প্রকাশিত: ১৪/১১/২০১৬ ৭:৪৯ এএম

y-4নিজস্ব প্রতিবেদক ::

সকালের নাশতা দিয়ে শুরু, আর শেষ হয় গিয়ে রাতের খাবারে। মানুষ দৈনন্দিন খাবারের তালিকায় যা গ্রহণ করছে তার প্রায় প্রতিটি খাদ্যেই ভেজাল।

দেশের সর্বত্রই চলছে নকল, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ খাদ্যসামগ্রী বাজারজাতকরণের চেষ্টা। আর এই ভেজাল খাদ্য এক ধরনের বিষ। অথচ জীবনধারণের পাঁচটি মৌলিক প্রয়োজনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে খাদ্য। তাই নিরুপায় হয়েই জেনেশুনে পকেটের নগদ টাকায় এ বিষ কিনে খাচ্ছে মানুষ। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ নম্বর ধারায় উল্লেখ রয়েছে ‘নিরাপদ খাদ্য’ প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। কিন্তু দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বহীনতা এবং আইনের দুর্বলতার কারণে এই অধিকার পূরণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

জানা গেছে, ভেজাল নিয়ন্ত্রণে দেশে এখন পর্যন্ত বেশ কিছু আইন তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রণে নিরাপদ খাদ্য আইন, ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন, বিশেষ নিরাপত্তা আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব আইন প্রয়োগের জন্য রয়েছে বেশ কিছু সংস্থা। বিএসটিআই, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, মৎস্য অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন, মেট্রোপলিটন পুলিশ, ওষুধ প্রশাসন, আণবিক শক্তি কমিশন ও সরকারের বিভিন্ন বিভাগকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এসব আইন প্রয়োগের।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভেজালবিরোধী অভিযানের স্বল্পতা, কম শাস্তির বিধান এবং কিছু ক্ষেত্রে জনবলসংকটের কারণে সব পরিকল্পনা ব্যর্থ হচ্ছে। আইন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা থাকার পরও আইনের সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বছরের পর বছর দেশকে ভেজালের কাছে অসহায় করে রেখেছে অপরাধীরা।

বিভিন্ন আইনে জরিমানার বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০০৫ সালে সংশোধিত ১৯৫৯ সালের ‘বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ’ অনুসারে, খাদ্য ভেজাল করার সাজা সর্বোচ্চ এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড- বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড। ২০০৯ সালের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে বলা হয়েছে, সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদণ্ড- বা অনধিক দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের কথা। সর্বশেষ ২০১৩ সালের আইনে অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর কারাদণ্ড- বা অনধিক ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের কথা বলা হয়েছে। অথচ ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫(গ)-এর ১(ঙ) ধারায় খাদ্যে ভেজালকারীদের মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা ছিল। কিন্তু এ আইন আর বাস্তবায়ন করা হয়নি।

এ ব্যাপারে কৃষি ব্যাংকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়ে কোনো সরকারই ১৯৭৪ সালের খাদ্য আইন প্রয়োগ করতে চায় না। ফলে লাখ লাখ টাকা লাভের মধ্যে সামান্য কয়েক হাজার টাকা জরিমানাকে অসাধু ব্যবসায়ীরা খুব একটা আমলে নিচ্ছেন না।’ অথচ খাদ্যে ভেজালের দায়ে ভারতে যাবজ্জীবন, পাকিস্তানে ২৫ বছর কারাদ-, সৌদি আরব ও চীনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। বাংলাদেশেও এ ধরনের কঠিন আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন ভোক্তারা।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিদ্যমান আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রেও রয়েছে অনীহা। ১৯৫৯ সালের ‘বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ’ ২০০৫ সালে সরকার বেশ উৎসাহের সঙ্গে সংশোধন করে। সংশোধিত আইনে খাদ্য পরিদর্শক নিয়োগ, খাদ্যসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান তদারক করা ও জেলায় জেলায় খাদ্য আদালত গঠনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এখনো ঢাকা ছাড়া আর কোথাও খাদ্য আদালত গঠন করা হয়নি। এরপর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সব আইন মিলিয়ে ‘মাদার ল’ হিসেবে ২০১৩ সালে তৈরি করা হয় ‘নিরাপদ খাদ্য আইন’। কাগজে-কলমে ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন’ তৈরি হলেও এখনো এ-সংক্রান্ত বিধি তৈরি হয়নি। ফলে আইনটি কার্যকর করা যাচ্ছে না।

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি খাদ্য উদ্বৃত্তের পরিমাণ বাড়ছে। মন্ত্রণালয় দাবি করছে, চলতি অর্থবছরে খাদ্য উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে রয়েছে দেশ। প্রতিবছর কৃষিজমি কমে যাওয়ার পরও খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধি বর্তমান সরকারের একটি সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। সামাজিক সুরক্ষার মাধ্যমে দেশের দরিদ্র মানুষের খাদ্যের অধিকার নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে। বর্তমানে এ কর্মসূচির আওতায় দেশের প্রায় ২৫ শতাংশ পরিবারকে সামাজিক সুরক্ষা বলয়ের আওতায় নিয়ে এসেছে। গ্রামাঞ্চলে এ ধরনের সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৩০ শতাংশে বেশি। কিন্তু খাদ্যে ভেজাল রোধ করতে না পারায় সরকারের এসব সাফল্যের সুফল আসছে না।

এদিকে, আইন বাস্তবায়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো কিছু সীমাবদ্ধতার কথা বরাবরই বলে আসছে। তাদের দাবি, ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনার জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পাওয়া গেলেও প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুলিশ পাওয়া যায় না। তাই চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে এ অভিযান বাধ্য হয়েই বন্ধ রাখতে হয়। বিএসটিআই সূত্র জানায়, এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কিছুদিন আগে শুক্র ও শনিবার অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়। নানাবিধও কারনে পরে সেটাও আর বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। ফলে প্রতিনিয়তই নানাভাবে প্রতারিত হওয়ার বেড়াজাল থেকে বের হতে পারছেন না ক্রেতারা।

বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভেজাল খাবার খেয়ে ভোক্তারা আক্রান্ত হচ্ছেন ক্যানসার, স্নায়ুবিক গোলযোগ, অ্যালার্জি, শ্বাসকষ্ট, জন্ডিস, টাইফয়েড, গ্যাস্ট্রিক, মস্তিষ্ক ও হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস, লিভার, কিডনি ও প্রজননতন্ত্রের ক্ষতি, অঙ্গহানি ও বিষন্নতাসহ নানা গুরুতর রোগব্যাধিতে। এ ছাড়া ভেজাল খাবার গ্রহণের ফলে খাদ্যে অরুচি সৃষ্টি, এমনকি আলসারের মতো রোগব্যাধি হচ্ছে। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে রক্তকণিকার স্বাভাবিক বৃদ্ধি। ফলে থ্যালাসেমিয়া ও লিউকেমিয়ার মতো মারাত্মক ব্যাধিও দেখা দিতে পারে। হতে পারে ফুসফুসের ক্যান্সার।

বিষয়টি নিয়ে ধানমণ্ডি-সাত মসজিদ রোডে অবস্থিত উইমেন্স’স অ্যান্ড চিলড্রেন’স হসপিটালের অধ্যাপক মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিশ্চিত হচ্ছে না। এটা নিশ্চিত করতে যে ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, আমাদের সরকারি সংস্থাগুলো সে দায়িত্ব পালন করতে অনেকাংশেই ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন।’

সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবে তিনি বলেন, ‘বিদ্যমান আইন অনুযায়ী যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে নিরাপদ খাদ্য ও ভোক্তার অধিকার অতিসত্বর নিশ্চিত করতে হবে।

ভোরের পাতা

পাঠকের মতামত

মোটরসাইকেল-অটোরিকশা মুখোমুখি সংঘর্ষ: প্রাণ গেলো শিক্ষার্থীর

ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে মোটরসাইকেল-অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে সিয়াম আহম্মেদ (২০) নামে এক কলেজ শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। এই ...

ঢাকায় আসছেন ইলন মাস্ক!

আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলন আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। আগামী এপ্রিলে রাজধানী ঢাকায় হচ্ছে বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের জমকালো ...

মাদকে সয়লাব দেশ

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর স্থবিরতায় সারা দেশ মাদকে সয়লাব। গত চার বছরে দেশে অন্তত ৪০ লাখ ...