টেকনাফের বাসিন্দা সাইফুল। তিনি একসময় কক্সবাজারে সিঅ্যান্ডএফ এজন্ট অফিসে কর্মী হিসেবে কাজ করতেন। ২০০৭ সালের দিকে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা পাচার করে আনা চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ধীরে ধীরে নিজেই একটা চক্র গড়ে তোলেন। সেই সাইফুল পরবর্তী সময়ে হজ করেন। তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত হয় ‘হাজি’। সেই হাজি সাইফুল এখন ‘ইয়াবা গডফাদার’। কোটি কোটি টাকার মালিক। কক্সবাজার ছেড়ে রাজধানীতে বসে ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। খোদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে হাজি সাইফুল সম্পর্কে এমন তথ্য পাওয়া গেল। যদিও কোনো অভিযানে তাঁর টিকির নাগালও পায় না কেউ।
শুধু হাজি সাইফুলই নন, একইভাবে ইয়াবার গডফাদার শুক্কুরও টেকনাফ ছেড়ে এখন রাজধানীতে বসে সারা দেশে ইয়াবার ব্যবসা আর কক্সবাজারে তাঁর ‘রাজত্ব’ চালিয়ে যাচ্ছেন। জানা গেছে, যৌথ অভিযানের সময় বন্দুকযুদ্ধে কক্সবাজার জেলায় ছয় ইয়াবা ব্যবসায়ী নিহত হয়। এর পর থেকে মূলত ওই এলাকার শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ীরা ঢাকায় ‘ঘাঁটি গাড়ে’। তবে এদের সংখ্যা ঠিক কত, সে সম্পর্কে ধারণা দিতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
২০১৪ সালের এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে বছরখানেক ধরে ইয়াবার বিরুদ্ধে যৌথ বাহিনী অভিযান চালায়। ওই অভিযানের সময় বন্দুকযুদ্ধে ছয় ইয়াবা ব্যবসায়ী নিহত হলে জড়িতরা এলাকা ছাড়ে। ব্যবসা ও পাচার প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এরপর অভিযান গতি হারায়। বর্তমানে সমন্বয়হীনভাবে একেক বাহিনী তাদের নিজেদের মতো করে ইয়াবার বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে বলে জানা গেছে। বিজিবির পক্ষ থেকে ইয়াবা পাচার রোধে মিয়ানমারের কাছে বারবার সহযোগিতা চাইলেও তারা সহযোগিতার হাত বাড়াচ্ছে না। অন্যদিকে কূটনৈতিক উদ্যোগও চোখে পড়ার মতো নয়। এ অবস্থায় নানা উপায়ে কৌশল বদল করে ইয়াবা পাচার হয়ে দেশে ঢুকছে। একপর্যায়ে রাজধানীতে আসছে। আবার সারা দেশে এমনকি গ্রামপর্যায়েও পৌঁছে যাচ্ছে মারাত্মক এ মাদক।
যৌথ অভিযানের পর কিছুদিন ইয়াবা পাচার বন্ধ বা কমে গেলেও এর কিছুদিন পর নতুন কৌশল বেছে নেয় মাদক ব্যবসায়ীরা। তারা নিজেরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে মিয়ানমারের ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ক্যারিয়ারদের পাঠিয়ে ইয়াবা চালান নিয়ে আসছে। ক্যারিয়ার বা হুন্ডি, অনেক ক্ষেত্রে চোরাচালানিদের দিয়ে টাকা আদান-প্রদান করা হচ্ছে। আরো একটি বিষয়েও তারা কৌশল বদল করেছে। ক্যারিয়ার হিসেবে এখন নারীদের ব্যবহারও বেড়ে গেছে। এসব নারীর মধ্যে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরাও রয়েছে। বিজিবি বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে এটা ভয়াবহভাবে বেড়েছে। বিজিবি বলছে, তারা তাদের নারী সদস্যদের মাঠে নামানোর কথা ভাবছে। আগামী দু-তিন মাসের মধ্যেই তারা সীমান্তে কাজ শুরু করবে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ মাদক। ফেনসিডিলের বিরুদ্ধে অভিযানে আমরা সফল হয়েছি। ইয়াবা আসে মিয়ানমার থেকে। সেখানে ছোট ছোট ফ্যাক্টরি অছে। টার্গেট বাংলাদেশ। মিয়ানমারের সীমান্ত বাহিনীর সঙ্গে আমাদের তিন মাস পর পর মিটিং হচ্ছে। ইয়াবা রোধে আমরা চাপ দিয়ে আসছি। আসলে আমরা তাদের সহযোগিতা পাচ্ছি না। আমদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বাড়াতে হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা যখন নাফ নদীতে অভিযান কড়াকড়ি করি তখন সেখান দিয়ে ইয়াবা পাচার বন্ধ হয়। তখন পাচারকারীরা পাহাড় বেছে নেয়। সেখানে বন্ধ করলে সমুদ্র দিয়ে যায়। নতুন নতুন পন্থা বের করে তারা।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘২০১৪ সালে বিশাল একটা ড্রাইভ দিয়েছিলাম। তখন থেকে ইয়াবার গডফাদাররা টেকনাফছাড়া হয়েছে। এখন যাদের ধরা হচ্ছে তারা ক্যারিয়ার।’ তিনি আরো বলেন, ‘প্রতি মাসে প্রচুর ক্যারিয়ারকে ধরি। যদি বিচার হতো তাহলে ফল মিলত। বাস্তবতা হলো, তারা জামিন নিয়ে বেরিয়ে আবার একই কাজে লিপ্ত হয়।’ কাদের গাফিলতির কারণে তাদের সাজা হয় না? এমন প্রশ্নের জবাবে বিজিবিপ্রধান বলেন, ‘কোন জায়গায় গাফিলতি তা বলতে পারব না। আমরা একই লোককে বারবার ধরি।’
ইয়াবার গডফাদাররা ঢাকায় : টেকনাফের তালিকাভুক্ত ইয়াবার গডফাদার আবদুস শুক্কুর। তিনি সরকারদলীয় একজন রাজনীতিকের ভাই। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভয়ে তিনি টেকনাফ ছেড়ে ঢাকায় বসবাস করছেন। আরেক তালিকাভুক্ত কারবারি টেকনাফের জালিয়াপাড়ার সাবেক কমিশনার ফরিদ আলমও এলাকা ছেড়ে রাজধানীতে চলে এসেছেন বলে জানা যায়। একইভাবে টেকনাফের তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী মোজাম্মেল হক, নেজাম উদ্দিন, আবদুল্লাহ, মিয়া হোসেন, আমির হোসেন লেডু, জাফর, নূরুল আমিন, গফুর, মো. আলী, জিয়াবুল হক, মো. আয়াছ, মো. আঙ্গু, মো. ইলিয়াছ, মো. সাকের, হাসান আলী, মো. রেজা, সামসুন নাহার জ্যোতি, নুর বশর মিজ্জি, জাকের, সোনা মিয়া, লাঙ্গু, মো. সেলিম, ইসহাক, মইন্না, ইসমাঈল, আফসার, এনাম, মাহাবুব, মো. সোলেমান, আবদুল হক, আব্দুর রশীদ, করিম, পুতুইন্না, আলম, দিলদার আলম, আবুল আলী, মো. হারুন, জিয়াউর রহমান, মো. ইউনুস, লামা বাজারের ইসমাইল, হোসেন আহমেদ, চৌধুরীপাড়ার মৌলভী মজিবুর রহমান, মো. সফিক, ফয়সাল, মৌলভি জহির আহম্মেদ, জহিরুল ইসলাম, মো. আলম, ছলিম, ইসলাম আব্দুল আমিন, রেজাউল করিম, আবদুল ওহায়াব ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন বড় শহরে ঘাঁটি গেড়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে টেকনাফ থানার ওসি আবদুল মজিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যৌথ বাহিনীর অভিযানের পর থেকেই টেকনাফের তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ীরা পলাতক। তাদের তালিকা আমাদের কাছে রয়েছে। আমরা সোর্স নিয়োগ করে রেখেছি। তালিকাভুক্তরা এলাকায় এলেই গ্রেপ্তার করা হবে।’
সমন্বিত অভিযানের অভাব : ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে যৌথ বাহিনী অভিযান চালায় কক্সবাজার এলাকায়। ওই সময় ইয়াবা ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তখন থেকেই তারা কক্সবাজার ছেড়ে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বড় বড় শহরে বসবাস করছে বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। এসব এলাকায় থেকেও তারা বসে নেই। ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে সমন্বিত কোনো অভিযান নেই। তবে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার (এসপি) শ্যামল কুমার নাথ বলেন, ‘আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’ তাঁর দাবি, পুলিশের অভিযানের কারণে স্থলপথে ইয়াবা কমেছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যেখানে এই ইয়াবা তৈরি হয় সেই ফ্যাক্টরি বন্ধ করতে না পারলে ইয়াবা রোধ করা কঠিন। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। অনেকটা কমেছে।’ তিনি আরো জানান, সমুদ্রে মাছ ধরার ট্রলার নজরদারির মধ্যে আনা গেলে ইয়াবা পাচার অনেকটা কমে আসবে।
পাওয়া যায় না ম্যাজিস্ট্রেট : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সীমান্ত এলাকায় ইয়াবা পাচারকারীদের আটক করার পর ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে শাস্তি দেওয়া হয়। শাস্তি দিয়ে কারাগারে পাঠানোর পর আপিল করে সহজেই তারা বেরিয়ে এসে আবারও সেই একই ব্যবসা করছে। এ ছাড়া দুর্গম এলাকায় ইয়াবা ধরার পর সেখানে ম্যাজিস্ট্রেট পাওয়া কঠিন হয়। ফলে থানায় পাঠাতে হয় আসামিদের। তাত্ক্ষণিক বিচার করতে পারলে আরো ভালো ফল মিলত। জানতে চাইলে বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, ‘সব জায়গায় ম্যাজিস্ট্রেট পাব কোথায়? এ ছাড়া বিজিবি সদস্যদের দূর থেকে দেখেই অনেক পাচারকারী ইয়াবা ফেলে দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। পরে সেগুলো উদ্ধার করা হয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘প্রচলিত আইনে বিচার যদি নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে এটা রোধ করা কঠিন। অমরা কত ধরব। ওদের হাতে কাঁচা টাকা। সেই টাকা খরচ করে আইনের ফাঁকে বেরিয়ে যায়।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমি মনে করি, মাদক একটি সমাজকে ধ্বংস করে দেয়। এত বড় একটি বিষয়ের জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনালে বিচার করা হলে মাদক ব্যবসায়ীদের দ্রুত সাজা দেওয়া যেত।’
নারীদের ব্যবহার করা হচ্ছে : রাজধানীর একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করছেন ফারজানা হক। তিনি ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। সম্প্রতি বিজিবির চেকপোস্টে তিনি ইয়াবাসহ ধরা পড়ার পর ভ্রাম্যমাণ আদালত শাস্তি দিয়ে তাঁকে কারাগারে পাঠিয়েছেন। ক্যারিয়ার হিসেবে নিরাপদ মনে করে ব্যবসায়ীরা নারীদের এ কাজে লাগাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিজিবি সদস্যরা নারীদের তল্লাশি করার ক্ষেত্রে মহিলা আনসার সদস্যদের কাজে লাগায়। কিন্তু এ সংখ্যা কম থাকায় অভিযানে সমস্যা হয়। দুই মাস পর থেকে বিজিবি তাদের নারী সদস্যদের পাবে তল্লাশির কাজে। বিজিবি কর্মকর্তারা মনে করেন, এতে নারী ক্যারিয়ারের তত্পরতা কমে আসবে।
-সুত্র কালেরকন্ঠ
পাঠকের মতামত