ঢাকা : বনানীতে ধর্ষণের শিকার দু`জন মেয়ের একজন বলেছেন, তারা জানেন তাদেরকে লোকে পতিতা বলবে, তাদের জন্যে তাদের পরিবার লজ্জা পাবে, ভাই-বোন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সহসা তাদের বিয়ে হবে না,...এমনকি জীবনও খোঁয়া যেতে পারে- তবুও তারা অনলাইনে ভিডিও ছড়াবার আশঙ্কায় চুপ থাকতে পারেনি।
একটু মাথা খাটালেই বুঝতে অসুবিধা হয় না, তারা বর্তমানে ট্রমাতে থেকেও ভাবছেন ভবিষ্যৎ জীবনের নিরাপওাহীনতা এবং সামাজিক সমস্যা কিভাবে তাদেরকে ঘায়েল করবে সেসব নিয়ে। যার দায়ভার তাদের নয়, কিন্তু ভুগছেন তারা। যে সময়ে তাদের উচিত শুধু বর্তমান শারীরিক ও মানসিক সমস্যা কাটিয়ে উঠতে ফোকাস করা, সেখানে একটি একচোখা সমাজে বসবাসের কারণে নিরপরাধী হয়েও তাদেরকে সমাজের চাপিয়ে দেয়া নানাদিক নিয়ে ভাবতে হচ্ছে।
কেননা তারা মেয়ে হয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন, ধর্ষণের কথা প্রকাশ করে দিয়েছেন, অগণিত মেয়েকে ভবিষ্যত ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। শুধু কি তাই?
তারা কি দেশের স্বর্ণ চোরাচালানের কথা ফাঁস করে দিয়ে দেশকে কোটি টাকা পাবার ব্যবস্হা করে দেননি? তারা কি ঢাকার হোটেলগুলোতে মেয়েদের নিরাপওাহীনতার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেননি?
সমাজ কি জানে না হোটেলগুলোতে কি চলে? স্বর্ণ ব্যবসায় লাভ কোথায়? বিশ খুনের খবর শুনেও তারা দ্বিতীয় দফায় ধর্ষিতা হওয়াকে রোধ করতে হুমকিকে থোরাই কেয়ার করে, মৃত্যুকে পরোয়া না করে সামনে হেঁটেছেন।
অনভিজ্ঞ বাচ্চাদুটি মেয়ের যেটুকু শক্তি ছিল, যেটুকু বুদ্ধি ছিল, শুধু সেটুকুকে সম্বল করে তাকে সাহস এবং সততার মাধ্যমে হাজার গুণ বাড়িয়ে তারা একাই সামনে অগ্রসর হয়েছেন। ধর্ষক তাদেরকে লজ্জিত হতে বলেছে, পুলিশ লজ্জিত হতে বলেছে, আর তারা পদে পদে নারী জীবনের লজ্জিত হবার ব্যাখ্যা শুনে হোঁচোট খেয়েছেন, অবাক হয়েছেন কিন্তু মুশরে পড়েননি।
শুরুতে পুলিশের সহযোগিতা না পেলেও হাল ছাড়েননি, জিতবেন না জেনেও সামনে এগিয়েছেন। যতটা তাদের সাধ্য তার চেয়েও বেশী সাহস নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এক সময় তারা ধর্ষকদ্বয়ের পা ধরেও বসেছিলেন শুধু যেনো তৃতীয় মেয়েটিকে তারা ধর্ষণ না করে। আবার বান্ধবীদের দু`জনও একজন আরেকজনকে আপ্রাণ বাঁচাতে চেয়েছেন, যেনো একজন ধর্ষিতা হলেও আরেকজন না হন। এমনকি সেই আফসোস এখনও তাদের কথায় ফুঁটে ওঠে যখন বলেন, ‘নিজেও বাঁচতে পারলাম না, বান্ধবীকেও বাঁচাতে পারলাম না।’
বেশ কিছু দিন আগে একটা ঘটনা আমাদের জানা যেখানে, এক মায়ের সামনে যখন তার বাচ্চা মেয়েটিকে একদল যুবক ধর্ষণ করছিল, মা তখন সামনে গিয়ে ধর্ষকদের বলেছিলেন, ‘বাবারা আমার মেয়েটি অনেক ছোট, ওকে ছেড়ে দাও, বিনিময়ে আমাকে না হয় ধর্ষণ করো!’
নিজের অসহনীয় ক্ষতি হবার পরও আরেকটি মেয়েকে বাঁচাতে বনানীর এই মেয়ে দু`টিরও ধর্ষকদের পা ধরে বসে থাকাতেও কি সেই মায়েরই আরেকটি রূপ ফুঁটে ওঠেনি? ধর্ষণের সময়টিতেও তারা ধর্ষণ থামাতে, তাদের বিবেক জাগ্রত করতে বলেছেন, তোমার বাবাকে বলবো, পুলিশকে বলবো, বন্ধ করো- তবুও ওরা থামেনি।
ধর্ষকদের মা জানতেন, ছেলে তার অহরহ ধর্ষণ করে বেড়ায়, এতে কত মেয়ের সর্বনাশ ঘটে? এমনকি ছেলেরও এইডস হতে পারে- তবুও টু শব্দটি করেননি তিনি। ধর্ষকের সাবেক বউও জানতেন, হোটেলে মেয়েদের ধর্ষিতা হবার কথা কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেননি। সন্তানের ভালোবাসায় বিভোর বাবাও জানতো, ছেলে তার ধর্ষণে মাতে। তবু ছেলের অহরহ মদ্যপ হওয়া এবং এইডস বা জেল হবার বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামায়নি সে, বরং উল্টা আরও পথ করে দিয়েছে। অন্যের মেয়ের সর্বনাশের সাথে সাথে নিজের ছেলেকেও সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
হোটেল কর্তৃপক্ষও দিনের পর দিন ধর্ষণকে দেখেও না দেখার ভান করে চলেছে। অথচ বাংলাদেশে পতিতাবৃত্তি বৈধ, চাইলেই তারা তেমন মেয়েও জোগাতে পারতো। দেশের হাজারও মেয়ে বছরের পর বছর জেনে-শুনে ধর্ষকের সঙ্গে সংসার করে এবং কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে বর বা ছেলেকে সুযোগ করে দেয় অন্যের মেয়ে/বউকে নিয়ে ধর্ষণে মাততে। সমাজে এমনই ঘটছে বছরের পর বছর ধরে। কেননা এতে সমাজ তাদেরকে ভাবে সন্মানিত নারী, তাদের সহনশীলতাকে শ্রদ্ধা দেখা; আর নিজের ক্ষতির সাথে সাথে ক্ষতি হয় অসংখ্য মেয়ের।
দুঃখের কথা যে, বনানীর মেয়ে দু`টির কপালে আর এমন বর জুটবে না। তারা আর রাতের পর রাত ধর্ষিতা হবে না। কেননা একরাতের ধর্ষণকে তারা মেনে নিতে পারেনি, নারী পুরুষের গোপন কথা হজম করতে পারেনি, কি করে সমাজে তাদের বিয়ে হয়? সেই সহনশীলতা কই তাদের? তাদের কি কোনো লজ্জা আছে? চেপে গেলে লোকে কি কখনও জিজ্ঞেস করতো, ধর্ষক শরীরের কোথায় কোথায় হাত দিয়েছে? নাকি, জানতো? কেমন করে ধরেছে? তুমি কি করছিলে? টাকার চুক্তি হয়েছিল কি-না? বয়ফ্রেন্ডের সংখ্যা কত? আগেও ছেলেদের সাথে শোয়া হয়েছে কি-না? সেক্স করেছো কি-না? কেমন লেগেছে? কতবার সেক্স করেছো? ইত্যদি ইত্যাদি কত কথা।
এখন ধর্ষিতার যৌবন, যোনি, শরীরের আঁকবাক, উত্থান, পরনের কাপড়, রাতের বেলায় দাওয়াতে যাওয়া, ছেলে বন্ধু থাকা না থাকা... সবকিছু নিয়ে প্রশ্ন করে উকিল সাহেব, দেশেবাসী, সমাজ তাদেরকে লজ্জা দেবে, কেন, কেন, কেন? ধর্ষকের সাথে বিয়েতে লজ্জা নেই, ধর্ষণে লজ্জা নেই? যত লজ্জা সব ধর্ষিতার!
তোমরা কিন্তু একটুও লজ্জা পেয়ো না। যে সমাজ ব্যবস্হায় পুরুষ ধর্ষণ করে বুক ফুলিয়ে চলে; যে সমাজে কোনো নারীর দিনে/রাতে বাইরে যাওয়া মানেই ধর্ষণ জায়েজ; যে সমাজে নারীর পোষাক একটু হেলে গেলেই পুরুষের হুশ হারিয়ে যায়; যে সমাজে বিয়ে করে বছরের পর বছর স্বামী ধর্ষণ করতে পর নারীর খোঁজে ঘোষণা দিয়ে বাইরে বেরুলেও সমাজ ধর্ষকের নয়, ধর্ষিতার লজ্জা মনে করে- সেই সমাজে প্রতিটি নারীই কম/বেশী ধর্ষিতা।
বড়ই দুঃখের সাথে জানাতে হচ্ছে, হয়ত নাঈম, সাফাত, সাফাতের বাবা অথবা বনানী থানার ঐ পুলিশ অফিসারের মত বর ধর্ষিতাদ্বয় পাবে না। যারা মেয়েদের মন বোঝে না, কদর বোঝে না, কষ্ট বোঝে না- তেমন বর জুটলেই বা কি হতো? তখনতো ধর্ষণ ঘটতো রাতের পর রাত ধরে- কখনও কাজে, কখনও বা কথায়, নাইবা হলো তেমন বিয়ে! জীবনে চলার পথে মিলবে তেমনই কেউ যারা তাদেরকে নয়নের আলো ভেবে চোখের তারা করে রাখবে। তারা তেমনই শ্রদ্ধার পাত্রী- এদের মত মেয়েরাই সমাজে পরিবর্তন ঘটায়। মানুষকে মানুষ হতে শেখায়। এখনও সমাজে বিধবা, তালাকপ্রাপ্তা বা ধর্ষিতা নারীর ভার্জিনিটি খোঁয়া যাওয়ায় দিনের আলোতে তাদেরকে পাশে নিয়ে হাঁটলে পুরুষ লোকের ইজ্জত চলে যায় অথচ রাতের অন্ধকারে তারাই আবার ওদের দিকে হাত বাড়ায়।
সমাজ এসব বোঝে সবই, তবু চুপ থাকে- দেখে এবং হাসে। কেননা মেয়েদের দমিয়ে রাখতে দলবদ্ধভাবে এটা সমাজের একটি কূটকৌশল। মেয়েদেরকেই বের হয়ে আসতে হবে চাপিয়ে দেয়া এই অদৃশ্য শিকলের কবল থেকে। দর্শন একটিই, লজ্জাজনক বিষয় লিঙ্গভিত্তিক নয়, নারীর দেহ এবং যৌনজীবন কোনো লজ্জার বস্তু নয়।
লেখক : আমেরিকান প্রবাসী সমাজকর্মী