মুক্তিযোদ্ধা লোকমান হাকিম মাষ্টার এখন শুধুই স্মৃতি। ৭৮ বছর বয়সে সোমবার সন্ধ্যায় তিনি মৃত্যু বরণ করেছেন (ইন্না..রাজেউন)। মঙ্গলবার দুপুর ২ টায় সোনারপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার দাফন সম্পন্ন হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাবেন এটা স্বাভাবিক। সচরাচর সেটাই হয়ে আসছে এবং মুক্তিযোদ্ধা লোকমান হাকিম মাষ্টারের বেলায়ও তাই হয়েছে। তিনি গার্ডঅব অনার পেয়েছেন। উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে তার মরদেহে পুষ্পস্তাবক দিয়ে সম্মানীত করা হয়েছে। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা ছাড়াও তার জানাজায় প্রবীণ রাজনীতিবিদ বাদশা মিয়া চৌধুরী, মাহমুদুল হক চৌধুরী, রেজাউল করিম, চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী, সোলতান মাহমুদ চৌধুরী, নুরুল আমিন চেয়ারম্যান, আনোয়ার হোসেন চেয়ারম্যান, ছৈয়দ আলম চেয়ারম্যান, শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম, মুক্তিযোদ্ধা আবদু সোবাহানসহ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, আলেমসমাজ, সাংবাদিক, শ্রমিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ অংশ নেন।
জানাজা পূর্ব সংক্ষিপ্ত আলোচনায় বিশিষ্টজনরা প্রয়াত এ মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিচারণ করেন।
এ প্রজন্মের অনেকেই লোকমান হাকিম মাষ্টার সম্পর্কে তেমন জানেন না। এমনকি অনেক সমাজ সচেতন, শিক্ষিত জনরাও তার সামাজিক, রাজনৈতিক ও কর্মজীবন সম্পর্কে জ্ঞাত নয়। জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ডাকা সাড়া দিয়ে তিনি সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেন। কক্সবাজারে বঙ্গবন্ধুর আত্মগোপনকালীন সময়ে তিনি ছিলেন ঘনিষ্ঠ সহচর। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার ভক্তি, শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতা এবং মানুষের প্রতি তার প্রেম ও ত্যাগের জন্যে বঙ্গবন্ধু তার নাম দেন "পাগলা"। বঙ্গবন্ধুর এই পাগলা জীবনের শেষ বয়স পর্যন্ত পাগলের মতোই সমাজ, মানুষ ও আল্লাহকে ভালবেসে গেছেন।
লোকমান হাকিম মাষ্টার শুধুই একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ের বাইরেও সামাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি বহু প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাকে অনেকেই চেনেন রাজনীতিবিদ হিসাবে। তাও মধ্যম সারির রাজনীতিবিদ। শিক্ষক হিসাবেও পরিচিতি রয়েছে তার। তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা, অকুতোভয় যোদ্ধা। তিনি তার বড় বউ এর সাথে বুড়ো বয়সে বি এ পাস করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন মনের জোর! এ কারণে অনেকেরই অনুপ্রেরণার উৎসও ছিলেন তিনি। তবে যে পরিচয়টি সব পরিচয়কে ছাড়িয়ে যায় সেটি ছিল অনেকের কাছে অজানা। তিনি ছিলেন অালোকিত মানুষ তৈরির কারখানা সোনারপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। এমনকি ওই স্কুলের বিশাল জমিটিও দান করেছেন তিনি। পৈত্রিক অংশ হিসাবে যেটুকু জমি তিনি পেয়েছিলেন, সবই স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য দিয়ে দেন। ভিটে ছাড়া নিজের সম্পত্তি বলতে আর কিছুই ছিল না তার। এমন উদার ও মহৎ গুনের মানুষ সত্যিই বিরল। সোনারপাড়া মাদ্রাসারও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নির্লোভ এই শিক্ষানুরাগী। সারাজীবন মানুষের কল্যানে কাজ করেছেন তিনি। মানুষের অনেক সমস্যা নিয়ে তিনি দেশবিদেশও পাড়ি দিয়েছেন। এমন ঘটনাও ঘটেছে, মানুষের কাজে ঘর থেকে বের হয়ে ১৫/২০দিন ঘরেই ফিরেননি। তিনি সবসময় নিজে ঠকে অন্যদের জিতিয়ে দিয়েছেন।
সমাজ সংস্কারে লোকমান হাকিম মাষ্টারের অবধান অসীম। তিনি রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য অনেক কিছুই করেছেন। রাজনীতিতে পা রেখে রাতারাতি অনেকের ভাগ্যের পরিবর্তন হলেও নীতি ও আদর্শের পূজারী এ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সারাজীবন রাজনীতি করেও নিজের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন করাতে পারেননি। শেষ বয়সে এসেও অতিগরিবী হালে দিন কাটিয়েছেন তিনি। চলমান রাজনীতির সংস্কৃতির সাথে তাল মিলাতে না পেরে একসময় রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। মনে অনেক কষ্ট ও অভিমান থাকলেও কখনো প্রকাশ করেননি। রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার পর তিনি নামাজ কালামে মনোনিবেশ করেন। নিয়মিত নামাজ পড়তেন। দিনের অধিকাংশ সময় তিনি তসবিহ জফতেন এবং কোরআন তেলোয়াত করতেন। এমনকি নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামাজও আদায় করতেন।
ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন ৫ পুত্র ও ২ কন্যা সন্তানের জনক। ৫ সন্তানের মধ্যে একছেলে শিক্ষকতা করেন। সিভিল সার্জন অফিস ও আরআরসি অফিসে চাকরি করেন দুজন, একছেলে ব্যবসায়ী ও আরেকজন প্রবাসী। ছেলেমেয়েদের মধ্যেও পিতার মতো সততা বিদ্যমান। পিতার আদর্শকে ধারণ করে এগুচ্ছেন তারা। শিক্ষকতা, চাকরি ও ব্যবসার পাশাপাশি ছেলেমেয়েরাও সামাজিক ও মানবিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সরব থাকেন।
দেশের জন্য যুদ্ধ করে বসে থাকেননি জাতীর এ শ্রেষ্ঠ সন্তান। শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে জন্য নতুন এক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তিনি। সে যুদ্ধেও সফল একজন মানুষের নাম লোকমান হাকিম মাষ্টার।
প্রচারবিমূখ এ মানুষটির জন্য অন্তর থেকে শ্রদ্ধা। স্যালুট বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত লোকমান হাকিম।
রাসেল চৌধুরী
স্টাফ রিপোর্টার
দৈনিক মানবজমিন ও দৈনিক পূর্বদেশ।