বাংলাদেশসহ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে খাদ্য উৎপাদনকারী প্রাণীদের (ডিম, মুরগি, গরুর মাংস) মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী জীবাণুর হার সবচেয়ে বেশি। এমনকি তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে এসব জীবাণু। ওষুধের সহজলভ্যতা, আইনগত দুর্বলতা এবং সচেতনতার অভাব এবং আর্থসামাজিক কারণে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী জীবাণুর প্রভাব বাড়ছে। এতে ইতিমধ্যে দেশ ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে রয়েছে। এটি নিয়ন্ত্রণে এখনই কার্যকর ভূমিকা ও নজরদারি বাড়ানো না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
আন্তর্জাতিক প্রখ্যাত মেডিকেল জার্নাল ‘ল্যানসেট’-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় এই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। ‘গ্লোবাল অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল-রেজিস্টেন্স ড্রাইভার: এন ইকোলজিক্যাল কান্ট্রি-লেভেল স্টাডি অ্যাট দ্য হিউম্যান-অ্যানিমেল ইন্টারফেস’ শীর্ষক এই গবেষণা চলতি মাসে প্রকাশিত হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্বব্যাংক এবং সেন্টার ফর ডিজিজ ডায়নামিক্স ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিসি এই গবেষণায় সংযুক্ত ছিল। গবেষণায় খাদ্য উৎপাদনকারী প্রাণীদের মধ্যে, বিশেষ করে গবাদিপশু, শূকর এবং মুরগির মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক এক্সপোজারের সম্মিলিত ব্যাপকতা পাওয়া গেছে।
গবেষণায় বিশ্বব্যাপী অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টান্স বা জীবাণু-প্রতিরোধী অ্যান্টিবায়োটিকের হারের দিক থেকে দেশগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান মধ্যম পর্যায়ে। চতুর্থ প্রজন্মের অ্যান্টিবায়োটিক কার্বাপেনেম এবং তৃতীয় প্রজন্মের সেফালোস্প্রিন কম্পোজিশনের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অবস্থান মধ্যম পর্যায়ে। অর্থাৎ সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
গবেষণায়, কার্বাপেনেম-প্রতিরোধী অ্যাসিনেটোব্যাক্টর বাউমানি এবং সিউডোমোনাস এরুগিনোসা, তৃতীয় প্রজন্মের সেফালোস্পোরিন-প্রতিরোধী এসচেরিচিয়া কোলি এবং ক্লেবসিয়েলা নিউমোনিয়া, অক্সাসিলিন-প্রতিরোধী স্ট্যাফিলোকক্কাস অরিয়াস এবং পাবলিক অ্যানিমেলিস্টিক-অ্যারিউজিনোসা-প্রাণী প্রতিরোধী স্টাফিলোকক্কাস-এর তথ্য রয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, পশুর অ্যান্টিবায়োটিক সেবন ইতিবাচকভাবে মানব প্যাথোজেনের প্রতিরোধের সঙ্গে যুক্ত ছিল। একই সঙ্গে মানুষের অ্যান্টিবায়োটিক সেবন ইতিবাচকভাবে পশুর অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী জীবাণুর সঙ্গে যুক্ত ছিল।
গবেষণায় বলা হয়েছে, ক্রমবর্ধমান অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় হুমকি। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টান্সের কারণে বিশ্বব্যাপী ২০১৯ সালে প্রায় ১২ লাখ ৭০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে দেশ, আর্থসামাজিক অবস্থা নির্বিশেষে। অ্যান্টিবায়োটিকের নির্বিচারে ব্যবহার অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী জীবাণুর বিশ্বব্যাপী বিস্তারের একটি প্রাথমিক চালক। ২০১৭ সালে, বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদনকারী প্রাণীদের ব্যবহারের জন্য আনুমানিক ৯৩ হাজার ৩০৯ টন অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি হয়। ২০৩০ সালে এর পরিমাণ দাঁড়াবে ১ লাখ ৪ হাজার ৭৯ টন। মাংসজাত পণ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং ওভার দ্য কাউন্টার অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রির কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের এবং মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে, যেখানে জনসংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে এবং অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকার ২৯টি বাজার থেকে সংগ্রহ করা মুরগির নমুনায় বিভিন্ন মাত্রায় ১৭টি অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়ার ৩টি ধরন পাওয়া গেছে, যেখানে প্রতিরোধের মাত্রা ৬ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সালমোনেলা বিশ্বব্যাপী মানুষের ডায়রিয়াজনিত রোগের ৪টি মূল কারণের একটি। এর অন্যতম কারণ খামারিরা কেবল অসুস্থ হাঁস-মুরগিকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ায় না বরং কারণ ছাড়াই এক দিনের মুরগির ছানাকেও অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ায়।
এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, ল্যানসেটের এই গবেষণার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ নেই। গবেষণায় একটি বিষয় প্রমাণিত হয়েছে, অ্যান্টিবায়োটিকের যত বেশি ব্যবহার, তত বেশি রেজিস্ট্যান্স।
সেটা মানুষের ক্ষেত্রে এবং একই সঙ্গে প্রাণীর ক্ষেত্রেও, বিশেষ করে আমাদের হাতে থাকা সর্বশেষ পর্যায়ের অ্যান্টিবায়োটিকগুলো, মানুষ বাঁচিয়ে রাখতে যেগুলোর কোনো বিকল্প এখন পৃথিবীতে নেই। অধ্যাপক সায়েদুর বলেন, বাংলাদেশে মানুষের পাশাপাশি মুরগি ও গরুতে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের হার সবচেয়ে বেশি। এ ক্ষেত্রে ‘ওয়ান হেলথ’ কার্যকর করার বিকল্প নেই। এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে হলে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী জীবাণু দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে ভয়াবহ ঝুঁকিতে পড়বে দেশের মানুষ। সুত্র: আজকের পত্রিকা