কক্সবাজার প্রতিনিধি::
দক্ষিণ চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ বিদ্যাপীঠ এবং কক্সবাজারে স্বীকৃত প্রথম জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভূক্ত কলেজ কক্সবাজার সরকারি কলেজ।কক্সবাজার সদর উপজেলার ঝিলংঝা ইউনিয়নের মুহুরীপাড়ায় অবস্থিত কলেজটির মোট শিক্ষার্থী ১০ হাজার ২০৫ জন। বিপুলসংখ্যক এই শিক্ষার্থীকে পড়ানোর জন্য শিক্ষকের পদ আছে একেবারে নগন্য। হিসেব মতে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর গড় অনুপাত দাঁড়ায় মাত্র ১:২১৭!
এইবার (২০১৭) এইচএসসিতে কক্সবাজার জেলার মধ্যে বরাবরের মত শীর্ষস্থান দখল এবং বোর্ডে অন্যতম উপরের সারিতে থাকা কলেজটিতে পুরোনো কাঠামো মানলেও এই মুহূর্তে কমপক্ষে ৯৮ জন শিক্ষক থাকা দরকার। কিন্তু সরকারের কাছে বারবার শিক্ষক চেয়েও পাচ্ছে না কলেজটি। শিক্ষকসংকটের কারণে প্রতিদিনই শিক্ষকদের ক্লাস করাতে হিমশিম খেতে হয়।
একদিকে শিক্ষক সংকট, অন্যদিকে কলেজের কোন শিক্ষক সরকারি নিয়মে অন্য কলেজে নিয়োগপ্রাপ্ত হলে শূন্যপদে শিক্ষক আসতে লেগে যায় দীর্ঘসময়। যার ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা।
গণিত বিভাগের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী মিনহাজ উদ্দিন বলেন, “শিক্ষক কম থাকায় নিয়মিত ক্লাসের শিডিউলেও অনেক সময় ক্লাস মিস হয়ে যায়।” শুধুই গণিত বিভাগেই এখন প্রায় ৪০০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক আছে মাত্র ৩ জন!
শুধু শিক্ষকসংকট নয়, আবাসন ও পরিবহনসংকট তীব্র। মোট শিক্ষার্থীর প্রায় অর্ধেক ছাত্র ও অর্ধেক ছাত্রী শহরের বাইরের এলাকার। কিন্তু ছাত্রদের জন্য নেই আবাসনের কোনো ব্যবস্থা।প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ইতিমধ্যে একটি বাস উপহার দেয়া হলেও তা শুধুমাত্র শহরের মধ্যেই ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষক পরিবহন করে। ফলে দূর -দূরান্তের শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে মেয়েদের কলেজ গমন অনেকটাই কষ্টকর হয়ে ওঠেছে।পরিবহনের এই সমস্যার কারণে অনেক শিক্ষার্থী হারাচ্ছে কলেজে যাওয়ার মানসিকতা।
সরেজমিনে দেখা যায়, ২৬০ জন ছাত্রী থাকার জন্য আছে পৃথক দুটি চারতলা ছাত্রীনিবাস যা মোট চাহিদার নগণ্য অনুপাত!
এছাড়া উল্লেখ করার মত নেই কোন মিলনায়তন ও কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার।
কলেজের অধ্যক্ষ এ কে এম ফজলুল করিম চৌধুরী ইতিমধ্যে অনেকবার বলেছেন, কলেজের লেখাপড়া ও ফলাফল ভালো হলেও আছে সমস্যার পাহাড়। দুর্গম এলাকার গরীব ছাত্রদের জন্য ২০০ আসনের একটি পাঁচতলা ভবন নির্মাণের জন্য কয়েক বছর ধরে লেখালেখি হচ্ছে, কিন্তু কাজ হচ্ছে না। শূন্যপদে শিক্ষক নিয়োগ ও শ্রেণিকেক্ষর সংকট দূর করতে পাঁচতলাবিশিষ্ট পৃথক দুটি একাডেমিক ভবন নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে অনেক আগে। এ ছাড়া শিক্ষকদের থাকার জন্য একটি ডরমিটরি, ক্যাম্পাসে একটি শহীদ মিনার ও মিলনায়তন দরকার।
১৯৬২ সালে প্রায় ১৮ দশমিক ৭৪ একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত কলেজ ক্যাম্পাসটি সবুজে ঘেরা। ৪৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে কলেজটির যাত্রা শুরু হয়েছিল। ১৯৮০ সালে কলেজটি জাতীয়করণ হয়। এখন উচ্চমাধ্যমিক ছাড়াও স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে শিক্ষার্থী পড়ানো হয়।
এতদিন ১০টি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও চারটি বিষয়ে স্নাতকোত্তর পড়ানো হলেও সম্প্রতি আরও কয়েকটি (পদার্থ,রসায়ন, প্রাণিবিজ্ঞান) বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) চাল হয়েছে এই বছর থেকে।
এছাড়াও এই বছর থেকে নতুন করে ব্যবস্থাপনা, গণিত ও উদ্ভিদ বিজ্ঞান এ স্নাতকোত্তর চালু হতে যাচ্ছে।সেই সাথে প্রত্যেক বিভাগের জন্য ২ জন করে মোট ৬ জন শিক্ষকের নতুন পদ সৃস্টি হচ্ছে।
স্নাতকের জন্য যেখানে কলেজ পাচ্ছে না পর্যাপ্ত শিক্ষক সেখানে স্নাতকোত্তর চালুর পর শিক্ষক শূন্যতা আদৌ কমবে কিনা সেটা দেখার বিষয়।
আবাসন ও পরিবহন সমস্যা বিষয়ে অনার্স ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী জিহাদ বলেন, আবাসন সমস্যার কারণে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে প্রতিদিন পড়াশোনার জন্য তাঁকে কুতুবদিয়া থেকে কলেজে আসা–যাওয়া করতে হচ্ছে। কারণ, শহরে আত্মীয়-স্বজন নেই।
উখিয়া থেকে আসা ছাত্র আরফাত ও রফিক বলেন, ১০০ কিলোমিটার দূর থেকে কলেজে আসা–যাওয়ার বিপরীতে প্রতিদিন খরচ হচ্ছে প্রায় ৩০০ টাকা। অথচ ছাত্রদের জন্য কোনো ছাত্রাবাস নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই কলেজে জেলার টেকনাফ, উখিয়া, সাগরদ্বীপ মহেশখালী, কুতুবদিয়া উপজেলা ছাড়াও তিন পার্বত্য জেলার শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করছেন। কিন্তু কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য পর্যাপ্ত পরিবহন নেই।
১৯৯১ সালে ইউএনএইচসিআর একটি চেয়ার কোচ দান করলেও সেটিও এখন অচল। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি বাস উপহার দিলেও সেটি কেবল শহরের মধ্যে চলাচল করে। ইতিবাচক দিক কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা জানালেন, সমস্যা থাকলেও কলেজের ফলাফল ভালো হচ্ছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক (পাস), স্নাতক (সম্মান) এবং স্নাতকোত্তর পরীক্ষাসমূহে প্রতিবছর শিক্ষার্থীরা ভালো ফলাফল করছেন। তবে এই ভালো ফলের পেছনে কলেজের পাশাপাশি প্রাইভেট ও কোচিং বড় ভূমিকা রাখছে।
এ ছাড়া ওই জেলার তুলনামূলক ভালো ফল করা শিক্ষার্থীরা এই কলেজে ভর্তি হন—এটাও ভালো ফলের একটি কারণ।