মাওলানা ওমর ফারুক::হাম্মাদ (সা.) এর উম্মত সকল উম্মতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত। তাদের এ বৈশিষ্ট্য পবিত্র কোরআনের আয়াত দ্বারা প্রমাণিত।
মহান রাব্বুল আলামীন আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন,
كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللّهِ وَلَوْ آمَنَ أَهْلُ الْكِتَابِ لَكَانَ خَيْرًا لَّهُم مِّنْهُمُ الْمُؤْمِنُونَ وَأَكْثَرُهُمُ الْفَاسِقُونَ
‘তোমরা সর্বোত্তম উম্মত। তোমাদেরকে মানুষের কল্যাণে সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা কল্যাণ কাজের আদেশ করবে, অকল্যাণ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর আল্লাহর ওপর পূর্ণ ঈমান রাখবে। (সূরা: আল ইমরান, আয়াত: ১১০)
এ আয়াতে উম্মতে মুহাম্মাদিকে খায়রে উম্মত (উত্তম উম্মত) বলার কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। তা হলো, এ উম্মতকে একমাত্র মানুষের কল্যাণে সৃষ্টি করা হয়েছে। তার সবচেয়ে বড় কল্যাণ হলো, মানুষের আধ্যাত্মিক ও চারিত্রিক শুদ্ধির ফিকির। যা এ উম্মতের মর্যাদাগত দায়িত্ব। পূর্ব উম্মতদের থেকে অনেক বেশি সৎ কাজের আদেশ, অসৎ কাজের নিষেধ এই উম্মত দ্বারা বাস্তবায়ন হয়েছে।
যদিও এই দায়িত্ব বিগত উম্মতগুলোর ওপরও অর্পিত ছিলো। কিন্তু পূর্ব উম্মতরা এই মহান দায়িত্বের প্রতি মনোযোগী হয়নি। নিজ যিম্মাদারি সঠিকভাবে আদায় করেনি বরং গুরুত্বহীনভাবে পিছনে ফেলে রেখেছে। যার ফলে মহান আল্লাহ তায়ালা সে জাতির ওপর অভিশাপ করেছেন।
পবিত্র কোরআনে যার বিস্তারিত বর্ণনা এভাবে এসেছে, ‘বনী ইসরায়েলের কাফিরদের প্রতি হজরত দাউদ ও মারইয়াম পুত্র ঈসা (আ.) এর ভাষায় লানত করা হয়েছে। কারণ তারা নাফরমানি ও সীমালঙ্ঘন করছিলো। পরস্পরে অসৎ কাজ থেকে বাধা দিতো না। তারা খুবই মন্দ কাজ করছিলো। (সূরা: মায়িদা, আয়াত: ৭৮)
উম্মতে মুহাম্মাদির শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে মহানবী (সা.) ভবিষ্যৎবাণী করেছেন যে, এ উম্মতের মধ্যে কিয়ামত পর্যন্ত একটি জামাআত ‘আমর বিল মারুফ (সৎ কাজের আদেশ) নাহী আনিল মুনকার (অসৎ কাজের নিষেধ)’ এর দায়িত্ব পালনে অটল থাকবে। এ উম্মতের বর্ণিত শ্রেষ্ঠত্ব কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে এবং কোনো না কোনো অবয়বে কোনো জামাআত এই দায়িত্ব পালনে কাজ করে যাবে। আর উম্মতের ভ্রান্তি ও ফাসাদের সময় মহান আল্লাহ তায়ালা এই উম্মতের মধ্যে প্রতি একশ’ বছরের মাথায় এমন মুজাদ্দিদ ও সংস্কারকারক পাঠাবেন, যিনি উম্মতের আকীদা ও আমলসমূহকে নববী তরীকা ও আদর্শে প্রতিষ্ঠিত করতে ইখলাসের সঙ্গে নিরলসভাবে সর্বোচ্চ চেষ্টা-মুজাহাদা করবেন। যেমন: মহান আল্লাহর রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা এই উম্মতের কল্যাণের জন্য প্রতি একশ বছরের মাথায় এমন ব্যক্তি প্রেরণ করবেন, যিনি উম্মতের সামনে দ্বীনকে সংস্কার করবেন। (মিশকাত শরীফ : হাদীস নং, ২৪৭)
অন্য এক হাদীসে রাসূল (সা.) বলেছেন, আগত প্রত্যেক প্রজন্মের মধ্যে উত্তম ও ভালো লোকেরা এই কোরআন, সুন্নাহর ইলম শিখবে। অতপর সেই ইলম দ্বারা অতিরঞ্জনকারীদের বিকৃতিকে মিটিয়ে দিবে এবং বিভ্রান্তকারিদের ভ্রান্তিগুলোকে প্রতিহত করবে। আর (কোরআনের আয়াত ও হাদীসের মধ্যে) মূর্খদের ব্যাখ্যাকে প্রত্যাখ্যান করবে। (মিশকাত শরীফ : হাদীস নং, ২৪৮)
উল্লিখিত হাদীস দ্বারা এ কথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, প্রত্যেক যুগে মহান আল্লাহ তায়ালা এমন সৎ, যোগ্য ও উত্তম উলামায়ে কেরাম সৃষ্টি করবেন, যারা দীনের মধ্যে অতিরঞ্জন ও কঠোরতাকারীদেরকে প্রতিহত করবে এবং সত্য ও হককে বিজয়ী করবে। আর ইফরাত, তাফরীত (অতি বাড়াবাড়ি, অতি ছাড়াছাড়ি) থেকে সরে দ্বীনকে আসল ও ভারসাম্যপূর্ণ রূপে উপস্থাপন করবেন।
উম্মতে মুহাম্মদির জন্য সতর্কতা:
সূরা আলে ইমরানের ১১০ নং আয়াতে উম্মতে মুহাম্মদিকে ‘খায়রে উম্মত’ তথা, উত্তম উম্মত সাব্যস্ত করা হয়েছে। তার কারণ বলা হয়েছে, ১.আমল বিল মারুফ (সৎ কাজের আদেশ)। ২. নাহী আনিল মুনকার (অসৎ কাজের নিষধ)। ৩. ঈমান বিল্লাহ (আল্লাহর প্রতি ঈমান)। বুঝা গেল, এ উম্মত যদি তাদের বিশেষ এ বৈশিষ্ট্যে অটল থাকে, তাহলেই কেবল ‘খায়রে উম্মত’ হবে। অন্যথায় ‘খায়রে উম্মত’ এর ফজিলত থেকে বঞ্চিত হয়ে যাবে।
পরবর্তী আয়াতে আহলে কিতাবের প্রতি ভর্ৎসনা থেকেও ষ্পষ্ট বুঝা যায় যে, যারা আমল বিল মারুফ, নাহী আনিল মুনকার করবে না, তারাও আহলে কিতাবের সদৃশ প্রমাণিত হবে। তাদের মন্দ গুণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘তারা নাহী আনিল মুনকার করতো না।’ তথা, একে অপরকে অন্যায় থেকে বাধা দিতো না। এ আয়াতে তাদের অধিকাংশকে গুনাহগার বলা হয়েছে।
আমল বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকার এর মর্যাদা ও বিধান:
আমল বিল মারুফ ফরজে আইন না ফরজে কিফায়া? অধিকাংশ উলামার মতে তা ফরজে কিফায়া। অর্থাৎ অব্যাহতভাবে এ ফরজ আদায় করা উলামাদের যিম্মাদারি। কেননা আলেমরাই সঠিক জানে যে, কোনটি সৎকাজ ও কোনটি অসৎ কাজ। সুতরাং তারা দাওয়াত ও তাবলীগের দায়িত্ব আদায় করলে উম্মতের অন্য সদস্যদের থেকে এ ফরজ আদায় হয়ে যাবে।
যেমন জিহাদও সাধারণ অবস্থায় ফরজে কিফায়া। অর্থাৎ, কোনো এক দল আদায় করলে ফরজ আদায় হয়ে যাবে। অতএব প্রত্যেকে নিজ নিজ গন্ডিতে রাসূল (সা.) এর এ নির্দেশের অধীনে যিম্মাদার। নির্দেশটি হলো, ‘আমার পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট একটি আয়াতের ইলম থাকলেও তা পৌঁছে দাও।’ (মিশকাত শরীফ : হাদীস নং ১৯৮।)
দাওয়াত বর্জনের শাস্তি:
বনী ইসরাইল যখন দাওয়াত ও তাবলীগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো এবং এই মহান দায়িত্বের প্রতি গুরুত্ব দিলো না তখন তার বিনিময়ে মহান আল্লাহ তায়ালা সে জাতির ওপর লানত করেন। যেমন, পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, বনী ইসরাইলদের কাফিরদের ওপর হজরত দাউদ ও ঈসা বিন মারইয়াম (আ.) এর ভাষায় লানত করা হয়েছে। কারণ তারা নাফরমানি ও অতিরঞ্জন করতো। পরস্পরে অসৎ কাজ থেকে বাধা দিতো না। তারা খুবই মন্দ কাজ করতো। (মায়িদা: ৭৯)
অর্থাৎ, হজরত দাউদ (আ.) এর ওপর অবতীর্ণ যাবুরে এবং হজরত ঈসা (আ.) এর ওপর অবতীর্ণ ইনঞ্জিলে উভয় নবীর মাধ্যমে ইয়াহুদী জাতির ওপর অভিসম্পাত করা হয়েছে। আর এখন মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এর ওপর অবতীর্ণ পবিত্র কোরআনের মাধ্যমেও সেই অভিশাপ করা হচ্ছে। লানত দ্বারা উদ্দেশ্য, আল্লাহর রহমত ও কল্যাণ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া।
লানতের কারণ স্বয়ং পবিত্র কোরআন স্পষ্ট বলে দিয়েছে। ১. নাফরমানি। অর্থাৎ, ওয়াজিব বর্জন ও হারাম কাজ সম্পাদন করে তারা আল্লাহর নাফরমানি করেছে। ২. সীমালঙ্ঘন। অর্থাৎ দীনের মধ্যে অতিরঞ্জন ও বিদআত সৃষ্টি করে তারা সীমালঙ্ঘন করেছে। এবং ৩. তারা একে অপরকে অন্যায় ও খারাপ কাজ থেকে বাধা দিতো না। যা আপাদ মস্তক অনেক বড় গুনাহ। কোনো কোনো মুফাসসির এটাকেই নাফরমানি ও সীমালঙ্ঘন সাব্যস্ত করেছেন। যা লানতের কারণ হয়েছে। মোটকথা মন্দ ও অকল্যাণ কাজ দেখে তা থেকে বাধা না দেয়া সর্বাবস্তায় অনেক বড় অপরাধ। আল্লাহর অভিশাপ ও গজবের কারণ। হাদিসের মধ্যেও তার ওপর শক্ত ধমকি বর্ণিত হয়েছে।
এজন্য অন্য এক হাদীসে তার গুরুত্বারোপ করে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের কেউ যখন কোনো অন্যায় কাজ হতে দেখে, তখন তার উচিত তাকে হাত দ্বারা (শক্তি প্রয়োগে) বাধা দেয়া। যদি তা করার ক্ষমতা না থাকে, মৌখিকভাবে বাধা দিবে। যদি এরও সামর্থ না থাকে, তাহলে মনে মনে খারাপ মনে (করে ঘৃণা) করবে। আর এটা ঈমানের দুর্বলতম স্তর। (মুসলিম: হাদীস, ১৮৬)
এক হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা বিশেষ শ্রেণির গুনাহের কারণে সাধারণ জনগণকে আযাব দিবেন না। যতোক্ষণ না সাধারণদের অবস্থা এই হবে যে, তারা পরস্পরে মন্দ কাজ হতে দেখবে, আর তাতে বাধা প্রদান করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বাধা দিবে না। যখন অবস্থা এমন হবে, তখন আল্লাহর আযাব বিশেষ ও সাধারণ শ্রেণি সবাইকে বেষ্টন করে নিবে। (মাজমাউয যাওয়ায়েদ লিল হায়সামী: ৭/২৭০, তাফসীরে ইবনে কাসীর: ৩/৫৭৮)
অপর এক বর্ণনায় এই ফরজ-দায়িত্ব বর্জনের ওপর ধমকি শুনানো হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর আযাবের উপযুক্ত হয়ে যাবে। অতপর তোমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করলেও কবুল হবে না। (তিরমিযী, হাদীস: ২১৬৯)
নাহী আনিল মুনকারের গুরুত্ব ও বাস্তব উদাহরণ:
নাহী আনিল মুনকারের হাকীকত হুজুর আকরাম (সা.) এক অর্থবহ উদাহরণের মাধ্যমেও স্পষ্ট করেছেন। তিনি (সা.) বলেছেন, আল্লাহর সীমায় নমনিয়তা ও ক্ষমাকারী এবং সীমালঙ্ঘনকারীদের উদাহরণ সেই গোত্রের মতো যারা একটি দু’তলা জাহাজে সফর করার জন্য লটারি দিয়েছিল। লটারির মাধ্যমে কারো ভাগে উপরের তলা, কারো ভাগে নীচ তলা নির্ধারণ হয়। নিচ তলার লোকেরা পানি আনতে উপর তলায় যেতো এবং উপর তলার লোকদের কাছ দিয়ে যাতায়াত করতো, এতে তারা কষ্ট পেতো। ফলে নিচ তলার লোকেরা কুড়াল নিয়ে জাহাজ ছিদ্র করা আরম্ভ করলো। যাতে নিচ থেকেই পানি সংগ্রহ করতে পারে। উপরে না যেতে হয়। ছিদ্র করার আওয়াজ শুনে উপরের লোকজন এসে জিজ্ঞাসা করলো, তোমরা কী করছো? তারা উত্তর দিলো, আমরা পানি আনতে উপরে যাই এটা তোমরা অপছন্দ করো। এজন্য আমরা নিচেই ছিদ্র করছি। কারণ পানি ছাড়া তো উপায় নেই।
নবী (সা.) বলেছেন, যদি তারা সে সময় তাদের হাত ধরে ফেলে এবং ছিদ্র করতে বাধা দেয়, তাহলে তারা তাদেরকেও বাঁচাবে। নিজেদেরকও রক্ষা করবে। পক্ষান্তরে তারা যদি তাদেরকে বাধা না দেয়, তাহলে অন্যদেরকে ধ্বংস করবে। নিজেদেরকেও হালাক করবে। (বুখারী, হাদীস: ২৪৯৩)
এই উদাহরণ দ্বারা স্পষ্ট হয় যে, সমাজে এমন লোকের উপস্থিতি অত্যন্ত আবশ্যক, যারা শুধু নিজেরা খারাপ থেকে বেঁচে থাকবে না। বরং অন্যদেরকেও বিরত রাখবে। আর খারাপ কাজের সঙ্গে আপোষ ও নমনিয়তা প্রদর্শন করবে না। তা নাহলে অসৎ কাজের সঙ্গে আপোষ ও নমনিয়তা মহান আল্লাহর গযবকে আহ্বান করার সমার্থক। মহান রাব্বুল আলামীন আল্লাহ হেফাজত করুন। আমীন। (আহসানুল বয়ান : ৩১৮-৩১৯)
সূত্র: ভারতীয় লেখক মাওলানা মুহাম্মদ কামরুজ্জামান নদভীর কলাম অবলম্বনে।