নিউজ ডেস্ক::
আলোচিত-সমালোচিত বহুস্তর বিপণন (এমএলএম) কোম্পানি ডেসটিনির সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোয় লগি্ন করা অর্থ কি বিনিয়োগকারীরা ফেরত পাবেন- সেই প্রশ্ন ঘুরেফিরেই আসছে।
ডেসটিনি গ্রুপ-সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, যত দিন যাচ্ছে, ততই গ্রুপের সম্পদ বেহাত হচ্ছে। কোনো কোনো কারখানার যন্ত্রপাতি হারিয়ে গেছে। আবার অকেজো পড়ে থেকে যন্ত্রপাতি নষ্টও হচ্ছে। এ অবস্থায় কয়েক লাখ বিনিয়োগকারীর ভাগ্যে কী ঘটবে, তা অনিশ্চিত।
ডেসটিনির কর্তারাও জানেন না, এর ভবিষ্যৎ কী হবে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীন জেলে যাওয়ার পর চাঁদপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ শামছুল হক ভূঁইয়া ডেসটিনিতে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। তিনি সরকারের বিভিন্ন মহলে যোগাযোগ করেও এই গ্রুপটির সমস্যার কোনো কিনারা করতে পারেননি।
শামছুল হক ভূঁইয়া বর্তমানে হজ পালনের জন্য সৌদি আরব থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে ডেসটিনি গ্রুপের অর্থ উপদেষ্টা রণজিৎ চক্রবর্তী বলেন, ডেসটিনির নতুন সিইও সরকারের নীতিনির্ধারক ও বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।
ডেসটিনিকে ব্যবসায় ফিরিয়ে আনতে কোনো পরিকল্পনা আছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, যে গ্রুপের অধিকাংশ ব্যবসা সরকারি নিয়ন্ত্রণে, আবার প্রভাবশালীরা কোনো কোনো সম্পদ দখল করে নিচ্ছেন, সেখানে কী পরিকল্পনা করা যেতে পারে? তিনি আরও বলেন, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী সংশ্লিষ্টরা গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দেওয়ার পরিকল্পনা তৈরি করতে ব্যস্ত রয়েছেন।
রণজিৎ চক্রবর্তী বলেন, গ্রুপটির অন্যতম প্রতিষ্ঠান ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটিতে প্রায় নয় লাখ গ্রাহকের এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ আছে। ট্রি প্ল্যান্টেশন কোম্পানিতে ২০১৭ সাল শেষে গ্রাহকদের ১৬৮ কোটি টাকা পাওনা হবে। সব মিলিয়ে ডেসটিনির কাছে গ্রাহকদের পাওনা দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি।
এই অর্থ পরিশোধ করা কোম্পানির জন্য তেমন কোনো বিষয় নয়। কারণ, বর্তমানে প্রায় ৫০ লাখ গাছ রয়েছে কোম্পানির অধীনে। এর মধ্যে সাত লাখ গাছ বিক্রয়যোগ্য। এসব গাছ বিক্রি করা গেলে গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দেওয়া যাবে।
এ ছাড়া মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির গ্রাহকরা কোম্পানি চালু হলেই তাদের জমানো অর্থ ফেরত পাবেন। কোম্পানি গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দেওয়ার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরি করে আদালতে জমা দেবে। সম্প্রতি ডেসটিনির পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠানের সম্পদ বেহাত হওয়া, চালু প্রতিষ্ঠান থেকে যথাযথ আয় করতে না পারাসহ বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করা হয়েছে।
২০০০ সালে ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেড নামে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানি দিয়ে এই গ্রুপের যাত্রা শুরু। মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে আবাসন, বিমান পরিবহন, মিডিয়া, কোল্ডস্টোরেজ, জুট মিল, বনায়নসহ বিভিন্ন খাতে ৩৪টি কোম্পানিতে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয় ডেসটিনির নামে। কিন্তু গ্রুপের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে জনগণের অর্থ আত্মসাৎ ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ ওঠায় সবকিছুই এলোমেলো হয়ে যায়।
২০১২ সালে দুদক গ্রুপের শীর্ষ কর্তাসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে প্রথমে দুটি মামলা করে। পরে মামলায় ডেসটিনির সভাপতি সাবেক সেনাপ্রধান হারুন-অর-রশীদ, গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল আমীন, ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হোসাইনসহ ৫১ জনকে আসামি করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে চার হাজার ১১৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং এর মধ্যে ৯৬ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ আনা হয়। ৫১ আসামির মধ্যে রফিকুল আমীন, মোহাম্মদ হোসাইন ও দিদারুল আলম বর্তমানে কারাগারে।
জামিনে রয়েছেন পরিচালক আকবর আলী সুমন। ২০১২ সালে সাবেক সেনাপ্রধান হারুন-অর-রশীদকেও শর্তসাপেক্ষে জামিন দেওয়া হয়।
মামলার পর আদালত ডেসটিনির সম্পদের রিসিভার বা তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করে। রাজধানীতে থাকা ডেসটিনির সম্পদের তত্ত্বাবধায়ক ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। রাজধানীর বাইরে সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপার (এসপি)।
ডেসটিনি গ্রুপের আবেদনে কিছু প্রতিষ্ঠান, যেমন- বৈশাখী টেলিভিশন, দৈনিক ডেসটিনি, প্রিটিং প্রেস, কয়েকটি ফ্ল্যাট তাদের অধীনেই রয়েছে। আর কিছু সম্পত্তি প্রভাবশালীরা দখল করে রেখেছেন বলে ডেসটিনি-সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ। আবার কিছু অরক্ষিত পড়ে আছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (ডিটিও) মো. আবদুল মান্নান এ বিষয়ে বলেন, ডেসটিনির বিষয়টি বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন। বিচার শেষে যে রায় হবে, তা-ই বাস্তবায়ন হবে। ডেসটিনির যেসব প্রতিষ্ঠানে সরকারের পক্ষে তত্ত্বাবধায়ক রয়েছে, তা আদালতের নির্দেশেই রয়েছে। প্রত্যাহারও হবে আদালতের নির্দেশেই।
ডেসটিনির যেসব প্রতিষ্ঠান এমএলএম ব্যবসা করে না, সেসব প্রতিষ্ঠানের কী হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ওই সব প্রতিষ্ঠানে এমএলএম কোম্পানি ডেসটিনি-২০০০-এর শেয়ার রয়েছে, তাই বিষয়টি স্পষ্ট নয়। কারণ, ওই এমএলএম কোম্পানির বৈধ অনুমোদন নেই।
ডেসটিনির পরিবেশক মোশাররফ হোসাইন বলেন, এভাবে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে গ্রাহকদের অর্থ ফিরিয়ে দিতে পারবে না সরকার। এতে প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হবে। দেশেরও লোকসান হবে। তাই সরকারের উচিত, ডেসটিনি যাতে ভবিষ্যতে বৈধভাবে ব্যবসা করে গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধ করতে পারে, সে ব্যবস্থা করা।
যেভাবে আছে ডেসটিনির সম্পদ:
রাজধানীর ফার্মগেটে আনন্দ ও ছন্দ সিনেমা হল পুলিশ পরিচালনা করছে। বিমান কোম্পানি বেস্ট এয়ারের বারিধারায় যে ভবনটি রয়েছে, সেখানে পুলিশ থাকছে। বেস্ট এয়ারের একটি বিমান অচল অবস্থায় পড়ে রয়েছে কক্সবাজার বিমানবন্দরে।
রাজবাড়ীতে থাকা নিহার জুট মিল পুলিশ চালু রেখেছে। কুমিল্লা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে বুড়িচং উপজেলার দয়ারামপুর এলাকায় রয়েছে ডেসটিনির বন্দিশাহী কোল্ডস্টোরেজ। এখানে রয়েছে একটি পুকুরও। জেলা প্রশাসক কোল্ডস্টোরেজটি সিলগালা করে রেখেছেন।
কাকরাইলে রাজমণি ঈশা খাঁ হোটেলের পশ্চিম পাশে রয়েছে ১৭ কাঠা জমি। ওই জমি ক্রোক করতে পুলিশকে আদালত আদেশ দিয়েছেন। যদিও সেখানে বর্তমানে ‘এই সম্পত্তির মালিক রোজা প্রপার্টিজ লিমিটেড’ নামে একটি সাইনবোর্ড টাঙানো আছে। দৈনিক বাংলায় এক বিঘা জমিতে ব্যবসায়ী এমএনএইচ বুলু নিজের জমি দাবি করে সাইনবোর্ড লাগিয়েছেন বলে জানান রণজিৎ চক্রবর্তী।
ঢাকার মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানে এক হাজার ৩০০ কাঠা জমি রয়েছে এই গ্রুপের। এসব জমি থেকে মাটি কেটে নিচ্ছে অনেকে। বরিশাল ও খুলনায় দুটি ভবন করার প্রাথমিক কাজ করার পর বন্ধ রয়েছে। চট্টগ্রামে রয়েছে কিছু জমি। রাজশাহীতে বর্ণালী সিনেমা হল কিনে সেখানে নতুন করে ভবন বানাতে চেয়েছিল ডেসটিনি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেটি এখন ভাঙা অবস্থায় আছে।
ডেসটিনি গ্রুপের বড় বিনিয়োগ ট্রি প্ল্যান্টেশনে। বান্দরবানের সদর উপজেলার সুয়ালক ও রাজবিলা এবং লামা উপজেলার ফাঁসিয়াখালী, ইয়াংছা, আজিজনগর ও ফাইতং এলাকায় ৮৩৫ একর জমিতে ৩৪টি বাগান রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব বাগানে এখন আর ঠিকমতো পাহারাদার রাখা সম্ভব হচ্ছে না। অনেক জায়গায় বাগানের জমি যাদের থেকে কেনা বা লিজ নেওয়া হয়, তারাই দখল করে নিয়েছে বা গাছ কেটে নিচ্ছে। বিভিন্ন ব্যাংকে ডেসটিনি গ্রুপের ৫৩৩টি ব্যাংক হিসাব জব্দ অবস্থায় আছে। সেগুলোতে প্রায় দেড়শ’ কোটি টাকা আটকে আছে।