এটি প্রকাশের প্রাক্কালে ক্রাইসিস গ্রুপের কাছ থেকে প্রতিবেদনটির খসড়া পেয়েছে কালের কণ্ঠ। সেখানে বলা হয়েছে, ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাহীনতা, সহায়তা কমে যাওয়া এবং প্রত্যাবাসনে অচলাবস্থা—এই তিনটি বিষয় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বিষয়গুলো এমন এক সংকট তৈরি করেছে, যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
ক্রাইসিস গ্রুপ বলেছে, চীনের সহযোগিতায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার কিছু রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ক্রাইসিস গ্রুপের তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমারসহ রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের গণহারে বাস্তুচ্যুত হওয়ার ছয় বছর পরও পরিস্থিতি তাদের ফেরার কাছাকাছি পর্যায়েও নেই। আর এমন সময় বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কমছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈধভাবে এ দেশে রোহিঙ্গাদের কাজের সুযোগ না থাকায় তারা অবৈধভাবে কাজ করতে গিয়ে নানা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। আবার অনেকে এই পরিস্থিতি এড়াতে বিপজ্জনক জেনেও অবৈধভাবে সাগরপথে অন্য দেশে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করছে।
এ ছাড়া ১০ লাখ রোহিঙ্গার আশ্রয়শিবিরে সংঘাত, বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর উপস্থিতি, স্থানীয়দের সম্পৃক্ততায় মাদক চোরাচালান এবং রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে জোর করে অর্থ আদায়ের বিষয়টিও উঠে এসেছে ক্রাইসিস গ্রুপের গবেষণা প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়েছে, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর লড়াই এবং ত্রাণ সহায়তা কমে আসায় সেখানকার খারাপ পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে।
ঢাকা ও নেপিডো শরণার্থীদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিরাজমান নিরাপত্তাহীনতা এবং নাগরিকত্ব ও অন্যান্য সুরক্ষার বিষয়ে স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি না থাকায় বড়সংখ্যক রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি অবাস্তব।
ক্রাইসিস গ্রুপ প্রতিবেদনে বলেছে, শিবিরের বাইরে রোহিঙ্গাদের চলাফেরা এবং কাজ করার ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা আছে। ত্রাণ সহায়তা সংস্থাগুলোর কর্মকাণ্ড সংকুচিত হওয়া মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার কাজও জটিল করে তুলেছে।
অবনতিশীল পরিস্থিতি রোহিঙ্গা শিবিরে
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১২ মাসে প্রতিদ্বন্দ্বী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর আধিপত্যের লড়াইয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণের কক্সবাজার জেলায় বিস্তীর্ণ জায়গাজুড়ে এলোমেলোভাবে গড়ে ওঠা শরণার্থীশিবিরগুলো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। একসময়ের প্রভাবশালী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ) এবং রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) মতো গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে লড়াইয়ে বেশ কিছুসংখ্যক শরণার্থী নিহত হয়েছে। মুক্তিপণের জন্য শরণার্থীদের অপহরণ করছে সশস্ত্র গোষ্ঠী ও অপরাধী চক্রগুলো।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অপহরণের ঘটনা ২০২৩ সালে প্রায় চার গুণ বেড়েছে। আগে যেখানে সহিংসতা শুধু রাতের বেলায় ঘটত, জঙ্গিরা এখন ছুরি এবং স্থানীয়ভাবে তৈরি বন্দুক নিয়ে দিনের বেলায় শিবিরে ঘুরে বেড়ায়। তারা বাসিন্দাদের হুমকি দিচ্ছে আর প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রাণ নিতেও দ্বিধা করছে না।
প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা শিবিরে সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কিছু সদস্যের বিরুদ্ধেও কিছু অভিযোগ তোলা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সহায়তা কমছে
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ বলেছে, রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা প্রদানে সাড়াদানের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সমর্থন-সহযোগিতা কমছে। ২০২২ সালে জাতিসংঘের মানবিক আবেদনে মাত্র ৬৩ শতাংশ অর্থ পাওয়া গেছে। আর ২০২৩ সালে অর্থ সহায়তার প্রতিশ্রুতি আরো কমেছে। এর ফলে মানবিক সংস্থাগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবাগুলো থেকে পিছিয়ে আসতে হয়েছে।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডাব্লিউএফপি) দুবার খাদ্য রেশনের পরিমাণ কমাতে বাধ্য হয়েছে। প্রতি মাসে জনপ্রতি ১২ মার্কিন ডলার থেকে কমিয়ে আট ডলার করা হয়েছে, যা এক দিনে ২৭ সেন্ট করে পড়ে।
আদালতকে দেখাতে প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায় মিয়ানমার জান্তা
ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা দ্য হেগে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আইসিজে) চলমান জেনোসাইড মামলায় রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে নিজের আন্তরিকতা দেখাতে কিছু রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে চায়। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক চাপ কমানোও জান্তার লক্ষ্য। তবে খুব বেশি রোহিঙ্গা মিয়ানমার ফিরিয়ে নিতে চায় না। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাই-বাছাইয়ের সময় এরই মধ্যে এক-তৃতীয়াংশকেই রাখাইনের বাসিন্দা বলে অস্বীকার করেছে।
স্বার্থ আছে চীনেরও
ক্রাইসিস গ্রুপ বলছে, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সহযোগিতার মাধ্যে চীনের স্বার্থ আছে। ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় ঢাকা ও নেপিডোর সঙ্গে বেইজিংয়ের সম্পর্ক আরো জোরদারে এই মধ্যস্থতার উদ্যোগ ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীন—তিন দেশই নিজ নিজ স্বার্থে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায়।
সুপারিশ
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ তার সুপারিশে বলেছে, মানবিক সহায়তায় সাড়াদানের ক্ষেত্রে নিজেদের সমর্থন আরো বৃদ্ধির মাধ্যমে বিদেশি সরকারগুলো আশ্রিত রোহিঙ্গাদের আশু স্বস্তির ব্যবস্থা করতে পারে।
একই সঙ্গে, দীর্ঘস্থায়ী সংকটের সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে দাতাদের সহযোগিতায় ত্রাণ সহায়তা দক্ষতা ও আশ্রিত রোহিঙ্গাদের স্বনির্ভরতা বাড়াতে ঢাকার উচিত নিজেদের নীতি-কৌশলে সমন্বয় সাধন করা। শরণার্থীশিবিরগুলোতে আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানোর বিষয়টিও খতিয়ে দেখা উচিত।
পাঠকের মতামত