দৈনিক যুগান্তরের প্রতিবেদন
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে শতকোটি টাকার প্রতারণা কমলের
জসিম উদ্দিন, কক্সবাজার::
কক্সবাজার-৩ (সদর-রামু-ঈদগাঁও) আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শতকোটি টাকার প্রতারণা করেছেন। প্রায়ই তিনি মসজিদ, মন্দির, মাদ্রাসা, এতিমখানা ও মাহফিলে হাজির হয়ে বড় অঙ্কের টাকা অনুদানের ঘোষণা দিতেন। এর মাধ্যমে গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং স্থানীয়ভাবে প্রশংসা কুড়ালেও বাস্তবে কখনোই তিনি সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি। এভাবে জেলার অন্তত পাঁচ শতাধিক ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে। এমনকি প্রতিবন্ধীদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এক টাকাও দেননি তিনি। এছাড়াও কমলের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম-দুর্নীতি, সরকারি জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে। তার এমন কর্মকাণ্ডে শুধু স্থানীয় জনগণই নন, খোদ তার পরিবারের সদস্যরাও অতিষ্ঠ।
কমলের আপন বড় ভাই রামু উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সোহেল সরওয়ার কাজল দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে যুগান্তরকে বলেছিলেন, কমল স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসা ও মন্দিরে গিয়ে লাখ লাখ টাকা বরাদ্দ ও দান করার ঘোষণা দিয়ে বাহবা নেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, কোনো প্রতিষ্ঠানেই তিনি কোনো টাকা দেননি। এভাবে গত ১৫ বছরে অন্তত শতকোটি টাকা প্রতারণা করেছেন তিনি।
সোহেল সরওয়ার আরও বলেন, কমল টিআর/কাবিখা/কাবিটা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে জনগণের কল্যাণে আসা সরকারি বরাদ্দের কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এজন্য আমরা জনপ্রতিনিধিরা দীর্ঘদিন ধরে কোনো বরাদ্দ পাই না। পৈতৃকভাবে কমল মাত্র দেড় কানির মতো জমি পেয়েছিলেন। কিন্তু এখন তিনি হাজার কোটি টাকার মালিক।
কমলের ছোট বোন জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাজনীন সরওয়ার কাবেরী বলেছিলেন, কমলের প্রতারণা শতকোটি টাকা নয়, হিসাব করলে হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
ঈদগাঁও উপজেলার ইসলামপুরের বামানকাটা জামে মসজিদের দায়িত্বশীল মহিউদ্দিন জানান, কমল অন্তত তিনটি মাহফিলে উপস্থিত হয়ে মাহফিল ও মসজিদ সংস্কারের জন্য তিন দফায় ৯ লাখ টাকা অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এক টাকাও পরিশোধ করেননি।
রামু উপজেলার ইসলাম মাহমুদ নামের একজন ইমাম জানান, গর্জনিয়া এলাকায় অন্তত ১০টি মসজিদে উপস্থিত হয়ে কয়েক দফায় অন্তত তিন কোটি টাকা অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতারণা করেছেন সাবেক এমপি কমল।
ঈদগাঁওয়ে প্রতিবছর ফুটবল খেলা আয়োজনকে কেন্দ্র করে অতিথি হিসাবে উপস্থিত হয়ে ‘নতুন অফিস খেলার মাঠ’ সংস্কারের জন্য কয়েক দফায় ১৫ লাখ টাকা দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে কোনো টাকাই কমল দেননি বলে জানিয়েছেন কমিটির লোকজন। একইভাবে ইসলামপুর পাবলিক মডেল স্কুলে ১ লাখ টাকার প্রতিশ্রুতিও প্রতারণা করেছেন বলে জানান স্কুল পরিচালনা কমিটির সম্পাদক জসিম উদ্দিন।
কক্সবাজার সদর, রামু ও ঈদগাঁওয়ে ১১৭টি মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানাসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কমলের ১৪ কোটি ৬৭ লাখ টাকা দেওয়ার কথা। তবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক টাকাও দেননি কমল। এভাবে জেলায় ৫ শতাধিক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন তিনি।
শুধু তাই নয় পঙ্গু প্রতিবন্ধীর সঙ্গেও প্রতারণা করেছেন সাবেক এমপি কমল। গত বছর সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি দায়ের কোপে এক পা কেটে ফেলতে হয় রামুর সাংবাদিক আনোয়ার হোসেনের। কমল তাকে বাসায় ডেকে নিয়ে কৃত্রিম পা লাগানোর জন্য ২ লাখ টাকা সহযোগিতার কথা বলে বাহবা নিলেও এক টাকাও দেননি বলে জানান আনোয়ার।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রামুর রশিদ নগরে মহাসড়কের পাশে কক্সবাজার ক্রীড়া ও কারিগরি কলেজের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে কমল দখল করে নিয়েছেন শতকোটি টাকা মূল্যের সরকারি মূল্যবান জমি। দখল করা ওই জমির পেছন ভাগে খণ্ড খণ্ড করে দখল বিক্রি করে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
সরকারি একটি সংস্থার দেওয়া তথ্য বলছে, পৈতৃক বাড়ি ছাড়া আর কোনো বাড়ি ছিল না কমলের। অথচ এখন ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ছাড়াও নিজ এলাকার সব জায়গায় তার সম্পদ। কক্সবাজারে গড়েছেন আলিশান সুরম্য প্রাসাদ ওসমান ভবন। যেটি সবার কাছে ব্যাপক পরিচিত। দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা না থাকলেও এমপি হওয়ার সুবাদে বিগত ১০ বছরে তার সম্পদ বেড়েছে কয়েকশ গুণ। রামু বাইপাস এলাকায় জমি কিনে গড়েছেন মার্কেট, জোয়ারিয়ানালায় মহাসড়কের পাশে কিনেছেন ৩ একর জমি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে সাবেক এমপি সাইমুম সরওয়ার কমলের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই তিনি পলাতক। তার মোবাইল ফোনটিও বন্ধ রয়েছে। তবে সরকার পতনের আগে উল্লিখিত সব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কমল বলেছিলেন, দিনের ৩টার সময় ঘুম থেকে উঠা মানুষগুলো আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ করে বেড়ান। আমি তো মানুষের সেবা করার জন্য ভোরে ঘুম থেকে উঠি। তাই মানুষের উন্নয়ন নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ হয়েছে
পাঠকের মতামত