চট্টগ্রামে প্রতিনিয়তই ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে ডেঙ্গু। যতই দিন যাচ্ছে, বাড়ছে মশাবাহিত এই রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই ভয়ংকর নতুন বেশ কিছু তথ্য উঠে এসেছে চার সংস্থার যৌথভাবে পরিচালিত এক গবেষণায়। চট্টগ্রামে আক্রান্তের ৮৮ ভাগের বেশিজনের শরীরেই ডেঙ্গুর সবচেয়ে ক্ষতিকারক ধরন ডেন-২-এর অস্তিত্ব শনাক্ত করেছেন এক দল গবেষক। অত্যন্ত ক্ষতিকারক এই ধরনের মধ্যে আবার বিপজ্জনক কসমোপলিটন প্রকরণ ছড়িয়ে পড়ার তথ্যও উঠে এসেছে গবেষণায়। এর কারণে চট্টগ্রামের বেশির ভাগ বাসিন্দা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। তাতে বাড়ছে মৃত্যুও। দেশে এবারই প্রথমবারের মতো কসমোপলিটন ধরন শনাক্তের দাবি করেছেন গবেষকরা।
গবেষকদের মতে, এর আগে এটি ভারত ও মিয়ানমারে শনাক্ত হয়েছে। পর্যটক ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের মাধ্যমে প্রকরণটি দেশে অনুপ্রবেশ করেছে বলে ধারণা তাদের। এটিতে লক্ষণ বেশি প্রকাশ পায়, রোগীর আইসিইউর প্রয়োজন হয়, মৃত্যুর হারও বেশি। এর উপস্থিতির কারণে আগামীতে ডেঙ্গু মহামারি রূপ নেওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন গবেষকরা। গবেষণায় ডেঙ্গুতে বেশি আক্রান্ত হওয়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পাঁচটি এলাকাকে ‘হটস্পট’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া দুই শতাধিক রোগীর ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় পিলে চমকানোর মতো এমন তথ্য-প্রমাণ খুঁজে পেয়েছেন তারা। ডেঙ্গুর মহামারি থেকে রক্ষা পেতে গবেষণায় নানা সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে।
এসপেরিয়া হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই গবেষণাটি পরিচালনা করেছে আইসিডিডিআর’বি, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ। আইসিডিডিআর,বির বিজ্ঞানী ড. মুস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত এই গবেষণা দলে রয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. এম এ সাত্তার, ডা. আবুল ফয়সাল, মো. নুরুদ্দিন চৌধুরী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. আদনান মান্নান এবং এসপেরিয়া হেলথ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের পরিচালক ডা. মো. আবদুর রব। গত ৫ অক্টোবর জিনোমের উন্মুক্ত বৈশ্বিক তথ্যভান্ডার জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটায় (জিআইএসএআইডি) এই গবেষণাটি গৃহীত হয়েছে। এ ছাড়া গবেষণাপত্রটি ইউরোপিয়ান জার্নাল অব মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইমিউনলজি এবং আমেরিকান জার্নাল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিনেও গৃহীত হয়েছে। আগামী সপ্তাহখানেকের মধ্যে সংবাদ সম্মেলন করে বিষয়গুলো বিস্তারিত তুলে ধরবেন গবেষকরা।
গবেষণার তথ্য মতে, চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের ৬০ শতাংশই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) পাঁচটি এলাকার বাসিন্দা। তাই নগরের বাকলিয়া, চকবাজার, কোতোয়ালি, ডবলমুরিং এবং বায়েজিদ বোস্তামীকে হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলার মধ্যে সীতাকুণ্ড, হাটহাজারী, পটিয়া, বোয়ালখালী এবং কর্ণফুলী এলাকা থেকে সবচেয়ে বেশি রোগী আক্রান্ত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। পরিচালিত এই গবেষণায় আক্রান্ত ১১ ভাগ রোগীর মধ্যে ডেন-৩ ধরনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। তাদের জিনোম সিকোয়েন্স করে অর্ধেক রোগীর মাঝেই বিপজ্জনক কসমোপলিটন প্রকরণের উপস্থিতি মিলেছে, যা ডেঙ্গু রোগের তীব্রতা ও জটিলতা বাড়িয়ে দিতে পারে বলে মনে করেন গবেষকরা।
গবেষণায় নেতৃত্ব দেওয়া চট্টগ্রামের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মো. আবদুর রব সমকালকে বলেন, গবেষণায় পাওয়া কসমোপলিটন প্রকরণটি অতীতে দেশের অন্য অঞ্চল থেকে পাওয়া প্রকরণগুলোর চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন। পর্যটক ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের মাধ্যমে এই বিপজ্জনক প্রকরণটি দেশে অনুপ্রবেশ করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অধ্যাপক ড. আদনান মান্নান বলেন, মূলত ডেঙ্গুর কোন ধরনের কারণে চট্টগ্রামের বাসিন্দারা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে, সেটি খুঁজে বের করতেই এই গবেষণাটির উদ্যোগ নেওয়া হয়। চমেক হাসপাতালে ভর্তি দুই শতাধিক রোগীর জিনোম সিকোয়েন্স করে নতুন অনেক তথ্য-উপাত্ত খুঁজে পেয়েছি আমরা।
ডা. আবুল ফয়সাল বলেন, কসমোপলিটন ভেরিয়েন্টটি খুবই ক্ষতিকারক। ভেরিয়েন্টটি কম সময়ের মধ্যে আক্রান্ত রোগীর শরীরের নানা অঙ্গ অচল করে দেয়।
গবেষকরা মনে করেন, ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার কারণ অনুসন্ধান ও নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য জিনোম সিকোয়েন্স অত্যন্ত জরুরি। প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে পূর্বপ্রস্তুতি নিলে অনেকের প্রাণও রক্ষা করা যাবে।
প্রতিনিয়ত ভয়ংকর হচ্ছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি
চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত ভয়ংকর হচ্ছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যমতে, চলতি মাসের প্রথম ১৮ দিনেই সর্বোচ্চ ৮২৮ জনের শরীরে ডেঙ্গুর অস্তিত্ব শনাক্ত হয়েছে। একই সময়ে মৃত্যু হয়েছে চারজনের। এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ২০ জনের এবং আক্রান্ত হয়েছে ২ হাজার ৩৩৩ জন। সূত্র সমকাল
পাঠকের মতামত