উখিয়া নিউজ ডেস্ক::
মিয়ানমারের রাখাইন থেকে এখনো প্রতিদিনই বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিচ্ছেন নিপীড়িত ও নির্যাতিত রোহিঙ্গারা। মানবিক রাষ্ট্রের পরিচয় দেওয়া বাংলাদেশে ইতিমধ্যেই গড়ে উঠেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির। তাদের আশ্রয় ও খাবারের ব্যবস্থা করে যাচ্ছে বাংলাদেশ। চেষ্টা চলছে উপযুক্ত মর্যাদা ও নিরাপদ পরিবেশে তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর। আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির চেষ্টায় জোর কূটনৈতিক লড়াই চালাচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু চীনের বিরোধিতা ও প্রতিবেশী ভারতের নির্লিপ্ততায় বিশ্বে বিপুল সমর্থন থাকার পরও সহসাই কোনো সংকট সমাধানের আশা দেখছেন না দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, কৌশলগত বিশ্ব রাজনীতির মারপ্যাঁচের কারণে দীর্ঘমেয়াদি সংকটে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর যেমন উগ্রবাদে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে, তেমনি তাদের জন্য প্রয়োজনীয় ত্রাণের ব্যবস্থা নিয়ে রয়েছে উত্কণ্ঠা। কারণ যতটুকু মানবিক সহায়তার প্রয়োজন তার অর্ধেকের প্রতিশ্রুতিও পূরণ হয়নি। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ভাষায়, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো এক সুদূরপরাহত আশা। বরং সামনে আরও বিপদ অপেক্ষা করছে।
জাতিসংঘে বাংলাদেশের পক্ষে দায়িত্ব পালন করে আসা এক পেশাদার কূটনীতিকের মতে, রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বিশ্বব্যাপী নানা কথা চলছে। কিন্তু সব সভা, সমাবেশ ও বৈঠকে মানবিকতাকে উপেক্ষা করে শুধু কয়েকটি শব্দ নিয়ে বিতর্ক চলছে। বৃদ্ধ, নারী ও শিশুসহ আশ্রয় নেওয়া এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে ‘রোহিঙ্গা’ না ‘মিয়ানমারবাসী’ বলা হবে তা নিয়েই করা হয় বিতর্ক। আলোচনা হয় সংকটে থাকা মানুষগুলো ‘শরণার্থী’ না ‘আশ্রিত’ তা নিয়ে। এমনকি মিয়ানমারে ‘গণহত্যা’ চালানো হয়েছে নাকি ‘জাতিগত নিধন’ হয়েছে তা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় জাতিসংঘসহ অনেকেই। আবার বার বার সংকট সমাধানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ‘আন্তর্জাতিক’ উদ্যোগ চাওয়া হলেও চাপ প্রয়োগ করে বাধ্য করা হচ্ছে মিয়ানমারের সঙ্গে ‘দ্বিপক্ষীয়’ উদ্যোগ নিতে। সবাই বলছেন, তারা উদ্বিগ্ন। কিন্তু মিয়ানমারের বিপক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রায় সবাই অপারগতা দেখাচ্ছেন। ফলে নির্যাতনে দেশ ছাড়া ১০ লাখ রোহিঙ্গার অমানবিক জীবনের অবসান করে ফেরত পাঠানোর কোনো কার্যকর উদ্যোগ পাওয়া যাচ্ছে না। বরং বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সর্বশেষ স্বাক্ষর করা সম্মতিপত্রও একটি লোকদেখানো উদ্যোগে পরিণত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন এ পেশাদার কূটনীতিক। জানা যায়, অবিলম্বে রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়াকে লক্ষ্য নির্ধারণ করে গত ২৩ নভেম্বর একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। ডকুমেন্ট অনুযায়ী ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবরের পর দেশ ছেড়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার কথা বলেছে মিয়ানমার। তবে মিয়ানমারে তারা বসবাস করতেন এ বিষয়টি তাদের প্রমাণ করতে হবে। কিন্তু এরচেয়েও বড় বড় বাধা অন্যখানে। খুব কম সংখ্যক রোহিঙ্গাই চুক্তি মেনে স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে রাজি হবেন। কারণ রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে মাঠপর্যায়ে পরিস্থিতি এখনো তাদের নিরাপদ বসবাসের সহায়ক নয়। আবার মিয়ানমার থেকে পরিষ্কার করে এটাও বলা হয়নি, মিয়ানমারে ফিরলে রোহিঙ্গাদের নিজ গ্রামে মূল বসতভিটায় ফিরতে দেওয়া হবে কিনা। কৃষি জমি ফেরত দেওয়ার বিষয়টিও বলা হয়নি। সেই সঙ্গে দেশে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে রোহিঙ্গাদের যে বিশেষ ধরনের ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড দেওয়ার কথা ডকুমেন্টে বলা হয়েছে তাতেও আপত্তি বেশির ভাগ রোহিঙ্গার। এর মাধ্যমে তাদের অধিকার বঞ্চিত করা হবে বলে মনে করেন রোহিঙ্গারা। আবার গ্রেফতার সংক্রান্ত মিয়ানমারের সতর্ক বার্তাও শঙ্কিত করেছে তাদের। কারণ বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়াদের মধ্যে সন্ত্রাসী ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সমর্থক আছেন উল্লেখ করে মিয়ানমার সরকার বলেছে, এমন কোনো ব্যক্তি ফিরে গেলেই তাকে গ্রেফতার করা হবে। আগের অভিজ্ঞতায় এটি শঙ্কায় ফেলেছে রোহিঙ্গাদের। পাশাপাশি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে জাতিসংঘে কোনো ভূমিকা না রাখতে মিয়ানমারের রহস্যজনক ভূমিকাও আশঙ্কা তৈরি করেছে মিয়ানমারের আসল উদ্দেশ্য নিয়ে। তারপরও সব বাধা উত্তরণ করে যদি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি শুরু হয় তাহলেও তার গতি নিয়ে আছে প্রশ্ন। কারণ মিয়ানমার স্পষ্ট জানিয়েছে, একদিনে তিনশর বেশি শরণার্থীর তদারকির সক্ষমতা নেই তাদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এবং বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, রোহিঙ্গা সংকটের গভীরতা ও ব্যাপকতা এত বিশাল যে বিষয়টি দ্বিপক্ষীয়তার ভিত্তিতে সমাধানের পর্যায়ে আর নেই। এর জন্য প্রয়োজন বহুপক্ষীয় কূটনীতি এবং দেশটির ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধির নানা পথ খোলা রাখা ও বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেওয়া। তা না হলে ইতিবাচক ফলাফল পাওয়ার ক্ষেত্রে আশঙ্কা থেকেই যায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক উদ্যোগের কথাই বার বার বলা হয়েছে। সর্বশেষ জাতিসংঘের নিরাপত্তা কমিশনের বিশেষ সভায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমও এ কথা স্পষ্টভাবে বলে এসেছেন। যদিও চীনের বিরোধিতায় বহুপক্ষীয় ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে বার বার পিছিয়ে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। কিন্তু জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় সর্বসম্মতভাবে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান করার প্রত্যয় নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাজ করছে বলে জানান এ কর্মকর্তা।
সামনে ভয়াবহ বিপদ : ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে উগ্রবাদে ঝুঁকে পড়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তা থেকে মিয়ানমারে আন্তসীমান্তে হামলা বাড়তে পারে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সম্পর্কে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেতে পারে। তাতে আঞ্চলিক অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান কমিশনের সুপারিশ জরুরি ভিত্তিতে বাস্তবায়নের জন্য মিয়ানমার সরকারকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করা হয় প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের উত্খাত করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। এতে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভূমিকা রাখবে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কে এর প্রভাব পড়বে। এক্ষেত্রে করণীয় সম্পর্কে আইসিজি বলেছে, টার্গেটেড অবরোধ আরোপ করার মধ্য দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেওয়া যেতে পারে। এতে সংখ্যালঘুদের ওপর একই রকম ঘটনা ঘটে— এরকম থেকে অনেকে বিরত থাকবে। সুত্র: বিডি প্রতিদিন