ডেস্ক রিপোর্ট ::
তিন বছর ধরে একটি জুতার কারখানায় প্রোডাকশন ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। ইন্টারমেডিয়েট পাস করলেও চাকরি নেওয়ার সময় তিনি অনার্স-মাস্টার্সের সনদ জমা দেন। কিন্তু তার কোম্পানি জানতেই পারল না, তিনি নকল সনদে চাকরি করছেন। এই জাল সনদ দিয়ে এর আগেও তিনি দুটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। তার জালিয়াতির কথা এ প্রতিবেদকের কাছে অকপটে স্বীকারও করেন সালাউদ্দিন।
কেস স্টাডি-২ : মারুফ আহমেদ। ২০০২ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে অকৃতকার্য হন। পরে একটি বুটিকশপে সেলসম্যানের কাজ নেন। ছয় বছর ধরে তিনি সেখানে কাজ করছেন। প্রতি বছরই সামান্য বেতন বাড়ে। কিন্তু কোনো প্রমোশন নেই। কারণ তার কাছে উচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ নেই। তাই প্রমোশনও হচ্ছে না। উপায় না পেয়ে তিনি এক বন্ধুর পরামর্শে নীলক্ষেতের একটি কম্পিউটার কম্পোজের দোকানে যোগাযোগ করেন। পরে ১০ হাজার টাকায় উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের (এসএসসি ও এইচএসসি) জাল সার্টিফিকেট তৈরি করে অফিসে জমা দেন। এর দুই বছর পর তিনি ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ পান।
কেস স্টাডি-৩ : আতাউল গণি। জাল সার্টিফিকেট দিয়ে দুই বছর ধরে একটি বাস কোম্পানিতে সুপারভাইজার হিসেবে চাকরি করছেন। এখন পর্যন্ত তার কোনো সমস্যা হয়নি। শুধু সালাউদ্দিন, মারুফ কিংবা আতাউল নয়, দেশের অনেক যুবকই জাল সার্টিফিকেট দিয়ে চাকরি করছেন। রাজধানীর নীলক্ষেতে চলছে জাল সনদ কেনাবেচার মহোৎসব। তবে শুধু নীলক্ষেতেই সীমাবদ্ধ নেই জাল সনদ কেনাবেচার পসরা। এ চক্রের দৌরাত্ম্য সারা দেশে। বিভিন্ন কৌশল আর প্রযুক্তি ব্যবহার করে অসাধুচক্র দিন দিন এ জালিয়াতি আরো বাড়াচ্ছে।
শুধু টাকা খরচ করলেই মিলছে বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডসহ সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট ও মেডিক্যাল কলেজের সনদ। মিলছে জাতীয় পরিচয়পত্র, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ব্যাংক
সার্টিফিকেটসহ যেকোনো সনদ। এসব সনদ এত নিখুঁতভাবে তৈরি, খোলা চোখে দেখে বোঝার উপায় নেই এগুলো জাল! তফাত শুধু একটাই, এই সনদটির বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ, হল অফিস ও প্রশাসনিক ভবনে রেকর্ড নেই। চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো যাচাই না করলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
এই জাল সনদে চলছে শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা ও ডাক্তারির মতো পেশা। রয়েছে জাল মুক্তিযোদ্ধা সনদও। ভুয়া সনদ দিয়ে চাকরি করছেন সরকারি কর্মকর্তাও। জাল সনদে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উচ্চপর্যায়ে কর্মরত আছেন অনেকেই! এমন অনেক ঘটনা বিভিন্ন সময় ফাঁস হয়েছে। পুলিশ, ডিবি ও র্যাবের অভিযানে এই চক্রের একাধিক সদস্য আটক হলেও থেমে নেই দৌরাত্ম্য। এদের সঙ্গে কম্পিউটার দোকান মালিক ছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী জড়িত বলে একাধিক তদন্তে জেনেছেন গোয়েন্দারা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে একটি শক্তিশালী চক্র নীলক্ষেতের বাকুশাহ মার্কেট, গাউসুল আজম মার্কেটে অবৈধভাবে জাল সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন ধরনের নথি তৈরির কাজ করে আসছে। তবে এই অবৈধ কর্মকান্ডের বিষয়টি প্রশাসনসহ অনেকে জানলেও চক্রটি থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এ জালিয়াতি আটকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎরতাও সন্তোষজনক নয়। মাঝে মাঝে লোক দেখানো অভিযানেই সীমাবদ্ধ সংস্থাটি। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, জাল সার্টিফিকেট, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, ভোটার আইডি কার্ড, স্কুল কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের জাল সার্টিফিকেট তৈরি করা হচ্ছে। এমনকি এমবিবিএস কোর্সের সার্টিফিকেটও মিলছে অহরহ। নীলক্ষেত যেন জাল সার্টিফিকেটের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। র্যাব-পুলিশ প্রায় অভিযান চালিয়ে অপরাধীদের ধরে সাজা দিচ্ছে। কিন্তু তাতেও থেমে নেই জাল সনদ তৈরির সিন্ডিকেট। মাত্র ১২ হাজার টাকায় মিলে চিকিৎসকের সনদ!
সূত্র জানায়, নীলক্ষেতে দিনে কাজের অর্ডার নিয়ে রাত ৮টায় মার্কেট বন্ধ হওয়ার পর অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে চলে সার্টিফিকেট তৈরি ও কেনাবেচার রমরমা ব্যবসা। ৩ থেকে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে এসব সনদে নাম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ঠিকানা বসিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিদিন আড়ালে আবডালে চলছে অবৈধ এ রমরমা ব্যবসা। খুবই গোপনে বিভিন্ন কৌশল আর প্রযুক্তি ব্যবহার করে কিছু অসাধু চক্র দিনের পর দিন অবৈধ এ কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে। এতে সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. সাদেকা হালিম বলেন, ‘জাল সার্টিফিকেট তৈরির মতো অপরাধ আমাদের সমাজে এখনো ব্যাপকভাবে বাড়েনি। তাই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে তা বন্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কারণ এতে যুবসমাজ মারাত্মকভাবে প্রতারিত হচ্ছে। কঠোর আইন আর সামাজিক সচেতনতাই এটিকে স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে পারে। এ জন্য প্রয়োজন সামাজিক ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠা। এর প্রচলন এখনই বন্ধ করতে না পারলে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।’
জাল সনদ প্রমাণের পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অনেক কর্মকর্তা চাকরি খুইয়েছেন। একই কারণে বিদেশে অধ্যয়নরত অনেকে হারিয়েছেন ছাত্রত্ব। কত লোক জাল সার্টিফিকেট নিয়ে চাকরি করছেন তার কোনো পরিসংখ্যানও কারো কাছে নেই। বিভিন্ন সময়ে জাল সনদে চাকরির অভিযোগে কর্মস্থল থেকে বহিষ্কার হয়েছেন অসংখ্য পেশাজীবী। তাদের মধ্যে শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসকসহ নানা পেশার লোকজন রয়েছে। কয়েক বছর আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা এক বিচারকের ‘নম্বরপত্রে জালিয়াতির’ ঘটনা দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় তুলে। বেশির ভাগ লোকই জাল সনদ ব্যবহার করে বিদেশে চাকরি করে থাকেন। কেউ ধরা পড়েন, কেউ পড়ছেন না। ২০১০ সালে জনতা ব্যাংকের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) আকবর আলী মিয়ার সনদ যাচাই করলে তা জাল প্রমাণিত হয়। অথচ তিনি জাল সনদেই দীর্ঘদিন চাকরি করছিলেন।
জালিয়াতির কিছু ঘটনা : অস্ট্রেলিয়ায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করতেন জাহিদ হোসেন। পরে জানা যায়, তার শিক্ষা সনদটি ভুয়া। জাল সনদে লন্ডনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য আবেদন করেছিলেন সোহান। তিনি ২০০৫ সালে ঢাবির লোক প্রশাসন বিভাগ থেকে অনার্স পাস করার কথা উল্লেখ করলেও রেকর্ডে তার নাম নেই। ঢাবির জাল সনদে যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘদিন চাকরি করছিলেন রাব্বি। পরে তিনিও চাকরি হারান। সিঙ্গাপুরের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এক্সিকিউটিভ পদে কর্মরত এ ইসলাম। ওই প্রতিষ্ঠানটির এক আবেদনের পর প্রমাণ হয় তার সনদটিও জাল ও ভুয়া।
রাজধানীর উত্তরার উপশম হেলথ কমপ্লেক্স লিমিটেডে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছিলেন ডা. মোহাম্মদ শহিদুর রহমান। একপর্যায়ে জানা যায়, তার চিকিৎসা সনদটি জাল। ঢাবির জাল সনদে দীর্ঘদিন গ্রামীণফোন চাকরি করেছেন সজল চৌধুরী। ব্রিটিশ কাউন্সিলে কর্মরত কাউসার বখত চৌধুরীর সার্টিফিকেটটিও ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে। রুহুল জামান নামে একজন কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় চাকরি করেছেন ঢাবির ভুয়া সনদ দেখিয়ে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন নিরীক্ষা দফতরে ঢাবির জাল সনদে চাকরি নিয়েছিলেন গিয়াসউদ্দিন। কয়েক বছর আগে জাল সনদে সরকারি সংবাদ সংস্থা বাসসে চাকরি করে ধরা পড়েন দুই সাংবাদিক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ জাল করে সৈয়দপুর মহিলা মহাবিদ্যালয়ে প্রভাষক হাবিবুল হক নামে এক শিক্ষক চাকরি খুইয়েছেন। বিগত দিনে জাল সনদে চাকরি করতে গিয়ে তারা শুধু চাকরিই খোয়াননি, হারিয়েছেন নিজের ও পরিবারের মান-সম্মানও।
জাল সনদের ক্রেতা কারা : এসএসসি কিংবা এইচএসসি পাস যুবকরা যখন জুতসই চাকরি না পান, তখনই তারা জাল সনদের দিকে ঝুঁকেন। তাদের একজন সজীব। এসএসসি সার্টিফিকেট দিয়ে চাকরি হচ্ছিল না তার। এ পরিস্থিতিতে এক বন্ধুর পরামর্শে নীলক্ষেতের বাকুশাহ সুপার মার্কেট থেকে মাত্র এক হাজার টাকার বিনিময়ে তিনি সংগ্রহ করেন অনার্সের জাল সার্টিফিকেট। এরপর ঠিকই চাকরি পেয়ে যান তিনি। সজীবের মতো যুবকরাই চাকরির আশায় জাল সনদের দিকে ঝুঁকছেন। আবার অনেকে খারাপ ফলাফল নিয়ে বিদেশ যেতে না পেরে জাল সনদ দিয়ে বাইরে যাচ্ছেন। এতে একদিকে যেমন নিজেদের আত্মসম্মান হারাচ্ছেন, অন্যদিকে দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণœ করছেন।
যেভাবে তৈরি হয় জাল সনদ : জাল সনদ তৈরিতে বিশেষ কিছু পন্থা অবলম্বন করা হয়। বিশেষ করে ফটোশপের মাধ্যমে কম্পিউটার অপারেটররা দক্ষতার সঙ্গে কাজগুলো করে থাকেন। তাদের প্রত্যেকের কম্পিউটারে বেশ কিছু সার্টিফিকেট ও কার্ডের মডেল রয়েছে। গ্রাহকের চাহিদামতো তারা এসব মডেল দিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ করেন। তাদের রয়েছে স্ক্যানার মেশিন, যা দিয়ে তারা প্রথমে একটি মূল সার্টিফিকেট স্ক্যান করেন। এরপর এ মডেলের ওপর নাম, রোলসহ সব তথ্য পরিবর্তন করে তৈরি করেন আসল সার্টিফিকেটের আদলে একটি জাল সার্টিফিকেট। পরবর্তী সময়ে এটি সার্টিফিকেটে ব্যবহৃত কাগজের মতো এক ধরনের কাগজে প্রেসে নিয়ে ছাপানো হয়। তাদের সঙ্গে নির্দিষ্ট কিছু ছাপাখানার যোগাযোগ রয়েছে। সেখানেই তারা এগুলো ছাপিয়ে থাকেন। চক্রগুলো তিন ধাপে কাজ করে থাকে। প্রথম গ্রুপের কাজ হচ্ছে কাস্টমার সংগ্রহ করা। দ্বিতীয় গ্রুপের কাজ আসল সার্টিফিকেটের ফরমেট ও বিশেষ ধরনের কাগজ সংগ্রহ করা এবং তৃতীয় গ্রুপটির কাজ নিখুঁতভাবে কম্পিউটারে সার্টিফিকেট তৈরি করে তা গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
জাল সনদবিরোধী কয়েকটি অভিযান : গত ৪ অক্টোবর রাজধানীর ফকিরাপুল থেকে জাল পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট তৈরির অভিযোগে পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন জেলার পুলিশ সুপার ও বিভিন্ন থানার ওসির ৫৭৭টি সিল, জাল পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট ১৪৫০টি, দুটি কম্পিউটার এবং একটি প্রিন্টার জব্দ করা হয়। একই দিন রংপুরে কয়েক শ জাল সার্টিফিকেট তৈরির যন্ত্রপাতিসহ আবদুল্লাহ আল মামুন নামে ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-১৩। এ সময় মাহমুদ উন নবী ও আবদুর রাজ্জাক নামে দুজন সনদ গ্রাহককেও গ্রেফতার করা হয়।
এদিকে, ৫ অক্টোবর নাটোরে ভুয়া সনদ ব্যবহার করে ছয় শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগে নজরুল ইসলাম নামে এক সুপারকে গ্রেফতার করেছে দুদক। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, নিয়োগ বোর্ডের অন্য সদস্যদের স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া সনদে ২০১১ সালের ৩ মার্চ থেকে ওই স্কুলের ছয়জন শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর আগে, বছরের শুরতেই গত ১৯ জানুয়ারি নীলক্ষেতের বাকুশাহ মার্কেটের একটি চক্রকে গ্রেফতার করে র্যাব। তাদের কাছে বিপুল পরিমাণ জাল সনদপত্র, নম্বরপত্র, জাতীয় পরিচয়পত্র, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ব্যাংক সার্টিফিকেট ও তৈরির সরঞ্জাম জব্দ করা হয়। সর্বশেষ গত ১২ জুন রাজধানীতে তিন ভুয়া চিকিৎসককে গ্রেফতার করা হয়। তারা মাধ্যমিক পাস করে চিকিৎসকের জাল সনদে কাজ করছিলেন। কয়েক বছর আগে ডা. গোলাম কিবরিয়া নামে চিকিৎসককে গ্রেফতার করা হয়। ভারত থেকে এমবিবিএস ও মেডিসিন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রির জাল সনদ দিয়ে প্রাইভেট চেম্বার খুলে বসেছিলেন। এ বিষয়ে ডিএমপির উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, জাল সনদ তৈরিতে জড়িতদের গ্রেফতারে নিয়মিত অভিযান চালায় পুলিশ।
পাঠকের মতামত