রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানা মত থাকলেও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি পুরোদমে এগিয়ে নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। দফায় দফায় বৈঠক, মতবিনিময়, কর্মশালাসহ নানা কর্মসূচিতে ব্যস্ত দিন পার করছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্য কমিশনাররা। ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও এখন নির্বাচনকেন্দ্রিক কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। সার্বিক প্রস্তুতি শেষে আগামী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেই তপশিল ঘোষণা করা হবে বলে জানা গেছে।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এরই মধ্যে নির্বাচনী প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শেষ হয়েছে। প্রশিক্ষণ চলছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং নির্বাচনী কর্মকর্তাদের। আগামী শনিবার শুরু হচ্ছে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের প্রশিক্ষণ। নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনাকাটার কাজও শেষ পর্যায়ে। এ মাসের মধ্যেই শতভাগ কেনাকাটা সম্পন্ন হবে।
ইসি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার জন্য ইসির হাতে খুব বেশি সময় বাকি নেই। তপশিল ঘোষণার আগে যাবতীয় প্রস্তুতিও প্রায় সেরে ফেলেছে ইসি। জাতির উদ্দেশে ভাষণের মাধ্যমে তপশিল ঘোষণা করবেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। তার আগে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ভোটের তপশিলের ব্যাপারে অবহিত করবে হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন।
সূত্র জানায়, আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দেশের দুই বড় রাজনৈতিক দলের মধ্যে এখনো কোনো ধরনের সমঝোতার সম্ভাবনা দেখা না গেলেও শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করবে কমিশন। তবে সর্বশেষ কোনো সমঝোতা না হলে সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী অগ্রসর হবে কমিশন। সেক্ষেত্রে কোনো দল নির্বাচনে না এলেও তাদের কোনো কিছু করার থাকবে না। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালসহ অন্য কমিশনাররা এরই মধ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদের সাংবিধানিক দায়িত্বের কথা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন।
সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জন্য চলতি সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিন অর্থাৎ, ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। সেক্ষেত্রে ১ নভেম্বর শুরু হচ্ছে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ক্ষণগণনা। আর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভোট গ্রহণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে সব প্রস্তুতি সারছে কমিশন।
নির্বাচন কর্মকর্তারা বলছেন, প্রথা অনুযায়ী ভোটের তারিখের আগে ৪৫-৬০ দিন সময় রেখে তপশিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। এক্ষেত্রে মনোনয়নপত্র জমা, বাছাই, প্রত্যাহারের সময় ও প্রতীক বরাদ্দের পর প্রচারের জন্য সময় রাখা হয়। আগের নির্বাচনগুলোর রীতি অনুযায়ী প্রতীক বরাদ্দের পর প্রচারণার জন্য সর্বোচ্চ তিন সপ্তাহ সময় রাখা হয়। গত ১১টি সংসদ তপশিল ঘোষণার পর মনোনয়ন জমা থেকে ভোটের তারিখ পর্যন্ত সর্বনিম্ন ৪২ দিন এবং সর্বোচ্চ ৭৮ দিন সময় রেখে তপশিল ঘোষণার নজির রয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় নিয়ে এবারের কমিশন একটু বেশি সময় হাতে রেখে তপশিল ঘোষণা করতে চায় বলে জানা গেছে।
নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেছেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী আগামী বছরের জানুয়ারির ২৯ তারিখের মধ্যে যেভাবেই হোক না কেন নির্বাচন হতে হবে। কারণ তা না হলে একটি সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হবে। সেই গ্যাপ তৈরি হলে দেশে একটা অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। সেটি তো নির্বাচন কমিশন হতে দিতে পারে না।’
ইসি ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী, এরই মধ্যে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে। আইনি কাঠামোর সংস্কারও হয়েছে। যদিও এতে ইসির ক্ষমতা হ্রাস-বৃদ্ধি নিয়ে নানা বিতর্ক তৈরি হয়। সংসদীয় আসনের পুনর্বিন্যাসের কাজ শেষ হয়েছে। নির্বাচন সামনে রেখে এবার ১০টি আসনের সীমানায় পরিবর্তন এসেছে। নতুন দলের নিবন্ধনের কাজও শেষ হয়েছে। ভোটকেন্দ্রের খসড়া তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। এতে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ১০৩টি আর ভোটকক্ষের সংখ্যা ২ লাখ ৬১ হাজার ৯১৪টিতে। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিরীক্ষার কাজ শেষ হয়েছে।
ভোট-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণসহ আরও কিছু কাজ চলমান। তপশিল ঘোষণার পর ভোটকেন্দ্রের চূড়ান্ত তালিকা, আসনওয়ারি ভোটার তালিকার সিডি প্রস্তুত ও ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ঠিক করার কাজ চলছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে পর্যবেক্ষক নিবন্ধন প্রাথমিক ধাপ শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে আরও কিছু পর্যবেক্ষক সংস্থাকে নিবন্ধন দেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। চূড়ান্ত হয়েছে বিদেশি পর্যবেক্ষণ নীতিমালাও। একই সঙ্গে সংবাদ সংগ্রহে মোটরসাইকেলের অনুমতি দিয়ে সাংবাদিক নীতিমালাও সংশোধন করা হয়েছে। এ মুহূর্তে নির্বাচন সামনে রেখে প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনাকাটায় ব্যস্ত সময় পার করছে ইসি। এ মাসের মধ্যে এসব কেনাকাটা শেষ করতে চান দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নির্বাচনী উপকরণও সংগ্রহ শুরু করেছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি।
সংশ্লিষ্ট শাখা সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনী কাজের জন্য প্রায় ১১ ধরনের সরঞ্জাম দরকার হয়। এর মধ্যে ব্যালট পেপার, স্ট্যাম্প প্যাড, লাল গালা, মনোনয়ন ফরম, অফিসিয়াল সিল, মার্কিং সিল, ব্রাশ সিল, অমোচনীয় কালির কলম, গানি ব্যাগ, হেসিয়ান ব্যাগ (বড়), হেসিয়ান ব্যাগ (ছোট) ও স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের লক রয়েছে। এরই মধ্যে ব্যালট বাক্স, বাক্সের ঢাকনা, বিভিন্ন ধরনের সিল, কালি ও ব্যাগ কেনার দরপত্র হয়ে গেছে।
সূত্র জানায়, নির্বাচনের জন্য মোট ৮০ হাজার ব্যালট বাক্স কেনা হচ্ছে। এবার ব্যালট বাক্স ও ঢাকনা দেশীয় প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেই কিনছে ইসি, যা আগে বিদেশ থেকে আনা হতো। সেপ্টেম্বরে ৪০ হাজার ও অক্টোবরে ৪০ হাজার বালট বাক্স ইসির হাতে পৌঁছবে। এগুলো সঙ্গে সঙ্গেই মাঠপর্যায়ে পাঠানো হবে। অন্যদিকে ১ লাখ ৬১ হাজার রিম বা ৩২ লাখ ২০ হাজার দিস্তা কাগজ কেনার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। এসব কাগজ দিয়ে তৈরি হবে ব্যালট পেপার, বিভিন্ন ধরনের খাম ও প্যাড। তপশিল ঘোষণার পর ব্যালট পেপারের কাগজ সংগ্রহ করা হবে ও প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্ধারিত সময় শেষে হবে মুদ্রণের কাজ।
ইসি সূত্র জানায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে সম্প্রতি ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে নির্বাচন কমিশন। সেখানে নির্বাচনের প্রস্তুতির পাশাপাশি সম্ভাব্য ব্যয়ের হিসাবও তুলে ধরা হয়। এবার প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা এবং পোলিং কর্মকর্তাদের দুই দিনের সম্মানী ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে ওই বৈঠকে। আগের নির্বাচনগুলোতে তাদের এক দিনের ভাতা দেওয়া হতো। পাশাপাশি জ্বালানি খরচও এবার বাড়বে। নির্বাচনী দায়িত্বে থাকবেন ৯ লাখের বেশি সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা। নির্বাচনী সরঞ্জাম কেনাকাটা, নির্বাচনে বিভিন্ন দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ভাতা মিলিয়ে এবার প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা খরচ হবে। এর বাইরে নির্বাচনী প্রশিক্ষণে খরচ হবে প্রায় ১০০ কোটি টাকার বেশি। যদিও প্রাথমিকভাবে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, গত একাদশ সংসদ নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য মিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত ছিলেন মোট ৬ লাখ ৮ হাজার সদস্য। নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড ও আনসার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে ভোটকেন্দ্রে থাকেন পুলিশ ও আনসার সদস্যরা। ভোটকেন্দ্রের বাইরে থাকে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ডের মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স। নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হলে মোট খরচ আরও বাড়বে। সশস্ত্র বাহিনী সাধারণত মোতায়েন করা হয় স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে। তবে এবার সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা হবে কি না, সে সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। সেজন্য এ খাতে ব্যয়ও এখন পর্যন্ত ধরা হয়নি।
এদিকে প্রার্থীদের মনোয়নপত্র দাখিলে বাধাদান ঠেকাতে এবার অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। সেইসঙ্গে ই-ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অনলাইনে জামানতের টাকা পরিশোধেরও সুযোগ থাকবে। অন্যদিকে ভোটকেন্দ্রের নাম ও ভোটার নম্বর খুঁজে পাওয়ার ভোগান্তি কমাতে ‘বাংলাদেশ ইলেকশন অ্যাপ’ নামে একটি অ্যাপ তৈরি করছে কমিশন। এই অ্যাপে ভোটারের তথ্যের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের জন্য রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার, ডিসি, এসপি, ওসিসহ নির্বাচনকেন্দ্রিক বিভিন্ন দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের পরিচয়, ফোন নম্বর দেওয়া থাকবে।
ভোটের সার্বিক প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ কালবেলাকে বলেন, ‘দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সব ধরনের প্রস্তুতি চলছে। সার্বিক কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক। এরই মধ্যে নির্বাচনী উপকরণ আসা শুরু হয়েছে। আশা করছি, নভেম্বরের মধ্যেই সব উপকরণ হাতে পাব।’
এবারের ভোটে প্রযুক্তিগত দিক থেকে কিছু নতুনত্ব থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অনলাইন নমিনেশনের পেপার জমা দেওয়ার ব্যবস্থার সঙ্গে আরও ছয়টি মডিউল আছে। এতে স্মার্টফোনে অ্যাপ ডাউনলোড করে এনআইডি নম্বর দিলে ভোটার নম্বর, কেন্দ্রের নাম জানতে পারবেন ভোটাররা।’
নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (ইটিআই) মহাপরিচালক এস এম আসাদুজ্জামান বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সেপ্টেম্বরে প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে ভোটের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। ভোটের এক সপ্তাহ আগ পর্যন্ত ১০ লাখের মতো ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এ ছাড়া মাঠ প্রশাসনকেও প্রশিক্ষণের আওতায় এনেছে ইটিআই। এরই মধ্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও বিভাগীয় কমিশনাররাও এ প্রশিক্ষণের আওতায় রয়েছে।
উল্লেখ্য, সর্বশেষ হালনাগাদ অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ভোটার সংখ্যা ১১ কোটি ৯০ লাখ ৬১ হাজার ১৫৮ জন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা মিলিয়ে ১০-১২ লাখের মতো জনবল বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবেন।
সুত্র: কালবেলা