গ্রাহকদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান রিং আইডি মোট কত টাকা হাতিয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই পুলিশের কাছে। তবে প্রতিষ্ঠানটির পাঁচটি ব্যাংক হিসাবে ৩৭৭ কোটি ৪৯ লাখ টাকা লেনদেনের তথ্য বেরিয়ে এসেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) এক বছর ধরে চলা অনুসন্ধানে।
রিং আইডির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অন্তত ৮টি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে অর্থ পাচারের প্রমাণও পেয়েছে সিআইডি। নজরদারিতে রয়েছে ওই আট প্রতিষ্ঠানের মালিকসহ অন্তত দুই ডজন কর্মকর্তা। যেকোনো সময় তারা গ্রেপ্তার হতে পারেন বলে জানা গেছে।
এদিকে গ্রাহকদের টাকা আত্মসাতের মূল হোতা কানাডায় পলাতক রিং আইডির চেয়ারম্যান শরীফুল ইসলাম ও তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আইরিন ইসলামকে দেশে ফেরানোর প্রক্রিয়া নিয়ে এগোচ্ছে সিআইডি। এর অংশ হিসেবে গত ৪ আগস্ট গুলশান থানায় একটি মামলা করা হয়েছে সিআইডির পক্ষ থেকে। ওই মামলায় চার্জশিট দাখিলের পর আদালতে হাজির করতে শরীফুল-আইরিন দম্পতিকে ইন্টারপুলের মাধ্যমে দেশে ফেরাতে আদালতের অনুমতি চাওয়া হবে বলে সিআইডি সূত্র জানায়।
রিং আইডির বিরুদ্ধে মামলা এবং পলাতক দুই মালিককে ফেরানোর বিষয়ে সিআইডির অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত ডিআইজি) ইমাম হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, মামলার তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করবেন। এরপর আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অতিরিক্ত ডিআইজি আরও বলেন, ‘চার্জশিটভুক্ত আসামিরা কেউ বিদেশে পলাতক থাকলে তাদের আদালতে হাজির করার স্বার্থে দেশে ফেরানোর বিষয়ে আদালতে প্রস্তাব করবে পুলিশ।’
কত টাকা পাচার করেছে
রিং আইডির হাতিয়ে নেওয়া টাকার পরিমাণ চিহ্নিত হওয়া ৩৭৭ কোটি ৪৯ লাখ টাকার চেয়ে অনেক বেশি বলে মনে করছেন অনুসন্ধানকারীরা। তাদের যুক্তি- গ্রাহকেরা রিং আইডির পাঠানো বিদেশি বিজ্ঞাপন দেখায় গুগল অ্যাডসেন্স থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় রিং আইডির। তবে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের ব্যাংক হিসাবে এর কোনো টাকা জমা রাখেনি।
অনুসন্ধানকারীরা ধারণা করছেন, প্রতিষ্ঠানটি বৈদেশিক মুদ্রা দেশে নয়, অবৈধভাবে বিদেশের কোনো ব্যাংক হিসাবে পাচার করেছে। এ জন্য অধিকতর অনুসন্ধানের পাশাপাশি এসব টাকা কোথায় পাচার করা হয়েছে তা নিশ্চিত হতে কাজ করছে সিআইডি। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কানাডায় বসবাস থেকে অনুসন্ধানকারীদের ধারণা, টাকাগুলো কানাডায় পাচার হয়েছে।
সিআইডি সূত্র বলছে, শরিফুল-আইরিন দম্পতিকে দেশে ফেরাতে পারলে লোপাট টাকার পরিমাণ জানা যাবে। একই সঙ্গে এ টাকা কোথায় পাচার করা হয়েছে বা গ্রাহকের কত টাকা কীভাবে তছরূপ করা হয়েছে, তার তথ্য সিআইডির হাতে চলে আসবে।
গুলশান থানায় দায়ের করা মামলাটি শরিফুল-আইরিন দম্পতিকে দেশে আনার প্রক্রিয়ার একটি অংশ বলে উল্লেখ করে সূত্র জানায়, ভুক্তভোগীদের সুবিচার নিশ্চিতের লক্ষ্যে ফলপ্রসূ তদন্ত ও আদালতে সঠিক তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপনের জন্য তাদের জিজ্ঞাসাবাদ জরুরি বলে মনে করছেন সিআইডির কর্মকর্তারা। সিআইডির শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘মামলা দায়ের হওয়া মানে রিং আইডির কানাডায় পলাতক দুই মালিককে দেশে ফেরানোর প্রাথমিক ধাপ। আরো কয়েকটি আইনি ধাপ সম্পন্ন হওয়ার পর ইন্টারপুলের মাধ্যমে তাদের ফেরানোর প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হবে।’
রিং আইডির মালিকদের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলাটি করেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার পুলিশ সেন্টারের (সিপিসি) এসআই আল ইমাম।
মামলার বিষয়ে গুলশান থানার ওসি আবুল হাসান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘মামলায় আসামি করা হয়েছে রিং আইডির চেয়ারম্যান শরীফুল ইসলাম, তার স্ত্রী রিং আইডির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আইরিন ইসলাম এবং শরীফুলের ভাই সাইফুল ইসলামকে।’
ই-কমার্স প্লাটফর্ম রিং আইডির প্রতারণার খবর ফাঁস হলে গত বছরের ১ অক্টোবর গুলশান থেকে গ্রেপ্তার করা হয় প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক সাইফুল ইসলামকে। অপর দুই আসমি পলাতক।
নজরদারিতে যে আট প্রতিষ্ঠান
এক বছরের অনুসন্ধানে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনার আলোকে সিআইডি জানায়, ব্র্যাক ব্যাংকের পান্থপথ শাখা, ডাচ-বাংলা ব্যাংকের বনানী শাখা ও উরী ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখায় রিং আইডি বিডি লিমিটেড নামে এবং রিং আইডি ডিসট্রিবিউশন লিমিটেড নামে ব্র্যাক ব্যাংকের গুলশান শাখা, ডাচ-বাংলা ব্যাংকের বনানী শাখায় মোট ৫টি হিসাব খুলে ৩৭৭ কোটি ৪৯ লাখ টাকা গ্রাহকদের কাছ থেকে জমা নেয়া হয়। এই লেনদেন ২০১৫ সালের আগস্ট থেকে ২০২১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
এর মধ্যে উত্তোলন করে নেয়া হয় ৩০২ কোটি ২৬ লাখ টাকা। অবশিষ্ট টাকার মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন লেয়ারে শান্ত সিকিউরিটিজ, আরএনআই সিকিউরিটিজ ও ভার্টেক্স স্টক অ্যান্ড সিকিউরিটিজ লিমিটেড নামের এই তিনটি সিকিউরিটিজ কোম্পানির মাধ্যমে প্রায় ৩৩ কোটি টাকা শেয়ারবাজারে অবৈধভাবে স্থানান্তর করার প্রমাণ পেয়েছে।
এ ছাড়া আইপি ভিশন টেকনোলজি লিমিটেড, নেচারস্ক্যাপ লিমিটেড, আদরড স্টেট ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড, আদরড ট্র্রেডিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেড এবং রিভেরি ইঞ্জিনিয়ার্স নামের প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরের মাধ্যমে ৩৭ কোটি ৪৯ লাখ টাকা দেশের মধ্যেই লন্ডারিং করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক ঘুরেফিরে শরীফুল ইসলাম, আইরিন ইসলাম, সাইফুল ইসলাম এবং তাদের আত্মীয়স্বজন।
চক্রটি ২০১৫ সালের আগস্ট থেকে গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টাকাগুলো হাতিয়ে নিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনকারী অন্তত দুই ডজন কর্মকর্তাকে নজরে রেখেছে সিআইডি। তাদের বিষয়ে খুটিনাটি জানতে তদন্ত করা হচ্ছে।
এর আগে টেলিযোগাযোগ খাতে ভিশনটেল ও ক্লাউডটেল নামে দুটি প্রতিষ্ঠান খুলে ব্যবসা করে আসছিলেন শরীফুল ও আইরিন দম্পতি। ২০১৪ সালে এ দুটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ২৯৬ কোটি টাকা তছরূপের অভিযোগ এনেছিল বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা (বিটিআরসি)। এ মামলায় ২০১৬ সালে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলেন শরীফুল ও আইরিন।
সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, রিং আইডির দৃশ্যমান কোনো আয় ছিল না। তারা সোশাল মিডিয়া প্লাটফর্ম করার কথা বলে আড়ালে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) পদ্ধতিতে ব্যবসা পরিচালনা করছিলো। কিন্তু এমএলএম ব্যবসা পরিচালনায় নিবন্ধন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তারা নেয়নি। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক শরীফুল-আইরিন দম্পতি প্রথমে সামাজিক নেটওয়ার্ক হিসেবে রিং আইডি প্রতিষ্ঠা করেন। পরে কমিউনিটি জবসসহ বিভিন্ন খাতে কথিত বিনিয়োগের মাধ্যমে মুনাফার প্রচার চালান। এভাবেই তারা হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। এই অর্থের বড় অংশ প্রবাসী বাংলাদেশিদের।
সূত্র জানায়, কানাডার মন্ট্র্রিয়েল সিটিতে ২০১৫ সালে ‘রিং ইনকর্পোরেশন’ নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে যাত্রা শুরু হয় রিং আইডির। পরে ব্যবসার কার্যক্রম নিয়ে আসা হয় বাংলাদেশে। এরপর গ্রাহকদের অধিক উপার্জনের লোভ দেখিয়ে এক ধাপে ১২ হাজার ৫০০ টাকা এবং আরেক ধাপে ২৫ হাজার টাকার বিনিময়ে ‘আইডি’ কিনতে প্রলুব্ধ করা হয়। বলা হয়, এই আইডি কিনলেই মাসে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত উপার্জন শুরু। আর বিশেষ আইডি কিনতে হতো লাখ টাকা দিয়ে। সুত্র: ঢাকা টাইমস্