২০১৬ সালে কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট এর একটি সরকারি ট্রেনিং এ আমি শ্রীলঙ্কা গিয়েছিলাম। আট দিনের সেই ট্রেনিং এ আমার লংকা হাসপাতালের মতো টারশিয়ারি লেভেল এর সরকারি হাসপাতাল, সুপার স্পেশালাইজড ডারডান্স হাসপাতাল থেকে শুরু করে জেলা সদর এবং সাবডিস্ট্রিক্ট লেভেল এর বেশ কিছু হাসপাতাল দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
রোগী, রোগীর স্বজন এবং ডাক্তার সহ স্বাস্থ্য কর্মীদের সন্তুষ্টি আমাকে খুবই আকৃষ্ট করেছিল। এর কারণ হিসেবে আমার অনভিজ্ঞ চোখে যেই বিষয়গুলো ধরা পড়েছিল সেগুলো হলো, রোগীর তুলনায় পর্যাপ্ত চিকিৎসাকর্মী, হাসপাতাল বেডের প্রতুলতা, সুশিক্ষা এবং সর্বোপরি অত্যন্ত সুন্দর স্বাস্থ্য ব্যাবস্থাপনা। আর একটা বিষয় হচ্ছে, জাতিগতভাবে শ্রীলঙ্কানরা কিন্তু অত্যন্ত শিক্ষিত এবং জাপানিদের মতোই বিনয়ী।
একটি জেলা সদর হাসপাতালে প্রবেশপথেই চোখে পড়লো রোগীর স্বজনের জন্যে বিশাল অপেক্ষাগার। সেখানে সবাই সুশৃঙ্খলভাবে অবস্থান করছে। হাসপাতালের ওয়ার্ড গুলোতে কোন গ্রীল নেই, প্রহরী নেই, তবুও কেউ ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করছেনা। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম এটা ভিজিটিং আওয়ার নয়, তাই সবাই অপেক্ষা করছে। হাসপাতালের ৬০ শতাংশ সীটে রোগী আছে, বাকিগুলো খালি। জানতে পারলাম, এখানে সরকারি বেসরকারি অনেক হাসপাতাল। ফলে সীট খালিই থাকে প্রায়শ, কাজের চাপ নেই তাই তেমন একটা। দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, আহা বাংলাদেশে যদি আমরা এমন পর্যায়ে যেতে পারতাম!
আমাদের দেশে ডাক্তারের দূর্ব্যবহার কিংবা অপেশাদার আচরণ আবার রোগী কিংবা স্বজন কতৃক ডাক্তার কিংবা চিকিৎসা কর্মীদের প্রতি অপ্রীতিকর আচরণ একটা নিয়মিত অভিজ্ঞতা কিংবা আলোচনার বিষয়। ব্যপারটি সার্বজনীন না হলেও অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।
এই প্রসংগে আসার আগে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্যে চিকিৎসক হিসেবে আমার কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা শেয়ার করি-
🌷আমরা সবাই প্রিয়জনকে ভালবাসি কিন্তু তারই লাশ ফেলেও কিন্তু পালিয়ে যাই।
🌷আমরা রোগী জীবিত থাকাকালীন সময়ে তার জন্যে প্রয়োজনীয় খরচ করতে কার্পণ্য করি, কিন্তু তার মৃত্যুর পর ধার দেনা করে হলেও তার জন্যে কুলখানির আয়োজন করি।
🌷আমরা করোনার মতো সংক্রামক রোগের চিকিৎসা চাই কিন্তু নিজ এলাকায় সেই করোনা হাসপাতাল বা করোনা রোগীর চিকিৎসা হোক সেটা কোনভাবেই চাইনা।
🌷আমরা চাই ডাক্তার আমাদের সময় দিক, কিন্তু আমার আগের রোগী নিয়ে ডাক্তার বেশি সময় ব্যয় করুক সেটা কোনভাবেই চাইনা।
🌷আমরা চাই ডাক্তার মাথা ঠান্ডা রেখে স্বজনের চিকিৎসা দিক, কিন্তু নিজেরাই ক্ষমতার বাহাদুরি দেখিয়ে চিকিৎসা কেন্দ্রে অযথা প্রবেশ করতে চাই।
🌷আমরা চাই ডাক্তার ভাল ব্যাবহার করুক, কিন্তু নিজেরা সেই ভাল ব্যাবহার করিনা।
🌷আমরা চাই পরিচ্ছন্ন হাসপাতাল, কিন্তু যেখানে সেখানে নিজেরাই ময়লা আবর্জনা কিংবা পানের পিক ফেলি।
🌷হাসপাতাল কিংবা বিল্ডিং এর মালিক ডাক্তার নয়, এখানে ২৫০ সিটে ৭০০ জন রোগী থাকে, সেটা জেনেও সিট বা কেবিন খালি নেই কেন, তার জন্যে অযথা ডাক্তারের সাথে বাকবিতন্ডায় লিপ্ত হই।
🌷আমরা চাই দেশেই ভাল চিকিৎসা হোক কিন্তু আমরা সেই চিকিৎসার উন্নয়নে কোন উদ্যোগ গ্রহণ বা সহযোগিতা না করেই বিদেশগামী হই আর করোনার মতো বিপদে হতাশায় নিমজ্জিত হই।
🌷আমরা চাই ভাল সেবা, ভাল কাজ হোক কিন্তু ভাল কাজের প্রশংসা করতে বা ধন্যবাদ দিয়ে উতসাহ প্রদান করতে কার্পণ্য করি।
🌷আমরা চাই সবাই সুস্থ জীবনযাপন করি, কিন্তু সুস্থতার পরীক্ষা নিরীক্ষা কিংবা অসুস্থার চিকিৎসা ব্যায়কে বাজে খরচ মনে করি, অথচ পান সিগারেট, মদ্যপান, অস্বাস্থ্যকর খাবার, অপ্রয়োজনীয় মনোরঞ্জনে প্রচুর অর্থ অপব্যয় করি।
🌷আমরা চাই ছেলেমেয়ে ভাল মানুষ হোক, ভাল ডাক্তার হোক কিন্তু নিজেরা আচরণের মাধ্যমে সেই নৈতিক শিক্ষা দিই না।
পরিবর্তনের সূচনা হোক আমাদের মাঝেই। কারণ, আমাদের আচরণই আমাদের সন্তানের মাঝে সংক্রমিত হয়, আমাদের উপদেশ নয়; সেই সন্তান ডাক্তার , প্রকৌশলী কিংবা যেই পেশারই হোক না কেন।
এই দূর্ব্যবহারের বিষয়টি তাই পেশাগত নয়, এটা ব্যক্তিগত, সামাজিক কিংবা জাতিগত। কারণ, কোন মেডিকেল কলেজেই কিন্তু দূর্ব্যবহার শেখানো হয়না। আবার মেডিকেল কলেজ কারিকুলামে নৈতিকতা বা মেডিকেল ইথিক্স শেখানো হলেও সত্যিকার অর্থে পারিবারিক শিক্ষাই কিন্তু আমাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে।
আর তাই শিশু কালেই আমাদের প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষার দুশ্চিন্তা চাপিয়ে না দিয়ে নৈতিকতা, সদাচার কিংবা সুকুমার বৃত্তি ও আত্মিক উন্নয়নে মনোযোগ দেয়া উচিত। আমরা সবাই জানি, নিম গাছে কখনো সুমিষ্ট আম হয় না।
লেখক :
ডা: শাহিন আবদুর রহমান চৌধুরী
আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ও বিভাগীয় প্রধান জরুরী বিভাগ, কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল।