হজরত নূহ আলাইহিস সালামের সময়ের প্লাবনের কাহিনীর মিলে যায় গ্রিক, মিসর, ভারত ও চীনের প্রাচীন সাহিত্যের সঙ্গে। বার্মা, মালয়েশিয়া, পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলেও এ ধরনের কিংবদন্তি প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে।
এর আলোকে পরিষ্কার বোঝা যায়, এ কাহিনী এমন এক যুগের, যখন গোটা মানবগোষ্ঠী কোনো একটি ভূখণ্ডেই বসবাস করত। যে জুদি পাহাড়ে হজরত নূহ আলাইহিস সালামের নৌকা এসে থেমেছিল, তা কুর্দিস্তান অঞ্চলে ইবনে ওমর দ্বীপের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত।
বিজ্ঞাপন
বাইবেলে এ নৌকার অবতরণের স্থানের নাম বলা হয়েছে আরারাত। আরারাত নামের এ পর্বতমালা আরমেনিয়া থেকে শুরু হয়ে দক্ষিণে কুর্দিস্তান পর্যন্ত চলে গেছে। এ পর্বতপুঞ্জের একটি পাহাড়ের নাম জুদি। এটি আজও জুদি নামে খ্যাত।
হজরত নূহ আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ নৌকা বানানোর নির্দেশের কথা পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে এভাবে
বিজ্ঞাপন
فَاَوۡحَیۡنَاۤ اِلَیۡهِ اَنِ اصۡنَعِ الۡفُلۡکَ بِاَعۡیُنِنَا وَ وَحۡیِنَا فَاِذَا جَآءَ اَمۡرُنَا وَ فَارَ التَّنُّوۡرُ ۙ فَاسۡلُکۡ فِیۡهَا مِنۡ کُلٍّ زَوۡجَیۡنِ اثۡنَیۡنِ وَ اَهۡلَکَ اِلَّا مَنۡ سَبَقَ عَلَیۡهِ الۡقَوۡلُ مِنۡهُمۡ ۚ وَ لَا تُخَاطِبۡنِیۡ فِی الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡا ۚ اِنَّهُمۡ مُّغۡرَقُوۡنَ
‘তুমি একটি নৌকা তৈরি করো। এরপর যখন আমার আদেশ আসবে এবং চুল্লি প্লাবিত হবে, তখন নৌকায় তুলে নেবে প্রত্যেক জীবের একেক জোড়া এবং তোমার পরিবারবর্গকে, তাদের মধ্যে যাদের বিপক্ষে পূর্বে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তাদের ছাড়া। এবং তুমি জালেমদের সম্পর্কে আমাকে কিছু বলবে না। নিশ্চয় তারা নিমজ্জিত হবে।’ (সূরা মুমিনুন, (২৩), আয়াত, ২৭)
নূহ আ. নৌকা বানিয়েছিলেন যেভাবে
হজরত নূহ আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তায়ালা যখন নৌকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছিলেন তখন তিনি নিজেও নৌকা চিনতেন না এবং নৌকা সম্পর্কে কিছু জানতেন না। আল্লাহ তায়ালা নিজেই তাকে নৌকা তৈরির পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছিলেন ওহীর মাধ্যমে। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, আর আপনি নৌকা তৈরি করুন আমার তত্ত্বাবধানে ও ওহীর অনুসারে।
হাদিসে শরিফে বর্ণিত হয়েছে, নৌকা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ ও নির্মাণ কৌশল ওহীর মাধ্যমে হজরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম হজরত নূহ আলাইহিস সালামকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। তিনি শাল কাঠ দিয়ে এই নৌকা তৈরি করেছিলেন।
কোনো ঐতিহাসিক সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, নৌকাটি ৩০০ গজ দীর্ঘ, ৫০ গজ প্রস্থ, ৩০ গজ উঁচু ও তিনতলা বিশিষ্ট ছিল। এর দুই পার্শ্বে অনেকগুলি জানালা ছিল। এভাবে ওহীর মাধমে হজরত নূহ আলাইহিস সালামের হাতে নৌকা ও জাহান নির্মাণ শিল্পের গোড়াপত্তন হয়েছিল। এরপর যুগে যুগে তার উন্নতি সাধিত হয়েছে।
নৌকায় যাদের উঠানো হয়
নৌকা বানানোর পর হজরত নূহ আলাইহিস সালামকে প্রত্যেক প্রাণীর এক এক জোড়া করে নৌকায় তুলে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে নূহ আলাইহিস সালামের নৌকায় পৃথিবীর সব প্রাণী তোলা হয়নি। বরং যেসব প্রাণী স্ত্রী-পুরুষের মিলনের মাধ্যমে জন্ম হয় এবং পানির মধ্যে বেঁচে থাকতে পারে না, শুধু সেসব প্রাণী ও পশু-পাখি উঠানো হয়েছিল। জলজ প্রাণী উঠানো হয়নি।
ডাঙ্গায় যেসব প্রাণী পুরুষ-স্ত্রীর মিলন ছাড়াই জন্ম নেয় তাও বাদ পড়েছে। যেমন, পোকা-মাকড়, কীট পতঙ্গ। শূধু গরু, ছাগল, ঘোড়া, গাধা ইত্যাদি গৃহপালিত প্রয়োজনীয় পশু-পাখি নৌকাতে উঠানো হয়েছিলো।
এরপর নূহ আলাইহিস সালামকে বেঈমান কাফেরদের বাদ দিয়ে শুধু ঈমানদারদেরকে তোলার নির্দেশ দেওয়া হয়। সে সময় আল্লাহর ওপর ঈমান আনা মানুষের সংখ্যা একেবারে কম ছিল।
আরোহীদের সংখ্যা
নৌকায় আরোহণকারীদের সঠিক সংখ্যা কোরআন ও হাদিসে নির্দিষ্ট করে কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। তবে হজরত আব্দূল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, নূহ আলাইহিস সালামের নৌকায় আরোহীদের মোট সংখ্যা ছিল ৮০ জন। যাদের মধ্যে হজরত নূহ আলাইহিস সালামের তিন ছেলে হাম, সাম, ইয়াফেস ও তাদের তিনজন স্ত্রীও ছিল। নূহ আলাইহিস সালামে চতুর্থ ছেলে আল্লাহ তায়ালার ওপর বিশ্বাস না রাখায় সেও কাফেরদের সঙ্গে প্লাবনে ডুবে মারা যায়।
(সূরা হুদ, সূরা নূহ, সূরা মুমিনুন, তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন, ৪/৬০৫)