প্রাণ বাঁচাতে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে লম্বাশিয়ায় এসেছিলাম। ঘণ জঙ্গল সাফ করে ছাউনি দিয়ে রাত কাটানোর ব্যবস্থাও হয়েছিল। কিন্তু দিনের বেলায় সেই ছাউনির নিচে বসবাস করা খুব কঠিন ছিলো। প্রচণ্ড গরমে আমাদের সন্তানেরা ছটফট করতো। আমার স্ত্রী তো বলেই দিয়েছিল এভাবে বসবাস করা সম্ভব নয়। তাপমাত্রা কমাতে এরপরই আমরা গাছ রোপনের সিদ্ধান্ত নিই। এখন তো দেখতেই পাচ্ছেন কতটা সবুজ, কতটা স্বস্তিতে আমরা বসবাস করছি। এভাবেই নিজেদের পরিবেশ সবুজে মোড়ানোর গল্প বলছিলেন কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের আজমত উল্লাহ।
এই আশ্রয় শিবিরে আসার আগের জীবনের সঙ্গে তো আর মিলবে না কিছুই এই আক্ষেপও করলেন তিনি।
শুধু আছমত উল্লাহই নয়, এমন হাজার মানুষের প্রচেষ্টা আর জাতিসংঘের শরনার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার অর্থায়নে প্রকৃতির সাজে সজ্জিত হচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প।
পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ২০১৮ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উখিয়া ও টেকনাফে ৮ হাজার ১৬৩ একর বনভূমি রোহিঙ্গারা উজাড় করেছে। এর মধ্যে রোহিঙ্গারা জ্বালানি মেটাতে ৪ হাজার ২৭ একর সৃজিত বনভূমি ধ্বংস করা হয়েছে। আর বসতি স্থাপন করতে গিয়ে ৪ হাজার ১৩৬ একর ভূমিকে ন্যাড়া করে দিয়েছে। এ ন্যাড়া বনগুলোকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে সরকারের নির্দেশে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো বিভিন্ন ভাবে পদক্ষেপ নিয়ে গাছ রোপনে রোহিঙ্গাদের উৎসাহিত করছে।
সম্প্রতি মধুরছড়া, লম্বাশিয়া ঘুরে দেখা যায় রোহিঙ্গাদের বাড়ির আনাচে কানাচে গড়ে উঠেছে ফলদ, বনজ ও ওষুধি গাছ।
ক্যাম্প ৮ডব্লিউ এর বাসিন্দা আলম শাহ (২৮) জানান, প্রকৃতির সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে আমরা বেঁচে আছি। ক্যাম্পে আসার পর কয়েক বছরে আমরা প্রচন্ড তাপমাত্রায় যে কষ্ট পেয়েছি এখন তা আর মনে পড়ে না। তিনি আরো জানান, এনজিও সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর উৎসাহে রোহিঙ্গারা বাড়ির আনাচে কানাচে গাছ লাগিয়েছে এবং তা সংরক্ষণ করায় গাছগুলোও বেড়ে উঠেছে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্প ১৩ এর ছফুরা খাতুন বলেন, আগে এই ক্যাম্পে দম বন্ধ হয়ে আসতো। এখন পরিবেশ উন্নয়নের ফলে প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে পারছি। পরিবেশগত কারণে ক্যাম্পের রোগ ব্যধি পর্যন্ত কমে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এক ইঞ্চি পরিমাণও জমিও খালি পড়ে থাকবে না অদূর ভবিষ্যতে। তিনি আরও বলেন, আমরা একসময় চলেই যাবো কিন্তু আমাদের রোপন করা গাছগুলো রোহিঙ্গাদের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে থাকবে।
তিনি আরও বলেন, এখানকার প্রকৃতির উন্নয়নের নেপথ্যে এনজিও সংস্থাগুলোর অবদান অস্বীকার করা যায় না। কেননা তারা যদি ঘরে ঘরে গ্যাস সিলিন্ডার সরবরাহ না করতো তাহলে জ্বালানীর জন্যই হাহাকার লেগে যেতো, ধ্বংস হতো প্রাণ প্রকৃতি। রোপন করা গাছ দিয়ে জ্বালানি হিসেবে রান্না বান্নার কাজ করতো রোহিঙ্গারা। তাহলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এ রকম প্রাকৃতিক পরিবেশ উন্নয়নে চিন্তা করা কঠিন ছিল।
ক্যাম্প ১৮ এর রোহিঙ্গা শিশু ছাবের(১২) জানান, নতুন নতুন ক্যাম্পে বসবাস করার পরে গরমের জন্য কোথাও খেলতে পারতাম না৷ এখন ক্যাম্পে (সরৎ) ছায়া আছে৷ গাছের নিচে বসে বসে খেলাধুলা করতে পারতেছি৷
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজে নিয়োজিত উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি মনির জানান, মূলত তিনি কাজ করছেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পরিবেশের উন্নয়নে। এখন ক্যাম্প এলাকায় জীববৈচিত্রে ভরপুর, পাখির কলকাকলি মুখর। কিভাব এটা সম্ভব হলো ব্যাখ্যায় তিনি বলেন- আশ্রয় কেন্দ্রের ফাঁকা জায়গাগুলোতে প্লট আকারে গাছ রোপন করা হয়েছে। এছাড়া প্রায় শতাধিক প্লটে ২ কোটির উপরে গাছের চারা উৎপাদন করা হয়েছে। এসব রোহিঙ্গাদের মধ্যে সরবরাহ করা হবে। তারা যেন এ গাছগুলো তাদের বাড়ির আঙ্গিনায় বা আনাচে কানাচে রোপন করে তা নিশ্চিত করা হবে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, গাছপালা রোপনের কারণে ক্যাম্পের পরিবেশের আমূল পরিবর্তন হয়েছে। বেশ কিছু উন্নয়ন সংস্থা এই সবুজায়নে চমৎকার ভূমিকা রেখেছে উল্লেক করে তিনি বলেন, রোহিঙ্গারাও এই কাজে সহযোগিতা করেছে। সবার প্রচেষ্টায় আজ রোহিঙ্গা ক্যাম্প সবুজে ছেয়ে গেছে। এখন ক্যাম্প পরিদর্শন করলে আগের মত অস্বস্তি লাগে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
উখিয়া উপজেলা বনরেঞ্জ কর্মকর্তা কাজী শফিউল আলম বলেন, এনজিও সংস্থার সহায়তায় রোহিঙ্গাদের সামগ্রিক উদ্যোগ ক্যাম্পগুলো সবুজায়ন হতে শুরু করেছে। এতে জীববৈচিত্র্যের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে দেশকে মুক্ত রাখতে সহায়ক হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
পাঠকের মতামত