ডেস্ক নিউজ
প্রকাশিত: ০৪/০৭/২০২৩ ৭:০০ এএম

সমকাল::
ছয় মাস পরই জাতীয় নির্বাচন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এই নির্বাচনকে প্রশাসনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে। সম্প্রতি বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় প্রশাসনের শীর্ষকর্তাদের সঙ্গে নির্বাচিত সরকারদলীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিবিদদের দ্বন্দ্বের প্রকাশ্য মঞ্চায়ন হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ করে উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনওদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব যাতে প্রকাশ্যে না হয়, তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যেও সুসম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়ে জোর দেওয়া হয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রশাসনের শীর্ষমহল থেকে এসব কড়া নির্দেশ আসে। প্রধানমন্ত্রীও এর আগে ডিসি সম্মেলনে একই ধরনের নির্দেশনা দেন।

গত ২২ জুন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ৬৪ জেলার ডিসিদের সঙ্গে এক ভার্চুয়াল বৈঠক করে। নির্বাচনী বছরে মাঠ প্রশাসনকে বুঝেশুনে কাজ করার নির্দেশটি সেই বৈঠক থেকেই দেওয়া। বৈঠকে অংশ নেওয়া অন্তত চার কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব বিষয় জানা গেছে।
স্থানীয় বিরোধ মেটাতে হবে সাধারণত এ ধরনের বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব। তিনি হজ পালনে সৌদি আরবে থাকায় সেদিনের বৈঠকের সভাপতি ছিলেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সমন্বয় ও সংস্কার সচিব মাহমুদুল হোসাইন খান। ডিসিদের নিয়ে এ বৈঠকের তিন দিন আগে অর্থাৎ ১৯ জুন চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলা চেয়ারম্যান এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. রাব্বুল হোসেনকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হয়। এর আগে বরিশালে বিগত মেয়রের পক্ষের লোকদের ইউএনওর বাসভবনে হামলার ঘটনা জাতীয় আলোচনার বিষয় হয়। তবে প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তাও যাতে এমন ধরনের ঘটনায় জড়িয়ে না পড়েন, তা নিশ্চিত করায় গুরুত্ব দিচ্ছেন প্রশাসনের নীতিনির্ধারকরা। স্থানীয় বিরোধ মিটিয়ে ফেলার বিষয়েও বিশেষ গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে মাঠ প্রশাসনকে।

শুধু ভোলাহাট নয়, বিভিন্ন সময়ে বরিশাল, ফরিদপুর, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনওদের দ্বন্দ্ব জাতীয় মনোযোগে এসেছে। নির্বাচনের আগে তেমন কোনো পরিস্থিতি দেখতে চায় না সরকার। এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন সমকালকে বলেন, ‘একজন কর্মকর্তা সম্পর্কে জনপ্রতিনিধির এমন মন্তব্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। চরম আপত্তিকর এ বিষয়টি জানার পর আমরা স্থানীয় সরকার বিভাগকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছি।’ এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, নির্বাচনী বছর হোক বা না হোক, কারও পক্ষ থেকে এমন আচরণ করার সুযোগ নেই। স্থানীয় সরকার নির্বাহী বিভাগের অংশ– তাদের এটা মনে রাখতে হবে।

এ বিষয়ে তিনজন বিভাগীয় কমিশনার ও ডিসির সঙ্গে কথা বললে তাঁরা জানান, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রতিনিধি এবং স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়ের বিষয়টি সবসময়েই নির্দেশনায় থাকে। তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটের ঘটনার পর এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সঙ্গে সর্বশেষ বৈঠকে আবারও গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছে। এই বার্তা ইউএনওসহ জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অবহিত করা হয়েছে।

প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহজেই পদক্ষেপ নেওয়া যায়, নেওয়াও হচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিক চ্যানেল থেকেও এমন বার্তা যাওয়া দরকার। কারণ দু’পক্ষ সংযম না দেখালে মাঠ ঠিক রাখা কঠিন হবে।

প্রসঙ্গত, গত ১ মার্চ ফকিরহাট উপজেলায় ইউএনওর গাড়িতে ধাক্কা লাগায় মোটরসাইকেল আরোহী সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানকে মারধর এবং গাড়িতে তুলে অকথ্য ভাষায় গালাগালের অভিযোগ উঠেছিল ইউএনও মনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে। পরে ইউএনওকে ওই উপজেলা থেকে প্রত্যাহার করে নেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ২০২১ সালের আগস্টে বরিশালের সদর উপজেলার ইউএনওর বাসায় হামলা ও গুলি ছিল বর্তমান সরকার আমলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের মধ্যে দ্বন্দ্বের অন্যতম বড় ঘটনা। ওই ঘটনার পর প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন’–এর পক্ষ থেকে নজিরবিহীন ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছিল। মাঠ প্রশাসনে মূল দ্বন্দ্ব প্রকাশ হয় উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনওদের মধ্যে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হারুন-আর-রশীদ হাওলাদার বলেন, উপজেলায় কোনো দ্বন্দ্ব হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। তাঁর নেতৃত্বে উপজেলা পরিষদ চলবে, সংবিধান অনুযায়ী বিদ্যমান বিদ্যমান আইন-বিধি তাই আছে। কিন্তু উপজেলা চেয়ারম্যানদের সেভাবে দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হচ্ছে না। উচ্চ আদালতে গিয়ে আমাদের (উপজেলা চেয়ারম্যানদের) অধিকার চাইতে হচ্ছে। এটা তো প্রত্যাশিত নয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রশাসনের কর্মকর্তারা চান– জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানরা যেভাবে দায়িত্ব পালন করছেন, তেমনিভাবে উপজেলা চেয়ারম্যানরাও দায়িত্ব পালন করুক। কিন্তু আইনি কাঠামোতে উপজেলা চেয়ারম্যানরা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের মতো দুর্বল নন। তাই তাঁরা জেলা পরিষদের অবস্থানে যেতে চান না। এ কারণেই বিভিন্ন বিষয়ে ইউএনওদের সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যানদের চাপা দ্বন্দ্ব প্রায় সব উপজেলাতেই দেখা যায়। নির্বাচনী মাঠে নবীন কর্মকর্তারা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তুলনামূলক নতুন ডিসি এবং ইউএনওরা দায়িত্ব পালন করবেন। ৬৪ জেলার ডিসিদের মধ্যে বর্তমানে পুরোনো ডিসি আছেন ২০ জন। তাঁরা প্রশাসনের ২২ ব্যাচের কর্মকর্তা। আগামী জুলাই মাসের মধ্যে তাঁদের পদোন্নতি হওয়ার আগে অথবা পরে জেলা থেকে উঠিয়ে নেওয়া হবে। এই জায়গাগুলো পূরণ করবে প্রশাসনের ২৫ ও ২৭ ব্যাচের কর্মকর্তারা। অর্থাৎ নির্বাচনের মাত্র পাঁচ মাস আগে এসব কর্মকর্তা মাঠের দায়িত্ব নেবেন। অবশ্য মাঠ প্রশাসনে সাধারণত দুই থেকে তিন বছর কোনো পদে দায়িত্ব পালনের পর স্বাভাবিক বদলি করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিন বছরের বেশি সময়ও দায়িত্ব পালনের সুযোগ পান অনেকে। বাকি থাকা ৪০ জেলার ডিসিদের মধ্যে প্রশাসনের ২৪ ব্যাচের কর্মকর্তা ২৯ ও ২৫ ব্যাচের আছেন ১৫ জন। তাঁদের কারও ডিসি পদে বয়স এক বছর কারওবা এক বছরের কম। নির্বাচনকালে ইউএনও পদেও নবীন কর্মকর্তাদের সংখ্যাই বেশি থাকবে। বর্তমানে ইউএনও পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ২৫০ জনের মতো কর্মকর্তা আছেন প্রশাসনের ৩৪ ব্যাচের। দেড় বছর আগে থেকে নিয়োগ শুরু হওয়া এ ব্যাচের কর্মকর্তারা নির্বাচনকালে বড় আকারের দায়িত্ব পালন করবেন।

২০২০ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ইউএনও হয়ে মাঠে যাওয়া প্রশাসনের ৩৩ ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যে ২৬০ জনের মতো ইউএনও নিয়োগ পেয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে দুই-আড়াই বছর দায়িত্ব পালন করছেন এমন ৫০ জনের মতো ইউএনওকে মাঠ থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। চলতি জুলাই মাস থেকে আর ১০০-এর মতো এ ব্যাচের কর্মকর্তাকে সরিয়ে আনা হতে পারে। অন্যদিকে ইউএনও হিসেবে মাঠে যাওয়া শুরু হয়েছে প্রশাসনের ৩৫ ব্যাচের কর্মকর্তাদের। এ ব্যাচের ১৫০ জনের মতো কর্মকর্তাকে ইউএনও হিসেবে পদায়নের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। এরই মধ্যে এ ব্যাচের অন্তত ৫০ জনকে ইউএনও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আরও প্রায় ১০০ জনকে নিয়োগের প্রস্তুতি চলছে। অর্থাৎ ৩৩ ব্যাচের বেশিরভাগ ইউএনওকে উঠিয়ে এনে ৩৫ ব্যাচের কর্মকর্তাদের মাঠে পাঠানো হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিয়ম অনুযায়ী ৩৩ ব্যাচের প্রায় সব কর্মকর্তাকেই মাঠ থেকে তুলে নেওয়ার সময় হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন সামনে রেখে একবারে সবাইকে তোলা নাও হতে পারে। অর্থাৎ ৩৩, ৩৪ ও ৩৫ ব্যাচের কর্মকর্তারাই নির্বাচনকালে ইউএনও হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি থাকবেন ৩৪ ব্যাচের কর্মকর্তারা। আইনের অস্পষ্টতার কারণে সমস্যা মাঠ প্রশাসনে কাজ করে আসা অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের মতে, নির্বাচনকালে নবীন কর্মকর্তাদের মাঠে থাকা ভালো-মন্দ দুই দিকই আছে। নবীনদের স্থানীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে জড়াতে সময় লাগে। তাই দ্বন্দ্বেও তাঁরা থাকেন কম। তবে নির্বাচনী মাঠের আচরণ বুঝতে অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদেরও প্রয়োজন আছে। তাই নতুন ও পুরোনো মিলিয়ে প্রশাসন সাজানোর দিকেই মনোযোগ থাকবে সরকারের।

সাবেক সচিব ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ আবু আলম মো. শহিদ খান মনে করেন, জনপ্রতিনিধি এবং সরকারি কর্মকর্তারা আইনবিধি অনুযায়ী নিজেদের দায়িত্ব পালন করলে সমস্যা হয় না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আইনবিধিতে কিছু অস্পষ্টতা আছে বা আইনে যা আছে, তা বাস্তবায়ন হচ্ছে অন্যভাবে। কিছু বিষয় আদালতে বিচারাধীন– এসব কারণেই মাঠ প্রশাসনে সমস্যা তৈরি হয়। শীর্ষ পর্যায় থেকে এসব বিষয় গুরুত্ব দিয়ে সমাধান না করলে সমস্যা ধামাচাপা দিয়ে চলা কঠিন হবে।

পাঠকের মতামত

ন্যূনতম খাদ্য গ্রহণে খরচ করতে হচ্ছে দারিদ্র্যসীমার ব্যয়ের চেয়ে প্রায় ৭০% বেশি

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে সুস্থভাবে জীবনধারণের জন্য প্রতিদিন যে পরিমাণ খাদ্যশক্তি (২ হাজার ১০০ ...

রোহিঙ্গাদের আত্তীকরণের পক্ষে নয় বাংলাদেশ: পররাষ্ট্র সচিব

রোহিঙ্গাদের আত্তীকরণ বাংলাদেশের জন্য বিবেচনাযোগ্য বিকল্প নয় বলে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) ঢাকা প্রধান ল্যান্স ...