লালমাটিয়া সিটি হসপিটালের সামনে তখন অনেক ভিড়। রাজকন্যার মতো দেখতে ছোট্ট দুই শিশু রূপকথা আর চন্দ্রকথা মাঝে মাঝেই কেঁদে উঠছে। তাদের বৃথা শান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছেন একজন মধ্যবয়সী নারী। বৌদির চোখদুটিও ফোলা, মাঝে মাঝেই ডুকরে কেঁদে উঠছেন। এখানে সেখানে জটলা করে আছেন অনেকেই। মৃতের আত্মীয়, বন্ধু, স্বজন, আর আছেন ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিছু লেখক, যারা তাঁর বন্ধু ছিলেন। সবারই মুখ বিষন্ন। উপস্থিত ব্লগ লেখক জুলফিকার জুবায়ের, জাহেদ উর রহমান, সুকান্ত কুমার সাহা, মঞ্জুর মোর্শেদ এর চোখ লাল। ব্লগপোষক আইরিন সুলতানা মাঝে মাঝেই চশমার ফাঁকে চোখ মুছছেন।
ভিড় কেবল বাড়ছেই। আর বাড়ছে অপেক্ষা। কখন লাশ নামবে, শেষ বারের মতো একটিবার দেখার অনাকাঙ্খিত প্রতীক্ষা। এরই মাঝে একজন তরুণী এসে দাদা… বলে চিৎকার করে উঠলেন। তিনি যখন বিলাপ করে বলছিলেন ‘আমি দাদার লাশ দেখতে আসিনি, তোমরা আমার জীবন্ত দাদাকে এনে দেখাও।’ এতোক্ষণ ধরে চেপে রাখা শোককে আর সামলানো গেলোনা, অশ্রুর ফোটারা ঝরে পড়তে শুরু করলো সব বাধাকে তুচ্ছজ্ঞান করে। আসলে আমিও ওই শোকাহত বোনের মতোই মৃত উৎপল চক্রবর্তীকে কখনোই দেখতে চাইনি। আমি চাইনি আমার স্মৃতিতে জেগে থাকা হাস্যোজ্জ্বল একটি চেহারা মুছে গিয়ে প্রাণহীণ পাংশু কোনো মুখ জায়গা করে নিক। পাশের বন্ধুকে বললাম- বাইরে যাবো।
লেখক সোহরাব সুমন। তাঁকে নিয়েই একটু আড়ালে চলে গেলাম। যেখানে আঁধার কিছুটা ঘন হয়ে আছে। বলা যায় নিজেকে লুকালাম। কেউ যেন চোখের পানিটা দেখতে না পায়। নিজেকে সামলে নিয়ে বন্ধুর কাছে মৃত্যুর পরের অবস্খা সম্পর্কে জানতে চাইলাম। কথা শুনে যতোদূর বুঝলাম বিষয়টা নানা জনের ভাষ্যে নানান রকম। মনে মনে ভাবছিলাম উৎপলের আত্মা এখন কোথায়? সেকি স্বর্গে? নাকি আমাদের আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর মজা নিচ্ছে। তার স্বভাবসূলভ কৌতুকে ভরা উচ্ছল হাসি দিয়ে বলছে- ‘আমাকে বাদ দিয়ে আড্ডা হচ্ছিলো না? শেষ পর্যন্ত আমার কাছেই আসতে হলো সবাইকে। আসো, এবার আড্ডা মারি আর ম্যারাথন সিগারেট খাই, হা হা হা..।’
দূর্ঘটনাটা ঘটেছে ৩০ এপ্রিল। এলিফ্যান্ট রোডে নিজে অফিসের এসির সিলিন্ডার বিস্ফোরণে অন্য ৩ জনের সাথে অগ্নীদগ্ধ হন তিনি। সাথে সাথে তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। স্বভাবতই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম। নারায়নগঞ্জ থেকে ঢাকা মেডিকেলে ছুটে এসেছিলেন নিতাই বাবু, এসেছিলেন জুলফিকার জোবায়ের, সব কাজ ফেলে দিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন আইরিন সুলতানা। কিন্তু রোগীকে আইসিইউতে রাখার কারণে কারোরই পক্ষে ভেতরে যাওয়া সম্ভব হয়নি। সুতরাং গিয়ে একইভাবে ফিরে আসতে হবে ভেবে আর যাইনি। কিন্তু মাঝে মাঝেই খবর নিচ্ছিলাম, অনেকে ব্লগেও লিখছিলেন তার উন্নতির কথা জানিয়ে। মনে মনে আশ্বস্ত হয়েছিলাম।
আজ ছিলো রমনায় ব্লগারদের কৃঞ্চচূড়া আড্ডা। গাড়িতে বসে কে যাচ্ছে না যাচ্ছে ফোনে খবর নিচ্ছিলাম। দাপ্তরিক ব্যস্ততায় নিতাই বাবু, শহীদ শওকত, জুলফিকার জোবায়ের, ফারদিনসহ আরও অনেক পরিচিত মুখ আসতে পারছেন না। ভাবছিলাম আড্ডাটা তাহলে কেমন হবে? জুলফিকার জোবায়েরকে ফোন দিয়ে অনুরোধ করলাম, তিনিও দুঃখপ্রকাশ করলেন। সেই সাথে এও বললেন- কিছুদিনের মধ্যেই উৎপল চক্রবর্তী হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাচ্ছেন। তখন তাকে নিয়ে একটা রোগমুক্তির আড্ডায় মিলিত হবো সবাই!
আড্ডার মাঝখানেই আইরিন সুলতানার ফোনটা বেজে উঠলো- কথা বলে খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর আস্তে করে বললেন ‘উৎপল চক্রবর্তী আর নেই।’ মূহূর্তেই পিন পতন নীরবতা। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম- কালো ফ্রেমের চশমার ফাঁক দিয়ে আইরিনের গাল বেয়ে ঝরে পড়ছে নোনা জল। তিনি কাঁদছেন। কতোটা সংবেদনশীল তিনি, এই প্রথম জানলাম। ভাবলাম- ক’জনইবা আছে এমন যে তার একজন ব্লগারের মৃত্যুতে অঝোরে কাঁদতে পারেন। আবার এও ভেবে অবাক হলাম, এতো অল্প সময়ে কি করে এতো মানুষের ভালোবাসা আদায় করে নিলো উৎপল? সরব আড্ডায় পানি ঢেলে দিয়ে আমরা ছুটলাম হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।
কে যেন বললো- এখুনি লাশ নামাবে। আবারো ভিতরে ঢুকলাম। ভিড় আগের চাইতে বেশি। কাউন্টারের সামনে কিছুটা জটলা। স্বজনদের অনুরোধ কিছু টাকা কনসিডার করা যায় কিনা। অনড় কর্তৃপক্ষ। বডি ল্যাঙ্গুয়েজটা এমন যে- ব্যবসার পুরো টাকাটা না বুঝে পেয়ে লাশ নিতে দিবেননা। এটিএম কার্ড নিয়ে কাকে যেন দৌড়াতে দেখলাম। ওদিকে ভিড় কেবল বাড়ছেই।
কড়কড়ে নোটগুলো পেয়ে হাসি ফুটলো কাউন্টারে বসা লোকটির চোখেমুখে। অনুমতি মিললো লাশ নামানোর। আমি ভাবছি এখন চলে গেলে কেমন হয়। লাশ দেখে যদি আবারো কান্না চলে আসে? তাছাড়া আমিতো আগে থেকেই চাচ্ছিনা মৃত উৎপলের মুখ দেখতে। তবুও দেখতে হবে? নাকি দেখতে হয়। তাড়া খেয়ে এগিয়ে যেতে হলো, জনস্রোতের সাথে।
ঝকঝকে ডেকোরেশন করা আলো ঝলমলে ফ্রন্ট গেট দিয়ে নয়, উৎপলের লাশ নামছে বেইজমেন্ট ফ্লোরের বিবর্ণ আলো্ আর আঁধারিতে। এমনই নাকি নিয়ম। দেখলাম একটা এ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। সিটটি বাইরে রাখা। কিছুক্ষণ পর কয়েকজন মিলে স্ট্রেচারে করে নামিয়ে আনলো উৎপলকে। পুরনো একটি চাদরে ঢেকে আছে পুরোটা শরীর। সদা হাস্যোজ্জ্বল চটপটে অস্থীর উৎপল কিরকম চুপচাপ শুয়ে আছে। দুই চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিনা। বোঝাতে পারছিলামনা মনকে।
একজন বললেন- ‘আপনারা লাইন করে আস্তে আস্তে এসে দেখে যান, ৪-৫ সেকেন্ডের বেশি অবস্থান করবেন না। আগে মহিলারা আসবেন।’ মনে মনে ভাবলাম- ‘আহ উৎপল, তুমি সার্থক, তোমাকে দেখতে আমাদের কিনা লাইন ধরে যেতে হচ্ছে।’
লাইন করে গিয়েই দাঁড়ালাম তাঁর মাথার পাশে। পুড়ে যাওয়া সাদা চামড়া আর ফুলে ওঠা মুখটায় খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে আমাদের উৎপল কি দারুন ঘুমাচ্ছে। যে ঘুম আর কোনদিন ভাঙ্গবে না। তার দুই চোখ ঢেকে রাখা হয়েছে অজানা কোনো এক গাছের সবুজ পাতা দিয়ে। চোখটা সরিয়ে নিলাম। মনে মনে ঈশ্বরের দিব্যি করে বললাম- ‘ সত্যি, আমরা এমন মুখ কখনোই দেখতে চাইনি উৎপল চক্রবর্তীর।’
লেখক: ডিবিসি নিউজে কর্মরত।
পাঠকের মতামত