ব্যাংকক: থাইল্যান্ডে বিচারে মানব-পাচারের সঙ্গে যুক্ত ৬২ ব্যক্তিকে শান্তি দেয়ার পর এই অবৈধ বাণিজ্যের আরো কুৎসিৎ রূপ প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। ২০১৫ সালের মাঝামাঝি থাইল্যান্ড সরকার মানব পাচারকারিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরুর বহু বছর আগ থেকে থাই-মালয়েশিয়া সীমান্তে জঙ্গলের মধ্যে বন্দিশিবিরগুলো পরিচালনা করা হচ্ছিল। এখানে শত শত রোহিঙ্গা ও নৌকায় অন্য দেশ থেকে আসা অভিবাসীকে আটকে রাখা হতো বলে ব্যাংকক-ভিত্তিক এনজিও ‘ফ্রিল্যান্ড’ জানিয়েছে।
মানব পাচার নেটওয়ার্কের মূল হোতাদের চিহ্নিত করতে পুলিশকে সহায়তা ও বিচারের মুখোমুখি করতে এই সংস্থাটি কাজ করছে।
ফ্রিল্যান্ড থাই-মালয়েশিয়া সীমান্তে মানবপাচারকারিদের বন্দিশিবির সম্পর্কে আরো তথ্য প্রকাশ করতে গিয়ে শুক্রবার সাংবাদিকদের জানায় যে, তাদের বিশ্বাস সেখানে পাঁচশ’র বেশি মানুষ মারা গেছে। পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে জঙ্গলের মধ্যে এসব বন্দিশিবির পরিচালনা করা হয়। এ খবর দিয়েছে এশিয়া টাইমস।
যেসব গাড়িতে করে রোহিঙ্গাদের পাচার করা হয় সেগুলোতে ফেলে যাওয়া মোবাইল ফোন থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদ্ধারে পুলিশকে সহায়তার জন্য এই সংস্থাটির ‘ডিজিটাল ফরেনসিক এক্সপার্ট’ রয়েছে। ফোন থেকে উদ্ধার করা তথ্যে দেখা যায় যে, গাড়ি চালকরা বারবার একটি পথ ব্যবহার করছে। এই তথ্যের সঙ্গে পাচার সাপ্লাই চেইনের অন্য তথ্যগুলো মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত কিছু বন্দিশিবিরের সন্ধান পাওয়া সম্ভব হয়।
মোবাইল ফোনের তথ্য থেকেই একজন সিনিয়র সামরিক অফিসারের ব্যাংক একাউন্টে টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়। পরে বিচারে লে. জেনারেল মানাস কংপায়েন নামে ওই কর্মকর্তার ২৭ বছর কারাদণ্ড হয়। মানাস ২০০৮ সালের ডিসেম্বর ও ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে কুখ্যাত ‘পুশব্যাক’ কর্মকান্ডের সঙ্গেও জড়িত। তখন শত শত রোহিঙ্গা নিয়ে আসা নৌকাগুলোকে আন্দামান সাগরে টেনে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়।
আদালতের রায়ের বিবরণে দেখা যায়, মানাস স্বীকার করেছেন যে তিনি আন্তর্জাতিক অভিবাসী তহবিল (আইওএম)’র টাকা পুশব্যাকের কাজে ব্যবহার করেছেন। এই পুশব্যাকের শিকার হয়ে শত শত রোহিঙ্গার মৃত্যু ঘটে বলে আশংকা করা হয়।
শুক্রবার ফ্রিল্যান্ডের কাছ থেকে আইএএম তাদের তহবিল তসরুপের তথ্য জানতে পারে। এতে সংস্থার কর্মকর্তারা বেশ মর্মাহত হন। থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলের প্রকল্পগুলোর অর্থ ওই কাজে ব্যবহার করা হয়েছে কিনা তারা এখন তা খতিয়ে দেখবেন।
আইউএম’র এক মুখপাত্র জানান, থাইল্যান্ডের রানং ও সামুত সাখন প্রদেশে অভিবাসীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য ২০০৫-০৯ পর্যন্ত পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্প পরিচালনা করা হয়।
মার্কিন নাগরিক স্টিভ গলস্টার পরিচালিত ফ্রিল্যান্ড জানায় যে, পাচারকারীরা মালয়েশিয়ায় কাজ করতে যেতে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের দক্ষিণ থাইল্যান্ডের বন্দিশিবিরগুলোতে নিয়ে আসার পর তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করতো।
ফ্রিল্যান্ড জানায় যে, শারীরিকভাবে যাদের অবস্থা ভালো ছিল সেসব তরুণ, পুরুষ ও শক্তিশালী লোকদেকে মালয়েশিয়ার বিরোধি বিভিন্ন দলের কাছে বিক্রি করে দেয়া হতো। তুলনামূলকভাবে বয়স্ক এবং দুর্বলদের মালয়েশিয়ার রাবার বা পাম বাগানে অথবা মাছ ধরার কাজে শ্রম দেবার জন্য বিক্রি করা হতো। ক্রেতা বাড়তি টাকা দিতে রাজি হলে তার সাথে স্ত্রী ও সন্তানদেরও দেয়া হতো।
তৃতীয় শ্রেণী ছিল দুর্বলতর বা অন্য কোওভাবে তাদের দিয়ে অর্থ যোগাড় করা সম্ভব নয়। এদের মধ্যে অসুস্থ, বৃদ্ধ, নারী ও শিশু অন্তর্ভুক্ত থাকতো। তাদের জঙ্গল ক্যাম্পে রাখা হতো এবং তাদের একমাত্র বিকল্প হলো মুক্তির জন্য ‘মুক্তিপণ’ পাবার আশায় মারা না যাওয়া পর্যন্ত সেখানে থাকা। সারা দিনে তাদের জন্য বরাদ্দ নুডুলসের একটি প্যাকেট এবং নদীর পানি। এভাবে অধিকাংশ মানুষ ৩-৬ মাসের বেশি ক্যাম্পে বেচে থাকতো না।
বন্দিশিবিরের ঘটনা উদঘাটনের পর দীর্ঘ দুই বছর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা চলে। এই মামলার প্রক্রিয়া ছিলো বেশ জটিল। তবে, শেষ পর্যন্ত ৬২ জনকে সাজা দেয়া হয়। ফ্রিল্যান্ড মামলার ফলাফলে সন্তোষ প্রকাশ করে।