ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রার্থী বাছাই করছে। গত দুদিনে পাঁচটি বিভাগের দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে আওয়ামী লীগের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ড। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান দলীয় সংসদ সদস্যদের (এমপি) যারা বিতর্কিত ও জনবিচ্ছিন্ন তাঁদের এবার মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে না। বয়স বেশি হওয়ার কারণেও কয়েকজন বাদ পড়ছেন। তবে বিতর্কিত হলেও নির্বাচনে জেতার মতো সাংগঠনিক ভিত্তি আছে, এমন কয়েকজন এমপি ছাড় পাচ্ছেন।
গতকাল শুক্রবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের দুই দফা বৈঠকে খুলনা, বরিশাল ও ময়মনসিংহ বিভাগের ৮১টি আসনে নৌকার প্রার্থী নির্ধারণ করা হয়েছে। ঢাকা বিভাগের প্রার্থী নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বোর্ডের একাধিক সূত্রে জানা যায়, ৮১ আসনের মধ্যে ১৫-১৭টিতে গতবারের প্রার্থীরা এবার বাদ পড়ছেন। ময়মনসিংহ, জামালপুর ও বরিশালে দুটি এবং মাগুরা, শেরপুর, বরগুনা, ভোলা, কুষ্টিয়ায় একটি করে আসনে প্রার্থী পরিবর্তন করা হচ্ছে। ময়মনসিংহে যে দুজন বাদ পড়ছেন তাঁদের মধ্যে একজনের বাবাও এমপি ছিলেন। জামালপুরে যে দুজন মনোনয়ন পাচ্ছেন না তাঁদের মধ্যে একজন আগেই গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদ হারান। নড়াইলের একটি আসনে পরিবর্তনের কথা শোনা গেলেও শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর নাও হতে পারে। ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান মাগুরার একটি আসনে দলীয় মনোনয়ন পেতে পারেন।
আগের দিন বৃহস্পতিবার তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের ৭২টি আসনে দলীয় প্রার্থী ঠিক করা হয়। ওই ৭২ আসনের মধ্যে ১০-১২টিতে বর্তমান এমপিরা বাদ পড়ছেন। মনোনয়নপ্রত্যাশী সবাইকে আগামীকাল রোববার গণভবনে মতবিনিময়ের জন্য ডাকা হয়েছে।
প্রার্থী বাছাইয়ের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী জাফর উল্লাহ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘যার জেতার সম্ভাবনা আছে, যিনি ভালো, এলাকায় থাকেন, তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন করেন তেমন প্রার্থীই আমরা চাইব।’
মনোনয়ন বোর্ডের একাধিক সদস্য জানান, বৈঠকে বর্তমান এমপি ও মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতাদের এলাকায় জনপ্রিয়তা বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে যেসব এমপির আচরণ রাজনীতিকসুলভ নয়, এলাকায় যাতায়াত নেই, দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ এবং কোন্দল সৃষ্টি করে দলকে দুর্বল করেছে, এমন কয়েকজন সংসদ সদস্য বাদ পড়েছেন। বয়োবৃদ্ধ হওয়ায় চলাচল করতে না পারা কয়েকজন এমপিও এবার মনোনয়ন পাচ্ছেন না। তবে নানা অভিযোগ সত্ত্বেও বিজয় সুনিশ্চিত এমন দুই-তিনজনকে বিশেষ বিবেচনায় আবার নৌকা দেওয়া হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল এক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘যাদের বাদ দেওয়া হয়েছে তারা ইলেক্টেবল না। উইনেবল না। জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। জনগণের কাছে যাদের গ্রহণযোগ্যতা নাই, তাদের আমরা মনোনয়ন দিচ্ছি না। এর মধ্যে নতুনরাও আছে। নির্বাচনে জিততে পারে, সেটা পুরুষ হোক আর নারী হোক আমরা তাদের মনোনয়ন দেব।’
বরিশালে বাদ পড়ছেন দুজন : দলীয় মনোনয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল জেলায় ছয়টি আসনের মধ্যে পাঁচটিতে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আছে। তাদের মধ্যে বিতর্কিত দুজন বাদ পড়ছেন। এদের একজনকে আগেই সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ করার অভিযোগে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। তাঁর স্থলে আওয়ামী লীগের এক নারী নেত্রী মনোনয়ন পাচ্ছেন। বরিশালের আরেকটি আসনের সংসদ সদস্য আগে ছাত্রলীগের শীর্ষ পদে ছিলেন। গতবারই তিনি প্রথম দলীয় মনোনয়ন পান। এরপর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে নানা অভিযোগ আনেন। এবার তাঁর স্থলে জেলা আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতাকে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে।
যশোরে বাদ যাচ্ছেন সাবেক আমলা: সূত্র মতে, যশোরের একটি আসনে পরিবর্তন করা হয়েছে। ওই সংসদ সদস্য আগে সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁকে বাদ দিয়ে মনোনয়ন বোর্ডের এক সদস্যের নিকটাত্মীয়কে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মনোনয়ন বোর্ডের এক সদস্য বলেন, চূড়ান্ত ঘোষণা দেওয়ার আগ পর্যন্ত কাকে বাদ দেওয়া হয়েছে তা নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না। কারণ অতীতে নাম ঘোষণার পরও প্রার্থী বদলানো হয়েছিল। আবার বাদ পড়া কাউকে কাউকে ফেরানোও হয়েছিল। এবারও কয়েকটি আসনের ক্ষেত্রে তেমন হতে পারে।
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমরা মনোনয়নের ব্যাপারটাকে সুনির্দিষ্ট করে এখন বলছি না। কারণ, এর মধ্যে আমরা যে সকল প্রার্থী দিয়েছি, সেসব মনোনয়নে ভুলত্রুটিও থাকতে পারে। সেটাও আমাদের সংশোধনের একটা সুযোগ রেখেছি।’
চলতি সংসদে আওয়ামী লীগের ২৬২ জন সংসদ সদস্য (সরাসরি) আছেন। প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার ও উপনেতাসহ ১৯ জন নারী সরাসরি নির্বাচনে বিজয়ী। যদিও একাদশ জাতীয় সংসদে দলটি ২৫৮টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল।
সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি আন্দোলন করছে। বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দল নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। যদিও বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে থাকা কল্যাণ পার্টি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। দলটিকে দুটি আসনের ছাড় দেওয়ার সমঝোতা হয়েছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। সূত্র মতে, আরও কয়েকটি দলকে নির্বাচনে টানতে সরকার চেষ্টা করছে। তাদেরও আসন ছাড় দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিএনপি-জামায়াত অধ্যুষিত আসনগুলোকে ছাড়ের তালিকা রাখা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ থেকে বলা হচ্ছে, তারা ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেবে। তবে, দলটির একাধিক সূত্র মতে, সমঝোতা হওয়া আসনগুলোতে দলীয় প্রার্থী বাদ দিয়ে সংশ্লিষ্ট অন্য দলের প্রার্থীদের ছাড় দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে তাদের নৌকা প্রতীক দেওয়া হবে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের ৮ জন সংসদ সদস্য আছেন। বিএনপি নির্বাচনে না এলে জোটের আসন বাড়তে পারে।
ঢাকার দুটি আসনে ফরম নেননি কেউ: ঢাকার ২০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ১৮টিতে গতকাল ৬৮ জন মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। ঢাকা- ৭ ও ঢাকা-১০ আসনে কেউ মনোনয়ন ফরম তোলেননি। যাঁরা মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন তাঁরা হলেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান (ঢাকা-১), জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ (ঢাকা-৩), সানজিদা খানম ( ঢাকা-৪), ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন (ঢাকা-৮), সাবের হোসেন চৌধুরী (ঢাকা-৯, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক (ঢাকা-১৩) ও বর্তমান সংসদ সদস্য সাদেক খান (ঢাকা-১৩), আওয়ামী লীগের কামাল আহমেদ মজুমদার (ঢাকা-১৪), আওয়ামী লীগের আবু সাইদ (ঢাকা-১৭) এবং আওয়ামী লীগের বেনজীর আহমেদ (ঢাকা-২০)।
ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন ৩০ নভেম্বর, মনোনয়নপত্র বাছাই ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ১৭ ডিসেম্বর এবং ভোট হবে ৭ জানুয়ারি।
ঢাকার কয়েকটি আসন ও ফরিদপুরের দুটো আসনে পরিবর্তন হয়েছে বলে সূত্রে জানা গেছে। ঢাকার একটি আসনে ব্যবসায়ীকে বাদ দিয়ে একজন নায়ক, আরেকটি আসনে বাবার (আইনি কারণে) পরিবর্তে ছেলে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের একটি আসনে বর্তমান সংসদ সদস্যকে বাদ দিয়ে সাবেক (দশম) সংসদ সদস্যকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
ফরিদপুরে একটি আসনে সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা; আরেকটি আসনে জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে বলে সূত্রে জানা গেছে।
ঢাকায় জাতীয় পার্টির একটি আসনে একজন সাবেক মেয়রকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। আগামীকাল মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে শেখ হাসিনার মতবিনিময় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করবেন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। কাল রোববার সকাল ১০টায় গণভবনে এই সভা হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ ও সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভাপতি শেখ হাসিনা। গতকাল দলটির দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
গত শনিবার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত চার দিনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৩৬২টি। এরপর প্রার্থী চূড়ান্ত করতে বৃহস্পতিবার থেকে বৈঠক করছে সংসদীয় দল। সুত্র: আজকের পত্রিকা