বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অস্থিরতার মধ্যে গত ১৪ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন পর্যন্ত ২৩ দিনে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন ৪৫ জন সাবেক মন্ত্রী-এমপি। এর মধ্যে শেখ হাসিনার পতনের দিন দেশ ছাড়েন সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল এবং সাবেক প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ সব ইমিগ্রেশন চেক পয়েন্টে একাধিক তালিকা পাঠানো হয়। এই তালিকায় হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয়, মহানগর ও জেলা কমিটির নেতাদের নামও রয়েছে। এ ছাড়া হাসিনা সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, জাতীয় সংসদের সব এমপি এবং প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা দলবাজ কর্মকর্তাদের নামও দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার তালিকা রয়েছে। গতকাল দেশ ছেড়ে পালানোর সময় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটক হন সাবেক ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক। ইমিগ্রেশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
১৪ জুলাই ভোর ৬টা ৫০ মিনিটে টার্কিশ এয়ারলাইন্সে দেশ ছাড়েন নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ নজরুল ইসলাম বাবু। ওই দিন বেলা ২টায় থাই এয়ারওয়েজের টিজি-৩২২ ফ্লাইটে ব্যাংকক যান কুষ্টিয়া-২ আসনের সংসদ সদস্য মো. কামরুল আরেফিন। একই বিমানে ব্যাংককের উদ্দেশে পালিয়ে যান সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও মানিকগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য দেওয়ান জাহিদ আহমেদ মালেক। পরের দিন ১৫ জুলাই রাত ১২টা ১৭ মিনিটে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের এসকিউ-৪৪৭ ফ্লাইটে সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন ফরিদপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন। একই ফ্লাইটে আরও পালান দিনাজপুর-৬ আসনের শিবলী সাদিক, টাঙ্গাইল-৫ আসনের মো. সানোয়ার হোসাইন ও নাটোর-২ আসনের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল। এদিন সকাল ৭টা ৩৯ মিনিটে বিমান বাংলাদেশের বিজি-৩৯১ ফ্লাইটে কলকাতা পাড়ি জমান ঢাকা-৫ আসনের সংসদ সদস্য মশিউর রহমান মোল্লা সজল।
এ ছাড়া ১৬ জুলাই বেলা ১১টা ৩৭ মিনিটে এমিরেটস এয়ারলাইন্সে (ইকে-৫৮৩) দুবাই পালান সাবেক রেলমন্ত্রী ও কুমিল্লা-১১ আসনের এমপি মুজিবুল হক। ওই দিন বেলা ১২টা ৫ মিনিটে বাংলাদেশ বিমান বিজি-৩০৮ ফ্লাইটে ম্যানচেস্টারের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন
ঢাকা-১৬ আসনের মো. ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা। বেলা ১১টা ২৬ মিনিটে বিমানের বিজি-৩১৫ ফ্লাইটে মালয়েশিয়া পালান সাবেক গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী রুমানা আলী। ১৭ জুলাই রাত আড়াইটায় ক্যাথে এয়ারলাইন্সে (সিএক্স-৬৬২) হংকং যান ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ আসনের সংসদ সদস্য ফায়জুর রহমান। একই তারিখ রাত ১১টা ৫০ মিনিটে চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইন্সে (সিজেড-৩৯১) চীনের গুয়াংজুর উদ্দেশে দেশ ছাড়েন কুমিল্লা-৮ আসনের আবু জাফর মোহাম্মদ শফিউদ্দিন। রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে (এসকিউ-৪৪৭) সিঙ্গাপুর পালান ময়মনসিংহ-৮ আসনের মাহমুদুল হাসান সুমন।
১৮ জুলাই সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে বাংলাদেশ বিমানের বিজি-৫৮৪ ফ্লাইটে সিঙ্গাপুরে পলায়ন করেন সাতক্ষীরা-৩ আসনের এমপি ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী এ এফ এম রুহুল হক।
বিসিবির প্রেসিডেন্ট, ক্রীড়ামন্ত্রী ও কিশোরগঞ্জ-৬ আসনের এমপি নাজমুল হাসান পাপন গত ২০ জুলাই বেলা ১২টা ৫৫ মিনিটে শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইন্সে (ইএল-১৯০) দেশ ছাড়েন। ২৫ জুলাই বেলা ১২টা ১০ মিনিটে ব্যাংককের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন কুমিল্লা-৫ আসনের এমপি এ এম তাহের। ওই দিন দুপুর ১টা ৫৫ মিনিটে ব্যাংককে যান ময়মনসিংহ-৭ আসনের এবিএম আনিসুজ্জামান। বিকাল ৬টা ১০ মিনিটে এমিরেটস এয়ারলাইন্সে করে কানাডার উদ্দেশে দেশ ছাড়েন সংরক্ষিত নারী আসনের নীলুফার আনজুম। সন্ধ্যা ৭টা ৪৮ মিনিটে এমিরেটস এয়ারলাইন্সে করে কানাডা পালান অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়েশা খান। ২৬ জুলাই ভোর ৫টা ২০ মিনিটে কাতার এয়ারলাইন্সে (কিউআর-৬৪৩) গ্রিসে পালান কুমিল্লা-৪ আসনের আবুল কালাম আজাদ। সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব ২৭ জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় এমিরেটস এয়ারের ইকে-৫৮৭ ফ্লাইটে দুবাইয়ের উদ্দেশে দেশ ত্যাগ করেন।
আলোচিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ চৌধুরী ২৮ জুলাই ২টায় এমিরেটস এয়ারে (ইকে-৫৮৫) নেদারল্যান্ডসের হেগে যান। তিনি আবার ৩ আগস্ট ফেরত আসেন বলে সূত্র জানায়। গতকাল হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে দেশত্যাগের সময় তাকে আটক করা হয় বলে কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমে খবর আসে। ২৮ জুলাই রাত সাড়ে ১০টায় ইউএস-বাংলার বিএস-৩০৭ ফ্লাইটে সিঙ্গাপুর যান কুমিল্লা-৩ আসনের সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর আলম।
২৯ জুলাই বেলা ১১টা ১০ মিনিটে এমিরেটসে (ইকে-৫৮৩) তেহরান যান সাবেক বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু। ওই দিনে বিকাল ৩টা ৪০ মিনিটে নভোএয়ারে কলকাতা যান যশোর-৩ আসনের কাজী নাবিল আহমেদ। একই দিন বিকাল ৫টা ৫০ মিনিটে বিমানের বিজি-৩৩৭ ফ্লাইটে মদিনা যান বরগুনা-৫ আসনের মো. মজিবুর রহমান মজনু।
৩০ জুলাই ২টা ৪০ মিনিটে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সে (এমএইচ-১৯৭) ইন্দোনেশিয়ার উদ্দেশে দেশত্যাগ করেন পটুয়াখালী-৩ আসনের এসএম শাজাহান। ৩১ জুলাই বেলা ২টায় এমিরেটস এয়ারলাইন্সে (ইকে-৫৮৫) নিউইয়র্ক যান ঢাকা-১৮ আসনের খসরু চৌধুরী। এদিন দুপুর ১টা ১৬ মিনিটে বাংলাদেশ বিমানের বিজি-৩৯৭ ফ্লাইটে দিল্লি পাড়ি দেন শরীয়তপুর-৩ আসনের নাহিম রাজ্জাক। একই দিন রাত ১১টা ২০ মিনিটে চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইন্সে (সিএস-৩৯২) চীনের গুয়াংজু যান কুমিল্লা-৮ আসনের আবু জাফর মো. শফিউদ্দিন। ২ আগস্ট সন্ধ্যা ৭টা ২৩ মিনিটে টার্কিশ এয়ারের টিকে-৭১৩ ফ্লাইটে ইস্তাম্বুল যান ঝিনাইদহ-২ আসনের নাসের শাহরিয়ার জাহিদী। এদিন রাত ১০টা ৫০ মিনিটে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সে (বিএস-৩০৭ ফ্লাইটে) সিঙ্গাপুর যান সংরক্ষিত মহিলা আসনের পারুল আক্তার। একই দিনে সকাল ৮টা ৪০ মিনিটে বাংলাদেশ বিমানে (বিজি-৫৮৪) সিঙ্গাপুর পালান শেখ পরিবারের সদস্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস। এদিন সকাল ১০টা ১৬ মিনিটে ভিসটারা এয়ারে (ইউকে-১৮২) দেশ ছাড়েন জাতীয় পার্টির নেতা ঢাকা-৪ আসনের সাবেক এমপি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা। একই দিন সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে বাংলাদেশ বিমানের বিজি-৫৮৪ ফ্লাইটে সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। ৪ আগস্ট বেলা ১২টায় বাংলাদেশ বিমানে (বিজি-৩৯৭) ঢাকা ছাড়েন নেত্রকোনা-৪ আসনের সাজ্জাদুল হাসান। ৫ আগস্ট রাত ১২টায় সিঙ্গাপুর এয়ারে (এসকিউ-৪৪৭) সিঙ্গাপুর গেছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল। একই দিন রাত ২টা ৩৫ মিনিটে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সে (এমএইচ-১৯৭) মালয়েশিয়া যান সাবেক প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম।
এদিকে গতকাল বিকালে ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত ও ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সভাপতি রিয়াজ মাহমুদকে বিদেশ যেতে দেওয়া হয়নি। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাদের আটকে দেয়।
জানা গেছে, দেশছাড়া সাবেক ৪৫ মন্ত্রী-এমপির মধ্যে কয়েকজন আবার দেশে ফিরে আসেন। তবে তাদের দেশে ফেরার রেকর্ড ইমিগ্রেশনে নেই।
এদিকে গতরাতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, বর্তমানে দেশের সকল ইমিগ্রেশন পোস্টে কার্যক্রম চলমান রয়েছে। প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ না করায় অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে পরামর্শক্রমে বিভিন্ন হাই প্রোফাইল ব্যক্তিবর্গ যেমন- সাবেক মন্ত্রী, এমপি, রাজনৈতিক নেতা, সরকারি কর্মকর্তা, মিডিয়াকর্মীদের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন না করে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, শেখ হাসিনা সরকারের বেশির ভাগ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এখনো দেশেই আছেন। তারা নিজেদের পিঠ বাঁচাতে আত্মগোপনে আছেন। বেশির ভাগেরই ব্যক্তিগত সেলফোন বন্ধ। কেউ কেউ কীভাবে দেশ ছেড়ে নিজেকে রক্ষা করবেন সেই পথ খুঁজছেন। নিজেদের ওপর হামলা ঠেকাতে দেশে অবস্থানরত অধিকাংশ সাবেক সংসদ সদস্য এলাকা ছেড়ে ঢাকায় আশ্রয় নিয়েছেন।
পাঠকের মতামত