রফিক উল্লাহ::
পছন্দ ও অপছন্দ মাপার কোন যন্ত্র নেই আমাদের সমাজে, রাখার কোন পাত্র নেই, বুঝার কোন উপায়ও নেই। হয়তো কোন একদিন বিজ্ঞানিরা এমন যন্ত্র আবিষ্কার করে আমাদের উপহার দেবেন যেমনটি দিয়েছেন মোবাইল ফোন ফেসবুকসহ আরো কত কিছু। পছন্দের বিষয়টি আপেক্ষিকও বটে। মনের মিল আছে, দীর্ঘ পথ চলা। তাই কল্পনার মনকে নিরুৎসাহিত না করে আনন্দ পাওয়ার আশায় অনুমানে পথ চলার সামিল। কখন প্রত্যাশিত রসালো ফল পাওয়া যায়, সে প্রত্যাশায় প্রতিক্ষারও শেষ থাকে না।
তেমনি একজন অবুঝ শিশু সনি আদর্শ গ্রামে তার পিতা-মাতার কুলে বড় হতেছিল। বাড়ির সামনে স্কুল, ঘুম থেকে ওঠে হাত মুখ না ধুয়ে ও না মুছতেই বই খাতা ঘুছাতে ব্যস্ত থাকে শিশু সনি। মা তার এক রূম থেকে অন্য রূমে চলার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়। ছেলে স্কুলে যাবে। মুখ হাত ধৌত করানোর পর স্কুলের জন্য প্রস্তুত করিয়ে টেবিলে নাস্তা দেয়া হয়েছে। ছেলে বুঝে না স্কুলে যাওয়ার পূর্বে কিছু খেতে হয়, সে স্কুলে যাওয়ার পূর্বে কিছুই খাবে না। মায়ের মন মানে না। অনেক কষ্টের পর সামান্য করে খাওয়ানো, তারপর ব্যাগ ঘুছিয়ে স্কুলে পাঠানো। একদিন সে ছোট্ট শিশু অনেক বড় হয়। সে পরিপক্ষ, মাবাবার আদরের সন্তান পরস্পরকে পছন্দ করে অনেক। মা-বাবর বয়স বাড়তে থাকে। দাদা-দাদি নাতিকে নিয়ে বিভিন্ন কথা, হাসা-হাসি করে। প্রতিবেশীরাও সনিকে নিয়ে কল্পনার শেষ নেই। বাবার পুরোনো ব্যবসায় সময় দেয়, ব্যবসার আয় রোজগার অনেক ভাল। অন্যের চেয়ে আলাদা প্রকৃতির ছেলে সনি। দাদা-দাদি নাতির সংসার দেখে যেতে চায়। পাশের গ্রাম মনিপুরে যাওয়ার রাস্তা তেমন ভাল না। দাদা-দাদির অনেক পুরোনো পরিচিত গ্রাম। ঐ গ্রামে অনেক সুন্দর পুকুর, চাষের জমি, খেলার মাঠ আছে। গ্রামটি একটু ভিন্ন প্রকৃতির। মনিপুর গ্রামের অশি মিয়া তার জমিজমা চাষে সারাদিন ব্যাস্ত থাকে। ছেলে মেয়েও কম নয়। তার ছেলে মেয়ে সামান্য স্কুলে পড়ে বাবার কাজে সাহায্য করে। আয় বাড়ছে, জমিজমাও বেড়েছে। পাড়ার সরদারি করে পাশের গ্রামেও তাকে ভালভাবে চেনে কমবেশি সবাই। নাম ডাক আছে অশি মিয়ার। তার মেয়ে শেউলি সময় অসময়ে ধান ক্ষেতের আইলে, ঝড়, বৃষ্টি ও রোধে দৌড় ঝাপ দেয়। মা বাবার আদুরের সন্তান তার কাজকে সংসারে লোকজন পছন্দ করে বেশি। শেউলি মায়ের ঘর সামলনোর কাজ বেশ পছন্দ করে। মাকে মাঝে মাঝে সংসারের কাজে সাহায্য করে। পাড়ার লোকজন অনেকে শেউলির সমালোচনা করে। মেয়ে বড় হচ্ছে বিয়ে না দিয়ে খালে বিলে দৌড়ে বেড়ায়, অনেকের ছোখে পড়ে। শেউলির পরণে নতুন জামা, পায়ে নতুন স্যান্ডেল তাও আবার গোলাপি রঙয়ের, মাথার চুলে অন্য রকম খোপা বেঁধেছে। মুখে নানা রকমের কসমেটিকস দিয়ে সাজগোজ। তাকে আজ অপরুপ লাগছে। বড় ভাই সময় এর সাথে মার্কেটে যাবে। শেউলির কল্পনার শেষ নেই। মার্কেটে কি কিনবে, তাতে লোকজনে দেখলে কি বলবে। বাড়ি থেকে সামান্য হাটার পথ, বর্ষার শেষের দিকে, বৃষ্টি মাঝে মধ্যে পড়ে। কাদা মাখা সে পথ এখনো ভাল করে শুকোয়নি। রাস্তার দুপারে পাহাড়ি ও গ্রামের জঙ্গলের শেষ নেই। রাস্তার একটি বাঁক শেষ হলে অন্য বাঁকে বড় ভাইকে দেখার কোন উপায় নেই। বড় ভাই এর হাত ধরে বাড়ি হতে বের হয়েছে, বড় ভাই বেশি সময় হাত ধরে থাকলে অস্বস্তি লাগে শেউলির। তাই বড় ভাই এর হাত হতে মাঝে মধ্যে টেনে ছেড়ে নেয় শেউলি। জঙ্গলে ঝি-ঝি পোকার ডাক, কর্দমাক্ত রাস্তা, চলার পথে পা পিছলিয়ে পড়ার কারণে বড় ভাই এর বকোনি খেয়েছে একবার। তাপরও ভাই এর হাত ধরবে না। একা চলতে বড় ভাল লাগে তার। নতুন স্যান্ডেলে কাঁদা মাটি লেগেছে, শেউলির মন খারাপ। বড় ভাই মাঝে মধ্যে পেছনে ফিরে থাকায়। আবার সজোরে ডাক দেয় সময় কম, তাড়াতাড়ি মার্কেটে যেতে হবে। ওড়তি যৌবন চলার পথে কোন বন্ধুর পথ চেয়ে আছে বলে মনে হয় না শেউলির। কল্পনা করতে করতে তার সাথে বড় ভাই আছে বলে ভুলে যায়। সামান্য সময় পর পর গ্রামের অনেক লোকজন একই রাস্তা দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় শেউলিকে দেখে। পরিচিত অনেকেই তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে। পরক্ষণে বড় ভাইকে দেখে কথা বলার সাহস করে না। শেউলি তার কল্পনার ও পছন্দের জিনিষের জন্য ব্যাকুল হয়ে হাটছে সেই পথ। পথ কিন্তু শেষ হয় না, কখন যে সে পথ শেষ হবে। মর্কেটে যাবে, বড় ভাই এর পছন্দ না তার পছন্দমত কেনা কাটা করবে কল্পনার শেষ নেই। মেটো পথ, দু’পাশে ছোট ছোট গাছে নানা ধরণের ফুল ফোটেছে। মৌমাছি, প্রজাপতি, ফড়িং সেই ফুলের উপর বসে ফুলের আকর্ষণ ও পরস্পরের ভালবাসার স্বাধ গ্রহণ করে সামান্য সময়ে ওঠে চলে যায়। শেউলিও নানা রকম চিন্তা করে। জীবন কি কখনো এমন হতে পারে। পাশের বাড়ির ছেলে রোমন তার স্কুলের বন্ধু তাকে বলেছিল সঙ্গি যদি ভাল না হয় তাহলে ফুলের বাগানে লাল গোলাপের উপর মৌমাছি বসার মত হতে পারে পরবর্তী জীবন। এমন কথাও শেউলির মনে পড়ে হাটার সময়। বড় ভাই শেউলিকে তাড়াতাড়ি হাটার জন্য বকা ঝকাও করে। কিন্তু পথের শেষ নেই।
সনির গ্রামে নানা রঙের দালান কোঠায় ভরপুর, শহরতলী বলা যায়। তার বাবা সুন্দর করে তার পছন্দমত দালান তৈরি করেছেন। সনি অবসর সময়ে গ্রামে গঞ্জে, শহরে ঘুরেবেড়াতে পছন্দ করে। তার ছোট বোন সদ্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছে। ছোট বোনকে স্কুলে পৌঁছে দিত হবে। মোটর বাইকের পেছেনে ছোট বোনকে নিয়ে শুভপুর স্কুলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে সাত সকালে। স্কুলে তার নতুন যোগদান। মোটর বাইকে চড়ার সময় তার কতই না চিন্তা হয়। নতুন স্কুল, বিল্ডিং আছে কিনা, শুনেছে অনেক ছাত্র-ছাত্রী। তাদের আচরণ কেমন হবে, প্রথম দিন কি পড়াত হবে, প্রধান শিক্ষক কেমন হবেন, সহপাটি শিক্ষগণ তার সাথে কেমন ব্যবহার করবেন। এমন সব চিন্তা তার মনে। চিন্তার চোখ দু’টো এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায় আর কল্পনা করে। এমনি একসময় একটি দ্রæত চলন্ত রিক্সার দিকে তার নজর পড়ে। অতি সুন্দরী একটি মেয়ে কোন এক ছেলের সাথে রিক্সায় ঘুরে বেড়ায়। তখন তার চোখ রিক্সার দিকে। বড় ভাই এর জন্য মেয়ে দেখতে হবে, এমনই মেয়ে প্রয়োজন। মোটর বাইকের পেছনে বাঁকা করে বসা সনির ছোট বোন শেউলির দিকে চোক পড়ার সাথে সাথে শেউলির নজরও সনির চোখ এড়াতে পারেনি। মুচকি হাসি দু’জনেই। সনির ছোট বোন বড় ভাইকে হাতরে আঙ্গুল দিয়ে সজোরে গুতো দেয়। সামন্যের জন্য মোটর বাইক থেকে যেন পড়ে যায়নি সনি।
নানা রকম চিন্তা, নানা ধরণের কল্পনা, মনের ধারণাকে বেশি বেশি পুঞ্জিভুত করে। বাড়ি ফেরা হল শেউলির। বড় ভাই শেউলিকে তার পছন্দের অনেক মার্কেটিং করে দিয়েছে। সেসকল মূল্যবান মার্কেটিং এর দিকে তেমন খেয়াল নেই। গ্রাম থেকে শহরে আসা, শহরের বাড়ি ঘর অনেক সুন্দর ও পছন্দের। বিদ্যৎ আছে, টিভি আছে, দালানের ছাদে উঠে পাশের বাড়িসহ নানা ধরণে দৃশ্য দেখা যায়। বাড়িতে পৌঁছে তার কল্পনার শেষ নেই। বান্ধবির বাসায় গিয়ে গল্প করে, গল্প আর শেষ হয় না। দিন যায়, রাত যায়, মাঝে মাঝে বান্ধবিকে চিমটি দেয়। কল্পনার মানুষটি পছন্দ হয়েছে সে কথা মুখ খুলে বলতে পারে না। সনির বাবা খোজ খবর নিতে থাকে। পার্শ্ববর্তী তাদের গ্রাম। সকলই জানাশোনা। গ্রামের মুরব্বিরা ঘটকালী করেন। ঘটক মজু চাচার প্রস্তাবে শেউলির বাবা রাজি হলেন। যাচায় বাছাই করতে করতে একদিন বিয়ের কথা পাঁকাপুক্ত হল। অয়োজন অনেক। ছেলের পক্ষ তাদের পছন্দের বউ ঘরে তুলবে, আনন্দের শেষ নেই। ছেলে পক্ষের বাড়িতে রংবেরঙের সাজগোজ, গরু কেনা, খাশি, মুরগি, দামি বাবুর্চি দিয়ে রান্না করাতে হবে। শহর হতে ডেকোরেটরের লোক ঠিক করা হয়। দেখতে সবার পছন্দ হয় এমন অনেক বড় গেইট করতে হবে যেন ইতোপূর্বে অতবড় গেইট কেহ করেনি এই গ্রামে, আয়োজনও তাই। পাড়া প্রতিবেশিকে দাওয়াত দেয়া শেষ। পাড়ার মুরব্বি হাকিম সাহেব, তার কথা গ্রামের সবাই শুনে ও মানে। তার কথামত সকল কাজ সম্পন্ন করা হল। বরের বাড়িতে নানা আয়োজন, বর তার অনেক বন্ধুদের নিয়ে বসার জন্য মনোরম স্টেইজ বানানো হল। বিয়ে অনুষ্ঠানের দিন বর পক্ষ অনেক লোকজন নিয়ে কনের বাড়িতে যাবে। বর যাত্রীর সম্মুখে ব্যান্ড পার্টি থাকবে, বিয়ের সানাই বাজবে। গ্রামের বিয়ে অনুষ্ঠান বেশিরভাগ সময় দিনের বেলা হয়। সেমতে কনের বাড়িতে দিনের বেলা সকল বর যাত্রীদের খাওয়ানোর আয়োজন করা হয়। কনের সমাজের সম্ভাব্য সলকে দাওয়াত করা হয়। দাওয়াতি সকল অতিথিদের খাওয়ানোর ব্যবস্থাও করা হয়। সময়মত বর যাত্রী আসলেন, কনের পক্ষ তাদের অভ্যর্তনা জানালেন। বরের অপেক্ষার সময় পার হওয়া কঠিন। অতিথি আপ্যায়ন শেষের দিকে বর কনের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়। কনের ভাই বোন তাদের আত্বীয় স্বজন নিয়ে অভ্যর্তনা জানানোর জন্য প্রস্তুত। এর মধ্যে বিশেষ বিশেষ অতিথিদের আপ্যায়ন শুরু হতে চলছে। বিশেষ মেহমান বরের বাবা, বরের চাচা, খালু, গ্রামের সর্দার, ঘটকসহ অরো অনেকের আপ্যায়ন। কনের পক্ষে আনন্দের শেষ নেই। কনের পিতার ছোট ভাই একটু দুষ্টুমি করে কথা বলে মাঝে মধ্যে, বাড়িতে নতুন মেহমান, বিয়াই বলে কথা। তাদের খাওয়ানোর সময় বর পক্ষের মুরব্বি হাকিম সাহেবের সাথে বিয়াই বিয়াইনদের সাথে অনেক কথা বলেন, হাসি টাট্টা করেন। টেবিলে খাবার প্রস্তুত, পছন্দনীয় সব খাবার দাবার। বরের পক্ষের লোকের পছন্দমত খাবার প্রস্তুত করা হয়েছে। সবাই একসাথে খাবেন। খাবার শেষে নব বধুকে ঘরে নিয়ে যাবেন। সুন্দর করে সাজানো স্টেইজে বর কনে এক সাথে বসবে, ছবি তুলা হবে। সে ছবি অনেক দিন স্মৃতি হয়ে থাকবে। ছেলে মেয়ে, নাতি, নাতিন দেখবে। ভর দুপুর, প্রচন্ড গরম, বর পানজাবি, শেরওয়ানী পাগড়ি পরায় গলার পানি শুকিয়ে গেছে। রবকে তার শালিকারা তাজা ফুল ও ফুলের পাপড়ি দিয়ে বরণ করছেন। ফুলের পাপড়ি অনেকের চুলে, চোখে, মাথায় ও গায়ে লেগে আছে। তাদের পরণের জামা-কাপড় যেন অন্য রকম রঙএ রঙ্গিন হয়েছে। বরকে তার শালিকারা স্টেইজে উঠার পূর্ব মূহুর্তে দাড়িয়ে মিস্টি ও সরবত খাওয়াতে ব্যস্ত। কনের ছোট ভাই বোন তাদের পাওনা আদায়ে ব্যাস্ত। কনের পক্ষকে ঠকানোর জন্য বরের বন্ধুগণ ছোট ছোট নোট দিয়ে প্লেট ভর্তি করেছেন। বরের শালিকারা তাদের পাওনা এক বিন্দুও ছাড় দিতে রাজি নেই। সকল পাওনা যেন আজ আদায় করে নেবে। বরের বন্ধুগণ তাদের সাথে যত আনন্দতে মাতোয়ারা। আজ তাদের সুযোগ, কেহ কোন কিছু মনে করবে না। বর সবে অনেক চরায় উৎরায় পার হয়ে স্টেইজে উঠে বসেছেন। এমন সময় অতিথিদের খাবার টেবিলে হঠাৎ হৈচৈ, চেচামেচি, উত্তেজনা। বরের আনন্দ ¤øান হতে চলছে। বিয়ে বাড়িতে যেন আর আনন্দ নেই। ছেলে মেয়েদের এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি, চিৎকার। হাকিম সাহেব একটু তুলো রাশি এমন জেনে কনের ছোট চাচা বরের পক্ষের লোকদের দুষ্টুমি করে বলেছেন, তার ছোট বিয়াই হাকিম সাহেব ডিম ও খাসির রোস্ট খায় না বলে শুনেছেন। এ কথা বলার সাথে সাথে হাকিম সাহেব খাবার টেবিল হতে লাফ দিয়ে উটে পড়ে। তাকে কেহ কোনভাবে থামাতে পারে না। সে খাবার খাবে না, এ বিয়ে হবে না। হকিম সাহেবকে অসম্মান করা হয়েছে, তার সাথে আরো কয়েকজন যোগ দেয়। বরের পিতা-মাতাও তাকে থামাতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত হাকিম সাহেব খাবার না খেয়ে চলে যায়। এখানেই হাকিম সাহেবের রাগ থামেনি। বাড়িতে গিয়ে বরের জন্য তৈরি করা এত সুন্দর স্টেইজটি লাঠি দিয়ে ভেঙ্গে চুরমার করেন, তাজা ফুলগুলো ছিড়ে ফেলেন। অনেক দিনের, অনেক লেকের পছন্দ মুহুর্তের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। অনেকের পছন্দ হলেও কর্তা ব্যক্তি একজন যদি পছন্দ না করে তাহলে অন্যের পছন্দের কোন মূল্য নেই আমাদের সমাজে।