দীর্ঘ সময় ধরে পাহাড়ের প্রাকৃতিক সম্পদ বিনষ্ট করে গড়ে উঠেছে অবৈধ ইটভাটা। এসব ইটভাটা চালু হওয়ায় একের পর এক পাহাড়, গাছগাছালি ও জমিসহ প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস হয়েছে। অস্তিত্ব হারিয়েছে পরিবেশ, নষ্ট হয়েছে আশেপাশে গুরুত্বপূর্ণ সড়কও। এসব মাথা গজিয়ে ওঠা অবৈধ ইটভাটা বন্ধ না হলে ভবিষ্যতে আরো প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর প্রভাব পড়বে।
বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের আমলে এসব অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করা না গেলে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসলেও সেটি বন্ধ করা যাবে কিনা তা অনিশ্চিত। তাই পরিবেশের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে এসব মাথা গজিয়ে উঠা অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করা জরুরি বলে মনে করছেন পরিবেশ বিশ্লেষকরা।
তিন পার্বত্য জেলার ২৫টি উপজেলায় অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে প্রায় ২ শতাধিক ইটভাটা। যেসব ইটভাটার নেই কোন অনুমতি ও পরিবেশের ছাড়পত্র। এসব অধিকাংশ ইটভাটা গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন এলাকার পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো পাশে নয়তো গহীন বনে পাহাড় কেটে আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিনষ্ট করে। আশেপাশে থাকা চাষকৃত জমি ও বনাঞ্চল ধ্বংস করে ব্যবসা চাঙ্গা করার যেন ইটভাটা মালিকদের মূল লক্ষ্যে।
বন বিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র বলছে, তিন পার্বত্য জেলার ২৫টি উপজেলায় প্রায় দুই শতাধিক অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। এসব ইটভাটাতে বন জঙ্গলের কাঠ এবং পাহাড় কেটে মাটি স্তুপ করায় প্রতিটি ইটভাটায় বন ও পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে জরিমান করা হলেও তাও মানছেন না কোন আইন। বরংচ মামলা আইন দেখিয়ে পুরোদমে চালু করা হয় ইটভাটা।
শীতের মৌসুম শুরু আগে প্রতিটি ইটাভাটা গুলোতে সমতল জেলাগুলো থেকে আনা হয় অসংখ্য শ্রমিক। এসব শ্রমিকদের পারিশ্রমিক হিসেবে প্রতি ঘরে ৫০ হাজার টাকা বিনিময়ে ছয়মাসে জন্য কাজ পরিচালনা করতে নিয়ে আসা হয় প্রতিটি ইটভাটাতে। এরপর শুরু হয় পাহাড় ও বনাঞ্চল ধ্বংসের চক্র। ইটভাটা চালুর আগ পর্যন্ত পাহাড় কেটে মাটি ও বন উজাড় করে গাছ জমাট শুরু হয়। অথচ এসব ইটভাটা গুলোতে স্থানীয় বাসিন্দারা তেমন কাজকর্ম পান না। এসব কাজে বাধা প্রদান করা হলে হুমকি-ধামকি ভয় দেখানো হয় স্থানীয় মানুষদের। ইটভাটা মালিকরা মুখের উপর প্রশ্নে ছুড়ে দেন প্রশাসনকে ম্যানেজ করে এসব ইটভাটা গড়ে তোলা হয়েছে।
অন্যদিকে গেল বেশ কয়েকদিন আগে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ করতে দেখা গেছে, “ইটভাটা বন্ধ হলে বেকার হয়ে পড়বে অসংখ্য মানুষ বন্ধ হবে উন্নয়ন।” কিন্তু গেল কয়েক দশক ধরে এসব পত্রিকা সংবাদের মূল শিরোনাম ছিল’ অবৈধ ইটভাটা পোড়ানো হচ্ছে কাঠ’ ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশ অথবা মাটি কেটে পাহাড় সাবাড়”। অথচ এসব ইটভাটায় স্থানীয় মানুষরা কোন কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে না।
ইটভাটা প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৩ তে বলা হয়েছে, লাইসেন্স ও পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়া ইট তৈরি করার সুযোগ নেই। লাইসেন্স ছাড়া কেউ ইটভাটা চালু করলে শাস্তির বিধান রয়েছে। এ আইন অমান্য করলে ১০ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। আবার ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) (সংশোধন) আইন, ২০১৯ অনুযায়ী, বিশেষ কোনো স্থাপনা, রেলপথ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, গবেষণা প্রতিষ্ঠান কিংবা অনুরূপ কোনো স্থান বা প্রতিষ্ঠান থেকে কমপক্ষে এক কিলোমিটার দূরে ইটভাটা স্থাপন করতে হবে। তবে তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানে এক দশক ধরে অবৈধভাবে চলা সকল ইটভাটা চালু থাকাতে এটাই প্রমাণিত যে, তারা আইনের তোয়াক্কা না করে চালিয়ে যাচ্ছে ইটভাটার কাজ।
প্রভাবশালীদের মালিকানা ও ছত্রছায়ায় পাহাড় কেটে ও ফসলি জমির উর্বর মাটি দিয়ে ও দিন-রাত বনের কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো হয়। কোনো ইটভাটাতে কয়লা ব্যবহার করা হয় না। কাঠ পোড়ানোর ফলে বন উজাড়ের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যও ধ্বংস হচ্ছে। তাছাড়া বেশীর ভাগই কৃষিজমি, জনবসতি, প্রাকৃতিক ও সামাজিক বন এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘেঁষে গড়ে উঠেছে এই ইটভাটাগুলো। ইটভাটার বড় বড় গাড়ির আওয়াজে রাস্তা ভাঙন ও সড়ক সংলগ্ন স্কুলটি ধুলাবালি ও চুল্লির কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, আশেপাশে বনাঞ্চল,পাহাড় ধ্বংস করে চালু করা হয়েছে এসব অবৈধ ইটভাটাগুলো। এসব অবৈধ ইটভাটা বন্ধের দাবি জানিয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন কমিটির জেলা আহ্বায়ক বলেন, এসব ইটভাটা অবশ্যই পরিবেশের জন্য হুমকি। বন উজার করে পাহাড় কেটে পরিবেশ ধ্বংস করে ইটভাটা চালাচ্ছে সেভাবে হলে পাহাড়ের আর অস্তিত্ব থাকেব না। আর আমরা ইটভাটার বিপক্ষে নয়। ইটভাটা পরিচালনা করতে যে নিয়মনীতি ব্যবস্থাপনা আছে সেটি না মানার কারণে আন্দোলন করেছি। তাই ইটভাটা বন্ধ হলে পরিবেশ রক্ষা পাবে বলে আমি মনে করি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক বলেন, পাহাড় ধ্বংস করে কোন ইটভাটা চালু করতে দেয়া যাবে না। আমরা চেষ্টা করছি জিরো টলারেন্স নিয়ে আসার জন্য।
বান্দরবান জেলা প্রশাসক শাহ মোহাজিদ উদ্দিন বলেন, ঊর্ধ্বতন থেকে নির্দেশনা রয়েছে বান্দরবানে যতগুলো অবৈধ ইটভাটা রয়েছে সেগুলো একটাও চলবে না।
খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মো: সহিদুজ্জামান বলেন, ইটভাটা চালুর কোনো অনুমতি প্রদান করা হয়নি। অনুমতিবিহীন কোথাও ইটভাটা চালু করলে কিংবা চালুর সু-নির্দিষ্ট তথ্য পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে।
রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খানের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি