মাহাবুবুর রহমান, টেকনাফ থেকে ফিরে :
রোহিঙ্গাদের ত্রাণ দেওয়ার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে নির্দিষ্ট টোকেন। একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সীল বা জেলা প্রশাসনের সীল দেওয়া সেই টোকেন যার হাতে থাকে তাকেই সেনাবাহিনী লাইনে দাঁড় করিয়ে নিয়ম অনুযায়ী ত্রাণ দিচ্ছে। কিন্তু রোহিঙ্গারা ম্যাজিস্ট্রেটের সীল বা প্রশাসনের দেওয়া সেই সীল জাল করে একই ব্যাক্তি দিনে কয়েক বার ত্রাণ নিচ্ছে। রোহিঙ্গারা এই ভয়াবহ প্রতারনায় জড়িয়ে পড়ায় হতবাক হয়ে পড়েছেন মাঠ পর্যায়ে কর্তব্যরত প্রশাসনের কর্মকর্তারা। আবার অনেকে ত্রাণ নিয়ে তা সাথে সাথে বিক্রি করে দিচ্ছে এমন প্রমানও পাওয়া গেছে।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর বেলা ১২ টার দিকে টেকনাফস্থ লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম দেখতে দিয়ে দেখা গেছে, একটি নির্দিষ্ট জায়গায় খুব সুন্দর করে সারিবদ্ধ করে পুরুষ, নারী এবং শিশুদের আলাদা করে লাইনে দাঁড় করিয়ে ত্রাণ বিতরণ করছেন সেনা সদস্যরা। সেখানে যার হাতে নির্দিষ্ট টোকেন আছে তাকেই দেওয়া হচ্ছে ত্রাণ এবং ত্রাণ নেওয়া পর তার সেই টোকেন ছিড়ে ফেলা হচ্ছে। যাতে সে আর ত্রাণ নিতে না পারে। এ সময় কয়েকজনের টোকেন যাচাই করতে গিয়ে দেখা যায়, কিছু রোহিঙ্গার হাতে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার একটি বাড়ি একটি খামার লেখা এবং মাঝ খানে টেকনাফ কক্সবাজার লেখা একটি সীল দেওয়া টোকেন আর কিছু রোহিঙ্গার হাতে মোঃ শামসুল আলম পরিচিতি নং-১৬৮০৯। সিনিয়র সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রিট জেলা প্রশাসকের কার্যালয় কক্সবাজার লেখা গোল সীল দেওয়া আছে। এসময় এই টোকেন কারা দেয় কিভাবে দেয় এমন প্রশ্ন করার আগেই কর্তব্যরত জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেন, এখানে টোকেন জাল হয়েছে এই টোকেন আমাদের দেওয়া না। পরে সেই টোকেন সেনা কর্মকর্তাদের দেখালে তারাও বিষয়টি নিশ্চিত হন।
এ সময় লেদা ক্যাম্পে কর্তব্যরত ম্যাজিস্ট্রিট মোঃ আরিফ মোর্শেদ মিশু বলেন, আমাদের কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে গিয়ে স্থানীয় কিছু মানুষ এবং জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতা নিয়ে রোহিঙ্গাদের টোকেন দিই। দৈনিক আমাদের ত্রাণ প্রাপ্তির হিসাব করে আমরা টোকেন ছাড়ি। অনেক সময় দেখা যায়, কোন গাড়িতে ত্রাণ থাকার কথা ১ হাজার প্যাকেট সেখানে আছে ৯০০ প্যাকেট। এখন আমরাতো ১ হাজার টোকেন দিয়েছি, সেই টোকে গুলোকে অনেক সময় কিছু মানুষ বিভিন্ন সীল বানানোর দোকানে গিয়ে হুবহু সীল বানিয়ে এনে রোহিঙ্গাদের দিচ্ছে আর তারা ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, এখানে মোঃ শামসুল আলম স্যারের যে সীল ব্যবহার করা হয়েছে সেটি নকল করা হয়েছে। আর নকল সীলে ম্যাজিস্ট্রেট বানানও ভুল। তিনি বলেন, আমার ধারনা আগে আসা রোহিঙ্গারা বর্তমানে নতুন আসা রোহিঙ্গাদের এই প্রতারনার কাজে ব্যবহার করছে। আসলে এক সাথে এত মানুষকে সামাল দেওয়া অনেক দুরুহ কাজ। তবুও আমি আশা করি কয়েক দিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে। এসময় নাম প্রকাশ না করে এক সেনা কর্মকর্তা বলেন, আমরা টোকেন দেখে ত্রাণ দিচ্ছি। সেখানে কেউ টোকেন নকল করে আনলে সেটা আমরা বুঝতে পারবো না। তবে প্রশাসনের লোক সার্বক্ষনিক এখানে থাকে, তবে এই কাজ যারা করছে তাদের খুঁজে বের করতে বেশি সময় লাগবে না। আশা করি আরো কয়েক দিন গেলে আরও শৃংখলা ফিরে আসবে।
এসময় ত্রাণ বিতরণ স্থানের বাইরে গিয়ে দেখা যায়, গাড়ী থেকে ত্রাণ নিয়ে সেই ত্রাণ বিক্রি করে দিচ্ছে রোহিঙ্গারা। এ সময় ত্রাণ বিক্রি করা আসমা খাতুন বলেন, আমি দুই বস্তা ত্রাণ পেয়েছি। কিন্তু সেই ত্রাণ আমি নেব কোথায়। এখনো থাকার ঘর পাইনি। আর এগুলো অনেক ভারী। ছেলে মেয়ে সামলাবো নাকি ত্রাণের বস্তা সামলাবো? তাই দুই বস্তা ত্রাণ ৫০০ টাকা দিয়ে বিক্রি করে দিয়েছি।
আর ত্রাণ কিনে নেওয়া রহমতও রোহিঙ্গা। ৭ বছর আগে থেকে বসবাস করছে টেকনাফের লেদা ক্যাম্পে। তার দাবী অনেকে এখানে ত্রাণ কিনছে কারন ত্রাণ পাচ্ছে নতুন আসা রোহিঙ্গারা । তারা এখনো থাকার জায়গা পায়নি, ত্রাণের জিনিস নিয়ে কোথায় যাবে ? তারা ত্রাণ নিয়ে রাস্তার পাশে বসে থাকে তাই আমরা কিনে নিয়ে তাদের নগদ টাকা দিয়ে থাকি এতে তাদের উপকার হয় আর আমাদেরও ব্যবসা হয় আমরা সেইগুলো নিয়ে দোকনে নিয়ে বিক্রি করে ভাল লাভবান হই।
এ সময় রহমতের কাছে ত্রাণের টোকেন নিয়ে জাল করার ঘটনার সাথে কারা জড়িত এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নতুন আসা রোহিঙ্গাদের প্রাণ বাচানোই এখন দায় হয়ে পড়েছে। সেখানে টোকেন কিভাবে জাল করবে ? এগুলো করছে পুরাতন রোহিঙ্গারা। তারাই এখানে সব চিনে, প্রশাসনের লোকজন সেট হিসাবে টোকেন দিয়ে গেলে কিছু লোক সেগুলোকে হ্নীলার একটি দোকান থেকে সীল বানিয়ে হুবহু বানিয়ে নকল করে। এবং নকল টোকেন হয় বিক্রি করে না হলে অর্ধেক তাদের দিতে হবে সেই হিসাবে নকল টোকেন দিচ্ছে।
এ ব্যাপারে উখিয়া উপজেলার নির্বাহী অফিসার মোঃ মাঈনউদ্দিন বলেন, ত্রাণের টোকেন জাল করার ঘটনা এখনো আমি শুনিনি তবে একটি জিনিস সবাই বুঝতে হবে এত বিপুল সংথ্যক মানুষকে ঠিক মত ম্যানেজ করা অনেক বড় কাজ। তাই অনেক সময় কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা হতে পারে। এখন ত্রাণ বিষয়ে কাজ করছে সেনা বাহীনি তাই আসা করি সব ঠিক হয়ে যাবে। সুত্র: দৈনিক কক্সবাজার