সরকার পতনের পর থেকে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী নিজেদের রক্ষা করতে আত্মগোপনে চলে গেছেন। কেউ আছেন দেশে, কেউ দেশের বাইরে। অনেকে আবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ অবস্থায় দলের কর্মী-সমর্থক ও ছোট ছোট নেতারা পড়েছেন বেকায়দায়। হামলা মামলার ভয়ে তারা বাড়িঘরে থাকতে পারছেন না। বাইরে থাকা অনেকে যোগাযোগ রাখতে পারছেন না পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে। কেউ কেউ আছেন আর্থিক সংকটে।
এমন পরিস্থিতির জন্য দলের হাই-কমান্ডকে দুষছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা। ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে প্রশ্ন তুলছেন দলীয় কর্মকাণ্ডের বিষয়ে। দলে আত্মীয়করণ, দুর্নীতি, ত্যাগীদের অবমূল্যায়ন ও পদ বাণিজ্য নিয়ে তারা কথা বলছেন।
বিপরীতে কর্মী-সমর্থকদের ধৈর্য ধরতে বলছেন ক্ষমতাচ্যুত দলটির সিনিয়র নেতারা। বাস্তব পরিস্থিতি অনুধাবন, নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি না করা এবং মব জাস্টিস থেকে সতর্ক থাকতে নেতাকর্মীদের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
এসব বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে কথা হয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের সঙ্গে। কিছুটা পরিচ্ছন্ন ভাবধারার নেতা হিসেবে পরিচিত সাবেক এই এমপি ঢাকা পোস্টকে বলেন, নেতাকর্মীদের ক্ষোভ থাকতেই পারে। আমাদের প্রতি তাদের ভালোবাসা আছে, আন্তরিকতা আছে, ত্যাগ আছে। আমাদের কথায় তারা জীবনের ঝুঁকি নিতে পিছপা হয় না। হাজার হাজার নেতাকর্মী জীবন দিয়েছে। কারাগারে নিপীড়ন-নির্যাতন ভোগ করেছে। পারিবারিক-সামাজিকসহ বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারা। এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। সেই নেতাকর্মীদের আমাদের প্রতি রাগ-অনুরাগ-অভিমান থাকতেই পারে। তাদের কথা বলার অধিকার আছে, বলতেও পারে। এটাকে আমরা সম্মান জানাই।
টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে হেলিকপ্টারযোগে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন দলের সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্যে কয়েকজন গ্রেপ্তার হলেও কেন্দ্রীয় অনেক নেতার খোঁজ এখনো পাওয়া যাচ্ছে না। তবে কেউ কেউ হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় রয়েছেন।
এত বছর ক্ষমতায় থাকার পরও কেন দলকে শক্তিশালী করা যায়নি, সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন দলের কর্মী-সমর্থকরা। অনেকে আবার দলের সিনিয়র নেতাদের উপর ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।
এসব নেতাকর্মী ও সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, গত ৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশে যেটা হচ্ছে, যে মব জাস্টিস শুরু হয়েছে বা চলছে, এটাই এখনকার বাস্তবতা। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এই মব জাস্টিসের সামনে কারও রেহাই নেই। এটা নিয়ে কথা বলারও সুযোগ নেই। কথা বা মত প্রকাশ করলে সেও বিপদগ্রস্ত হবে। আমাদেরও সীমিত আকারে, সীমিত পরিসরেই অনেক সহনশীলতার সঙ্গে রক্ষণশীল হিসেবে চলতে হচ্ছে।
ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা বলছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পরও আওয়ামী লীগের নেতারা দেশ ছেড়ে পালায়নি। সেই সময় দলের বর্তমান সভাপতি ও বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশের বাইরে অবস্থান করলেও তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মী বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। দলের সিনিয়র নেতারাও দেশে ছিলেন। তবে এখন কেন কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না? কেন পালাতে হলো? দলকে কেন এই পরিস্থিতির মুখে পড়তে হলো?
সাবেক ছাত্রলীগ নেতা হেমায়েত উদ্দিন ফেসবুকে লেখেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরও দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাননি ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, আব্দুস সামাদ আজাদ, মিজানুর রহমান চৌধুরী, দেওয়ান ফরিদ গাজী, আমির হোসেন আমু, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আব্দুল জলিল, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, মোস্তফা মহসীন মন্টু ও আ স ম ফিরোজসহ অসংখ্য জাতীয় ও তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী-হেমায়েত উল্লাহরা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে টিকতে না পেরে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। খন্দকার মোস্তাক-জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং এরশাদের সঙ্গে আপস করেননি আওয়ামী লীগ নেতারা।
‘গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, কারাগারে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। আব্দুর রাজ্জাক এবং তোফায়েল আহমেদ টানা সাড়ে তিন বছর জেল খেটেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করেননি। যদিও এদের নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনা ছিল।’
পোস্টে তিনি আরো লেখেন, যতদূর জানি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তো দূরে থাক মাঝারি পর্যায়ের নেতৃবৃন্দও এখন দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। শুধু তাই নয় মোবাইল নম্বর বা যোগাযোগের সব পথ বন্ধ। এই আওয়ামী লীগ এতদিনে একজন আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তৈরি করতে পারেনি। নিজেদের ড্রাইভার, ব্যক্তিগত পিয়ন, কাজের লোককে নেতা বানিয়েছেন এবং আত্মীয়করণের এক মহাউৎসব করেছেন নেতারা। তৈরি করেছে ভুঁইফোঁড়, কাউয়া, তেলবাজ, পদ বিক্রি করা নেতা, টোল ওঠানো নেতা— এটাই বাস্তবতা।
যত ভুলে পতন আওয়ামী লীগ সরকারের
এ প্রসঙ্গে বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, অসংখ্য মানুষ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, পুলিশ বাহিনী, আনসার বাহিনী ও বিজিবি সদস্য আহত হয়েছেন। কেউ কেউ মারা গিয়েছেন। থানা লুট হয়েছে, ধ্বংস হয়ে গেছে। আইনের শাসন রক্ষা করার স্থাপনাগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কখনো পড়েনি। বাংলাদেশে আইনের শাসন রক্ষা করার জন্য সাংবিধানিকভাবে জায়গা তো একটাই, এটা কে করবে? কারা করবে? সেটা করবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদেরকে যেভাবে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা হয়, তার চেয়েও বেশি আক্রোশ নিয়ে টার্গেট করা হচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সহনশীল হতে হবে, একই সঙ্গে ধৈর্য ধরতে হবে। এই কঠিন পরিস্থিতি পার করার জন্য আমরা বারবার নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি। মিডিয়ার মাধ্যমে সে কথাগুলো বলার চেষ্টা করছি। ব্যাপকভাবে যোগাযোগ করার জন্য কোনো মাধ্যম আমাদের হাতে নেই। তারপরও বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে।
আওয়ামী লীগের একাধিক সিনিয়র নেতার ভাষ্যমতে, রাজনীতিতে উত্থান-পতন রয়েছে। এক দল সারা জীবন ক্ষমতায় থাকবে না। আমরা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিলাম। এখন ক্ষমতায় নেই। দেশের যে পরিস্থিতি, সেজন্য অনেকেই আত্মগোপনে চলে গেছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এবং নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলে নেতাকর্মীরা আবার মাঠে নামবেন। এখন নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি করা উচিত নয়। নিজেদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক রাখতে হবে।
এই মহূর্তে দলের কৌশল ও অবস্থান জানতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এবং সহযোগী সংগঠনের আরও বেশ কয়েকজন নেতাকে ফোন করার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখন নিজেদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। অতীতের ভুল নিয়ে নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি করা যাবে না। ঐক্যবদ্ধ হয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। আপাতত নিরাপদ স্থানে থাকুক নেতাকর্মীরা। সময়ই বলে দেবে, কখন কী করতে হবে।