আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) এক নতুন গবেষণায় বলা হয়েছে, স্থানীয় বাজারের পাস্তুরিত দুধের ৭৫ শতাংশের বেশি সরাসরি পানের জন্য নিরাপদ নয়।
এতে বলা হয়, দুগ্ধ খামার থেকে শুরু করে বিক্রয়ের দোকান পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে দুধ ব্যাকটেরিয়া দ্বারা দূষিত এবং তা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য নয়। এসব দুধে ব্যাপক মাত্রায় কোলিফর্ম, ফিক্যাল কোলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া, ই-কোলাইসহ জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর জীবাণুর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। ফুটানো ছাড়া এই দুধ পান করলে তা জনস্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ফুড মাইক্রোবায়োলজিতে এই গবেষণা ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। বুধবার আইসিডিডিআর,বির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
কেয়ার বাংলাদেশের আর্থিক সহায়তায় 'স্ট্রেনদেনিং দ্য ডেইরি ভ্যালু চেইন (এসডিভিসি)' প্রকল্পের আওতায় দুগ্ধ শিল্পের বিভিন্ন পর্যায়ে দুধের অণুজীব বিজ্ঞানগত মান যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে বগুড়া, গাইবান্ধা, নীলফামারী, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, রংপুর এবং সিরাজগঞ্জ জেলার ১৮ উপজেলায় এই গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এসব উপজেলার দুধ উৎপাদনকারী, হিমাগার, স্থানীয় রেস্তোরাঁ থেকে কাঁচা দুধের ৪৩৮টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এ ছাড়া ঢাকা এবং বগুড়ার বিভিন্ন দোকান থেকে বাণিজ্যিকভাবে প্রক্রিয়াজাতকৃত দুধের ৯৫টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
সংগৃহীত এসব নমুনা পর্যালোচনা করে গবেষকরা দেখতে পান, প্রাথমিক দুধ উৎপাদনকারী পর্যায়ে ৭২ শতাংশ এবং ৫৭ শতাংশ নমুনা যথাক্রমে কোলিফর্ম ও ফিক্যাল কোলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া দ্বারা দূষিত। নমুনা ১১ শতাংশ উচ্চ সংখ্যক ই-কোলাই দ্বারা দূষিত। ফিক্যাল কোলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ এবং দুধে এই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতির ফলে দুধ জীবাণু বা রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস আক্রান্ত হয়, যা উষ্ণ রক্তের প্রাণীর মলে থাকতে পারে বা দুধ সংগ্রহের সময় দুধে মিশে যেতে পারে।
উৎপাদনকারীদের থেকে দুধ সংগ্রহের স্থানে দেখা যায়, নমুনাগুলো উচ্চসংখ্যক কোলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া দ্বারা দূষিত। এ ছাড়া ৯১ শতাংশ মল দ্বারা দূষিত এবং ৪০ ভাগ নমুনায় উচ্চসংখ্যক ই-কোলাই পাওয়া যায়। হিমাগারে সংগৃহীত নমুনাগুলোর দুধ সংগ্রহের স্থানের নমুনাগুলোর চেয়েও দূষণের হার বেশি দেখতে পাওয়া যায়। পাঁচটি জেলার ১৫ হিমাগারে সংগৃহীত নমুনাগুলো উচ্চমাত্রার কোলিফর্ম ও মলবাহিত কোলিফর্ম পাওয়া যায়। সবগুলো হিমাগার থেকে সংগৃহীত ৬৭ শতাংশ নমুনা ই-কোলাই দ্বারা উচ্চমাত্রায় দূষিত। এ ছাড়া বি.সেরেয়াস এবং স্ট্যাফাইলোকক্কির মতো আরও কিছু ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তবে এগুলোর মাত্রা স্বাভাবিক ছিল।
গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন, দুধ উৎপাদনকারী থেকে শুরু করে হিমাগার এবং সবশেষে ভোক্তার কাছে সরবরাহকৃত দুধে ব্যাকটেরিয়ার মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। পরীক্ষিত পাস্তুরিত দুধের নমুনায় প্রায় ৭৭ শতাংশ ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে, যা বিএসটিআইর মানদণ্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে, ৩৭ শতাংশ কোলিফর্ম এবং ১৫ শতাংশ মলবাহিত কোলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া দ্বারা দূষিত ছিল।
গবেষক দলের প্রধান ও আইসিডিডিআর,বির সহযোগী বিজ্ঞানী এবং ফুড মাইক্রোবায়োলজি ল্যাবরেটরির প্রধান ড. মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম বলেন, দুধকে পানের জন্য নিরাপদ করে তুলতে পাস্তুরিত করা হয়। কিন্তু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় মানদণ্ডে পাস্তুরিত দুধে এ ধরনের মলবাহিত কোলিফর্মের উপস্থিতি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বাজারের পাস্তুরিত কাঁচা দুধে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এসব দুধ ভালোভাবে না ফুটিয়ে পান করা উচিত নয়।
তিনি বলেন, দুধ প্রক্রিয়াজাতকরণের বিভিন্ন পর্যায়ে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, দুধের মূল গুণ অর্থাৎ পুষ্টিগত গুণাগুণ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। দুধের প্রাথমিক উৎপাদনকারী পর্যায়ে দূষণের সঙ্গে গরুর প্রজনন প্রক্রিয়া, গরুর দ্বারা উৎপাদিত দুধের পরিমাণ, দুধ দোহনের সময় এবং যিনি দুধ দোহন করে তার হাত ধোয়ার অভ্যাসের মতো বিভিন্ন বিষয় জড়িত। সবার জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর দুধ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্যকরভাবে দুধ দোহন, সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পাস্তুরিত করার বিষয়ে যত্নবান হতে হবে। এ ছাড়া পানের জন্য দুধকে নিরাপদ রাখতে উৎপাদনের স্থান থেকে ভোক্তার টেবিল পর্যন্ত প্রত্যেকটি পর্যায়ে পাস্তুরিত দুধকে নিরবচ্ছিন্নভাবে শীতল রাখার পদ্ধতি অনুসরণ করা জরুরি।