চাঁদাবাজি, দখলবাজি, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে বিএনপি। এমন অভিযোগ আসাদের বিরুদ্ধে সরাসরি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। অভিযোগ আসামাত্র কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হচ্ছে। অভিযোগের সত্যতা মিললে বহিষ্কার বা দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। সরকার পরিবর্তনের পর এ পর্যন্ত সারা দেশে বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের ৫০০’র অধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার ও পদ স্থগিতসহ নানা শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও অর্থের বিনিময়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের শেল্টার দেয়ার অভিযোগ। সর্বশেষ শনিবার দিবাগত রাতে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপি’র আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করেছে দলটি। যদিও বিবৃতিতে কমিটি ভেঙে দেয়ার কারণ উল্লেখ করা হয়নি। তবে উত্তরের আহ্বায়ক সাইফুল আলম নিরবের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও দখলবাজির অভিযোগ এই কমিটি ভেঙে দেয়া হয়েছে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে। এ ছাড়া উত্তরের শীর্ষ দুই নেতার মধ্যে দ্বন্দ্বের বিষয়ও সামনে এসেছে। থানা এবং ওয়ার্ড কমিটি গঠন নিয়েও তাদের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয় বলে নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন।
বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপি’র আহ্বায়ক কমিটি বিলুুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। শিগগিরই ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপি’র নতুন কমিটি ঘোষণা করা হবে। সাইফুল আলম নিরবকে আহ্বায়ক ও আমিনুল হককে সদস্য সচিব করে গত ৭ই জুলাই ঢাকা মহানগর উত্তর আংশিক আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। আড়াই মাসের ব্যবধানে এ কমিটি ভেঙে দিলো দলটি।
সূত্র মতে, শেরেবাংলা নগর থানা এলাকায় সাইফুল আলম নিরবের নেতৃত্বে এবং তার সহযোগী ফখরুল ইসলাম রবিন, আবু সুফিয়ান দুলাল ওরফে ভিপি দুলাল এবং মশিউর রহমান সোহানের নেতৃত্বে বিভিন্ন স্থানে ও অফিসে চাঁদাবাজি ও দখলবাজি চলছে। আর নিরবের অনুসারী শেরেবাংলা নগর থানা বিএনপি’র সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সালামত খান সজীব, যুবদল নেতা আতিকুল ইসলাম অপুসহ আরও বেশকিছু নেতাকর্মী সেচ ভবন, খামারবাড়ি, শিক্ষা ভবন, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ ভবন, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শিশু হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতাল এবং ফার্মগেটের বিভিন্ন মার্কেট এবং ফুটপাথগুলোতে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগের বিষয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাইফুল আলম নিরবকে পাওয়া যায়নি। ওদিকে চাঁদাবাজি ও দখলের বিরুদ্ধে ঢাকা উত্তর সিটির বিভিন্ন স্থানে সাইফুল আলম নিরবের নামে সতর্কতামূলক মাইকিং করতেও দেখা গেছে।
এদিকে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ ও যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকনের কাছে ব্যাখ্যা তলব করেছে বিএনপি। এরমধ্যে সালাহউদ্দিন আহমেদ বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলমের মালিকানাধীন গাড়িতে চড়ে নিজ এলাকা কক্সবাজারের পেকুয়ায় গিয়ে সংবর্ধনা নেন। বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে খবর হওয়ার পর নানা আলোচনার সৃষ্টি হয়। পরে দল থেকে তার কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। আরেক বিতর্কিত ডায়মন্ড ব্যবসায়ী ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় শিল্প-বাণিজ্য উপকমিটির সদস্য দিলীপ কুমার আগরওয়ালার সঙ্গে গুলশানের একটি হোটেলে বৈঠক করেন খোকন। এ ঘটনা প্রকাশ পেলে বিএনপি তার কাছেও ব্যাখ্যা চায়।
ওদিকে ৮ই সেপ্টেম্বর এক চিঠিতে জনগণকে দুর্ভোগের মধ্যে না ফেলে মোটরসাইকেলের বহর বা অন্য কোনো যানবাহনে শোভাযাত্রা পরিহার করার জন্য নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দিয়েছিল বিএনপি। এ ছাড়া পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন প্রদর্শন করা থেকেও নেতাকর্মীদের বিরত থাকার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়। এই নির্দেশনা অমান্য করে সম্প্রতি নোয়াখালীতে নিজের নির্বাচনী এলাকায় মোটর শোভাযাত্রা করেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন। এজন্য তাকেও নোটিশ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ফরিদপুরের নগরকান্দায় দু’পক্ষের সংঘর্ষ ও এক ব্যক্তির নিহত হওয়ার ঘটনায় দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ও জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলামের (বাবুল) দলীয় পদ স্থগিত করেছে বিএনপি।
বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী মানবজমিনকে বলেন, দলের শৃঙ্খলাবিরোধী ও নৈতিক অভিযোগের ভিত্তিতে বহিষ্কার, পদ স্থগিত ও কমিটি বাতিল করা হয়েছে। আর বিএনপি’র নাম ভাঙিয়ে অনেকে চাঁদাবাজি ও দখলবাজি করছেন। আবার জনগণকে দুর্ভোগের মধ্যে না ফেলে মোটরসাইকেলের বহর বা অন্য কোনো যানবাহনে শোভাযাত্রা পরিহার করার জন্য নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দিয়েছিল বিএনপি। এ ছাড়া পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন প্রদর্শন করা থেকেও নেতাকর্মীদের বিরত থাকার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়। এসব নির্দেশ যারা অমান্য করছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সারা দেশে চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বিএনপি এবং এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের ৫০০ অধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার ও পদ স্থগিতসহ নানা শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ১১ই আগস্ট বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক (বরিশাল বিভাগ) এডভোকেট বিলকিস জাহান শিরিনের দলীয় পদ স্থগিত করা হয়েছে, ১৫ই আগস্ট দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং দলের নীতি, আদর্শ ও সংহতি পরিপন্থি কার্যকলাপের জন্য হবিগঞ্জ জেলা বিএনপি’র আহ্বায়ক আবুল হাশিমকে বিএনপি’র প্রাথমিক সদস্য পদসহ সকল পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, ৩১শে আগস্ট দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে বগুড়া জেলা বিএনপি’র সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম তাজুল ইসলামকে বিএনপি’র প্রাথমিক সদস্যসহ সকল পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, ১লা সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপি’র সাবেক আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান, ১ম যুগ্ম আহ্বায়ক মো. এনামুল হক এনাম ও আহ্বায়ক কমিটির সদস্য এস এম মামুন মিয়ার প্রাথমিক সদস্যসহ সকল পর্যায়ের পদ স্থগিত করা হয়েছে, ১লা সেপ্টেম্বর সংগঠনবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে মুন্সীগঞ্জ জেলাধীন লৌহজং উপজেলার কুমারভোগ ইউনিয়ন বিএনপি’র সভাপতি মো. কাউছার তালুকদার এবং একই ইউনিয়ন বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন জনিকে দলের প্রাথমিক সদস্যসহ সকল পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
এ ছাড়া ১লা সেপ্টেম্বর সংগঠনবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলা বিএনপি’র যুগ্ম আহ্বায়ক ও ভালুকা উপজেলা বিএনপি’র আহ্বায়ক ফখরুদ্দিন আহমেদ বাচ্চুকে দলের প্রাথমিক সদস্যসহ সকল পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে এবং ত্রাণ তহবিলে তার দেয়া দশ লাখ টাকাও ফখরুদ্দিন আহমেদ বাচ্চুকে ফেরত দেয়া হয়েছে, ৭ই সেপ্টেম্বর দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং নীতি ও আদর্শ পরিপন্থি অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ঢাকা মহানগর উত্তর পল্লবী থানাধীন ২নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সভাপতি গোলাম মোস্তফা মাস্টারকে দলের প্রাথমিক সদস্যসহ সকল পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, ১২ই সেপ্টেম্বর মানুষকে হুমকি, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং নীতি ও আদর্শ পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থেকে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করার কারণে পিরোজপুর জেলাধীন মঠবাড়িয়া উপজেলা বিএনপি’র আহ্বায়ক রুহুল আমিন দুলালকে দলের প্রাথমিক সদস্যসহ সকল পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, দলীয় শৃঙ্খলা অমান্য করে নাটোর জেলা বিএনপি’র যুগ্ম আহ্বায়ক ও নাটোর জেলাধীন সিংড়া উপজেলা বিএনপি’র সদস্য সচিব দাউদার মাহমুদ বিশাল মোটরসাইকেল বহর নিয়ে শোভাযাত্রা করার সুনির্দিষ্ট অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাকে বিএনপি’র প্রাথমিক সদস্য পদসহ সকল পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, ১লা সেপ্টেম্বর দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং দলের নীতি, আদর্শ ও সংহতি পরিপন্থি অনৈতিক কার্যকলাপের জন্য মুন্সীগঞ্জ জেলা বিএনপি’র আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও টঙ্গিবাড়ী থানাধীন দীঘিরপাড় ইউনিয়ন বিএনপি’র সভাপতি মো. শামিম মোল্লা এবং মুন্সীগঞ্জ জেলাধীন টঙ্গিবাড়ী থানার অন্তর্গত কামারখাড়া ইউনিয়ন বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক কামাল ব্যাপারীকে বিএনপি’র প্রাথমিক সদস্য পদসহ সকল পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
স্বেচ্ছাসেবক দল: ৯ই আগস্ট দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল মাগুরা জেলাধীন সদর পৌর শাখার আহ্বায়ক মো. মারুফ হোসেনকে দলের প্রাথমিক সদস্য পদসহ সকল পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, ১২ই আগস্ট স্বেচ্ছাসেবক দল কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক আজিজুর রহমান মুসাব্বিরের দলীয় পদ স্থগিত করা হয়েছে, ২রা সেপ্টেম্বর দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক আলী মুর্তজা খানকে দলের প্রাথমিক সদস্য পদসহ সকল পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, ২রা সেপ্টেম্বর দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে স্বেচ্ছাসেবক দল চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক আলী মুর্তজা খানকে দলের প্রাথমিক সদস্য পদসহ সকল পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, ১৯শে সেপ্টেম্বর দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে স্বেচ্ছাসেবক দল কুমিল্লা উত্তর জেলাধীন মুরাদনগর উপজেলা শাখার সদস্য সচিব মো. জয়নাল আবেদীন মোল্লাকে দলের প্রাথমিক সদস্য পদসহ সকল পর্যায়ের পদ থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে।
কৃষক দল: ৭ই আগস্ট জাতীয়তাবাদী কৃষক দল মানিকগঞ্জ জেলা শাখার আহ্বায়ক মো. তোজাম্মেল হক তোজাকে সংগঠনের প্রাথমিক সদস্য পদসহ সকল পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, ৭ই আগস্ট কৃষক দল কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক (খুলনা বিভাগ) মো. মোস্তফা কামালকে সংগঠনের প্রাথমিক সদস্য পদসহ সকল পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ ছাড়া কৃষক দল কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক (চট্টগ্রাম বিভাগ) সৈয়দ সাইফুদ্দিন আহমেদ ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক (চট্টগ্রাম বিভাগ) মো. বদিউল আলম বদরুলকে পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।