পাইকারি ও খুচরা বাজারে অতি প্রয়োজনীয় ও বহুল ব্যবহৃত বেশকিছু ওষুধের মোড়ক ও প্যাকেট হুবহু নকল করে বিক্রি হচ্ছে ভেজাল ওষুধ। প্যাকেট, লেভেল ইত্যাদি দেখতে অবিকল আসল ওষুধের মতো হলেও ভেতরের ওষুধ নকল। সাধারণ ক্রেতার পক্ষে যাচাই করে এসব ভেজাল ওষুধ নির্ণয় করা অসম্ভব। সম্প্রতি ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর পরীক্ষা করে বেশ কিছু নকল ওষুধ বাজারজাতকরণ ও বিক্রির বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। অন্যদিকে আসল ভেবে নকল ওষুধ কিনে প্রতারিত হচ্ছেন রোগীরা। মারাত্মক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন এসব ওষুধ সেবন করে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে সন্দেহজনক বেশ কিছু ওষুধ জব্দ করে। এর মধ্যে রয়েছে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ক্যাপসুল সেকলো-২০, ট্যাবলেট জি-ম্যাক্স-৫০০, ফিলওয়েল গোল্ড, এসকে+এফ এর ক্যাপসুল ফ্লুক্লজিন-৫০০, ট্যাবলেট অস্টোক্যাল ডি, রেনেটার ট্যাবলেট ম্যাক্সপ্রো-২০, এসিআই’র ক্যাপসুল ফ্লুকক্স-৫০০, এমবি ফার্মসিউটিক্যালের ট্যাবলেট মাইজিড-৫০০, জিএসকে’র ক্রিম ডার্মাভিট, অ্যারিস্টো ফার্মার ক্যালবো ডি, বেক্সিমকো ফার্মার বেক্সট্রাম গোল্ড।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অভিযান পরিচালনাকারী ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, বিভিন্নভাবে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অনুসন্ধানের পর গত মার্চ মাসে মিটফোর্ড এলাকায় ভেজাল ওষুধবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হয়। ওই সময় নামিদামি কোম্পানির দুই ট্রাক নকল ওষুধ জব্দ করা হয়। ওই কর্মকর্তা জানান, বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে এসব ওষুধ বিক্রি হচ্ছে দেখে তিনি সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে ওইসব কোম্পানীর তথ্যের ভিত্তিতে এসব ওষুধ জব্দ করা হয়। দেখা গেছে, বিভিন্ন নামিদামি কোম্পানির নাম, লেবেল, লোগো ইত্যাদি ব্যবহার করে এসব ওষুধ বাজারজাত করা হচ্ছে প্রকৃত ওষুধের চেয়ে স্বল্পমূল্যে। পরে ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, জব্দকৃত সব ওষুধই ভেজাল। এর সঙ্গে একটি অসাধু চক্র জড়িত বলে জানান তিনি।
ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, নকল-ভেজাল, মানবহির্ভূত ওষুধ বিক্রির দায়ে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এক হাজারের বেশি মামলা দায়ের করেছে প্রশাসন। এর মধ্যে ঔষধ আদালতে ২৮টি, ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১০টি এবং মোবাইল কোর্টে এক হাজার ৭টি। একই সময়ে এসব অপরাধে অভিযুক্ত ২৫ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড এবং ৫টি ফার্মেসি সিলগালা করা হয়েছে। এছাড়া ওই সময়ের মধ্যে সাড়ে ৫ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের ভেজাল ওষুধ জব্দ করা হয়। একইভাবে ২০১৫ সালে অবৈধ ওষুধ বিক্রি এবং উৎপাদনে জড়িত থাকার অপরাধে ১২৬৮টি মামলা দায়ের করা হয়। এছাড়া ৩১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড এবং ১২টি কারখানা, ৪৫টি ফার্মেসি ও ২টি গোডাউন সিলগালা করা হয়। পাশাপাশি প্রায় তিন কোটি টাকা জরিমানা এবং আনুমানিক ২২ কোটি টাকার বেশি মূল্যের ওষুধ জব্দ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে, যেসব ওষুধ নকল পাওয়া গেছে এর বেশিরভাগই বহুল ব্যবহৃত। এর মধ্যে সেকলো-২০ এবং ম্যাক্সপ্রো-২০ ওমিপ্রাজল গ্রুপের ওষুধ। সাধারণত গ্যাস্ট্রিক জাতীয় রোগের চিকিৎসায় এগুলো ব্যবহৃত হয়। ক্যাপসুল ফ্লুক্লজিন-৫০০, ফ্লুকক্স-৫০০ প্যানিসিলিন গ্রুপের এন্টিবায়োটিক ওষুধ। জিম্যাক্স-৫০০ এজিথ্রোমাইসিন গ্রুপের একটি এন্টিবায়োটিক। সাধারণত বিভিন্ন ধরনের অনুজীবের আক্রমণ থেকে জীবন রক্ষার্থে এই ওষুধগুলো ব্যবহার করা হয়। অস্টোক্যাল এবং ক্যালবো-ডি ক্যালসিয়াম জাতীয় ওষুধ। বেক্সট্রাম গোল্ড এবং ফিলওয়েল গোল্ড মাল্টিভিটামিন জাতীয় ওষুধ। ডার্মাভিট একটি ক্রিম, যা চর্মরোগের উপশমে ব্যবহার করা হয়। এসব নকল ওষুধের ক্ষতিকারক প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. একে লুৎফুল কবির যুগান্তরকে বলেন, মূল উপাদান কমিয়ে দিলে শরীরের মারাত্মক ক্ষতি হবে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এসব নকল ওষুধে মূল উপাদান থাকেই না।
তাই এসব খেলে কোনো বড় ক্ষতি হয়তো সব সময় হবে না, কিন্তু রোগীরও কোনো উপকার হবে না। তবে ওষুধগুলোতে মূল উপাদান যদি স্বল্পমাত্রায় বা মানহীন অবস্থায় ব্যবহার করা হয় তাহলে তা রোগীর জন্য মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাছাড়া যেসব রোগের প্রতিকারের আশায় রোগী ওষুধ সেবন করেন তার সে রোগ তো ভালো হবেই না বরং বাড়তে থাকবে।
পাঠকের মতামত