ কবিতায় তাই নিজেই সাক্ষ্য দেন এ ভাবে,- ‘নির্ঘুম কেন কাটে শীর্তাত রাত’/ জমা খরচ মিলাতে পারেন না বৃদ্ধ কবি। কবি নিজের অনুভব এবং উপলব্ধিকে শুধু ভেঙ্গেছেন। এ ভাঙগার যেন কোন শেষ নেই। স্বস্তিও নেই।
কবি কোথাও প্রাশান্তিময় আশ্রয় অন্বেষণ করেছেন। প্রচ্ছন্ন অভিপ্রায় শুধু একজনের জন্য। তিনি নিরাকার এবং অদৃশ্যও বটেন। সেই রহমতের ছাঁয়ার নীচে কবি সামান্য আশ্রয় এবং প্রশান্তি কামনায় উদ্বেল। যেমন-
শুধু তোমাকেই দেখার বাকী
সব স্পৃহা ফুরায়, কেবল ফুরায় না
তোমাকে দেখার প্রবল তৃষ্ণা।
যৌবনের উদ্যত দ্রোহের স্থান দখল করেছে এখানে ¯্রষ্টার প্রতি আনত সুর ও আবেগ। কবি তবুও নিঃশঙক নন। কবি কবিতাকে মানবিক আশ্রয়ে অবলম্বন মনে করে তথায় আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টাও করেছেন। তবুও এ বয়সে কবির সংকট শেষ হয় না। তিনি কোথাও কোথাও কল্পিত আতংকেও অস্থির হয়ে ওঠেন। যেমন- ‘পাশ থেকে কাঁশলো কে যেনো/ তোমার স্বরে/ শিউরে উঠি আতংকে/ সেও কি তুমি?’/ এ আতংক লৌকিক এবং পারলোকিক উভয় ক্ষেত্রে প্রয়োজ্য।
সংকটের মধ্যে থেকে ও কবি সুকৃতির জন্য আকুতি জানাতে কসুর করেন না। উদাহরণও সহজ লভ্য ‘শেখ উত্তেজা হোসেন’ কবিতায়। ‘ফোঁটাতে পারি ফুল, ভাঙ্গণের পাড়ে দাঁড়িয়ে/ সবুজ চর গড়তে পারি।’
এ সুকৃতির আকুতি সমাজিক প্রতিবেশ পরিস্থিতির যে ভয়াবহতা তার কাছে হার মেনে যায়। ‘ব্যবিচার অবিচার ভুমিগ্রাস ত্রাস সন্ত্রাস/ বোম গুম রক্তপাত গর্ভপাত যতো’/ এ কবিতায় সামাজিক পরিবেশ পরিস্থিতির যে চিত্র আমরা দেখি তা কাল্পনিক কোন সমাজের নয়। কবি আক্রান্ত হয়েছেন ভয়াবহ রাজনৈতিক পরিস্থিতিরও ।
কবি কোথাও তার অগ্রজ কবির প্রভাব দ্বারা ভয়ানক ভাবে আক্রান্তও হয়েছেন। ‘একাঙিকা’ কবিতায় তার অনুরণন আমরা লক্ষ্য করি। যেমন- ‘নীল গিরি ঝিরি হিমছড়ি র্ঝণা ধারে/ আসবো না আর কোন দিন ফিরে/ এ গ্রহে চেম্বার গৃহে ফিরে/ আসবো না আর কোন দিন/ এ আসাই শেষ আসা।’/ একই কবিতায় কবি আরবী লোক সাহিত্যের দিকে হাত বাড়িয়েছেন দেখা যায়। আরবি সাহিত্যের প্রবাদ ‘আন-নওমো নিস্ফুুল মউত’- এ চরনটির হুবহু প্রতিধ্বনি পাই ‘নিদ্রা আর স্বপ্নতো মৃত্যুর নিদর্শন’- চরণটির মধ্যে। এই কবিতায় কবি বার বার জীবনান্দ দাশের প্রতি ইচ্ছায় অনিচ্ছায় যেন ফিরে ফিরে তাকিয়েছেন। কবিতাটিতে অনুপ্রাস এবং যমকের চমৎকার ব্যবহার আমরা লক্ষ্য করেছি।
কবির একটি কবিতায় আমার নিজেরও সহমর্তিতা উৎলে উঠেছে। কবির ‘চন্দন সুঘ্রাণ বিরাগীর রথে’ কবিতাটি পাঠ করার পর আমার নিজের একটি কবিতাকে এ কবিতার সাথে তুলনা করার চেষ্টা করেছি। তুল্যমান কবিতা দু’টিই মৃত্যু এবং স্বপ্নের সত্যকে যেন গভীর করে তুলেছে। আমি অনুভব করতে পারছি আমার মৃত্যু চেতনা কবির উপলব্ধি অনেকটুকু কাছাকাটিই যেমন অবস্থান নিয়েছে। আমার কবিতাটি এখানে উদ্বৃত করছি। যেমন-
ঘুমের রাজত্বে স্বপ্ন সহচারী
রাতভর রাজ্য পাটে বিচরণ করি
সব সত্যি ভাবি,
ঘুম শেষে, স্বপ্ন মিথ্যা হয় জানি
পৃথিবীটা সত্য ভাবি।
রাত এলে ঘুম আসে
ঘুম এলে স্বপ্ন আসে
কত সব ভাবি।
পৃথিবীর সব কিছু সত্য নয়
স্বপ্নে, শুধু স্বপ্ন সত্য হয়
পৃথিবী মিথ্যা এখানে
স্বপ্নে, স্বপ্ন সত্য একা
মানুষ দু’য়ের মাঝে একা
দু’পাশে স্বপ্ন আর পৃথিবী
মৃত্যু চলে সাথে
একান্তে একা।
(হে বৃষ্টি তুমি দরবেশ, হে দরবেশ তুমি বৃষ্টি)
কবির এ মৃত্যু চেতনা আরো গভীর হয় কবির ‘চন্দন সুঘ্রান বিরাগীর রথে’ কবিতায়। এ কবিতায় চমৎকার একটি চরণ পাঠককে মুগন্ধ করবেই। চরণটি এখানে উদ্ধৃত করছি ‘যখন ধরনীর সব চাওয়া পাওয়া কবরের পরশী।’/ অথবা ‘নির্ঘুম কেন কাটে শীতার্ত রাত’/ এ ধরনের চিত্রকল্প মনমুগ্ধ করও বটে। আমি এ চরণ দু’টির সমকক্ষ অন্য কোন কবিতা কিংবা চরণ খুঁেজ পাইনি এ কাব্যের কোথাও।
এ কাব্যে কবির নষ্টালজিয়া ও এক ধরনের অনুভুতি তৈয়ার করে। যেমন- ‘পুরানো কাঁচি যদি না কাঁটে/ ক্ষতি কি কাটো দাঁতে।/………./ স্মরণের আলপন আঁকো বুকে’। /স্মৃতি ভারাতুর কবির মনে অনেক ঝাপসা চিত্র। মনের শক্তি দিয়ে সেটিকে স্পষ্ট করতে না পারলেও অন্য কোন উপায়ে স্মৃতি চিত্র গুলি কবি উদ্ধারের জন্য আপ্রাণ আকুল। স্মৃতি এখানে বিভ্রম তৈয়ারী করে রেখেছে কবির জন্য। স্মৃতি কাতরতার চাপ হতে কবির মানস উত্তরণ সহজে আশা করা যায় না।
তবুও বলতে হয় এ কবি ডাক্তার কবি। এ কবি মানুষের দৈহিক যন্ত্রণার উপশমে যেমন প্রাণান্তকর, তেমনি মানস যন্ত্রণার সুক্ষ্ম স্তরে যে আদিম প্রবৃত্তি রোগের উন্মেষ সৃষ্টি করে। সেই সব মনো দৈহিক যন্ত্রণার সমাধান নিয়েই এ কবির কারবার।
কবি তার কাব্যে খুব ছোট্ট কবিতা দিয়ে শিল্প প্রকরণের যে তত্ত্ববধানের প্রয়াস পেয়েছেন- তা চমৎকার। ‘তুমি বলো বৃষ্টি কোথায়’ কবিতাটি স্বরবৃত্তের সৌন্দর্য্যে অপূর্ব হলেও ‘কফিনে পঞ্চান্ন বছরের কবিতা’র মত বিশাল কবিতা পাঠককে আনন্দ দিতে পারবে বলে মনে হয় না। এ কবিতা পাঠককে ক্লান্ত করবে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
একই সাথে বলতে হয় ‘ধর্ম সৌন্দর্য্যের সত্য’ এবং ‘কাব্য সৌন্দর্য্যের সত্য’ এক নয়। কবি ধর্ম আবেগের কারণে কাব্য সৌন্দর্যর যে সত্য- সে সত্য হতে অনেক দুরে সরে গেছেন বলা যায়। যেমন- ‘নিবেদন’ কবিতাটি ধর্মীয় আবেগের তরল সার হাওয়ার এখানে কাব্য সৌন্দর্য বিদায় নিয়েছে।
কবির এ বৃদ্ধ বয়েসে নিরন্ত কাব্য চর্চাকে ছোট করে দেখার কোন সুযোগ আছে সেটি বলার ইচ্ছে না থাকলেও, এ কথা অবশ্যই বলার আছে, কবি তার নিরলস প্রচেষ্টাকে আগামীতে আরো শানিত করবেন কাব্যামোদিদের জন্য। এ বিশ্বাস অবশ্যই আমার আছে। কবিকে সাধুবাদ।
প্রচ্ছদটি চমৎকার। বাধাঁই ও চমৎকার। কাব্য গ্রন্থটির মূল্য ধরা হয়েছে একশত টাকা। কাব্য গ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন- কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমী। প্রকাশ কাল- জুলাই ২০১৫ইংরেজী সন।
কাব্যামোদি মহল গ্রন্থটি পাঠে নির্মল আনন্দ পাবেন ও নিজেদের উপলব্ধির সাথে কবির অনুভুতিকে একান্ত করে দেখার এখানে সুযোগ রয়েছে।
* খসড়া ঃ- ১৫ই সেপ্টেম্বর ২০১৫ইং * চুড়ান্তঃ- ডিসেম্বর ১১/২০১৬ইং