নিউজ ডেস্ক:
সারাদেশে মাদকবিরোধী অভিযান চালাচ্ছে যারা, সেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধেই উঠেছে মাদক ব্যবসার গুরুতর অভিযোগ। আসামির কাছ থেকে জব্দ করা ইয়াবা আত্মসাৎ করে কিছু পুলিশ সদস্যের ব্যবসায় জড়িত হওয়ার প্রমাণও মিলেছে। গত ৩০ জুলাই নগরের বাকলিয়া থানার একটি বাসায় অভিযান চালায় র্যাব। সেখান থেকে ইয়াবাসহ একজনকে গ্রেফতার করে তারা।
বাসাটি ভাড়া নিয়ে আসামিদের কাছ থেকে আত্মসাৎ করা ইয়াবা বিক্রি করতেন বাকলিয়া থানার এসআই খন্দকার সাইফ উদ্দিন। গত ৩১ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরের লালদীঘিপাড়ের একটি হোটেলে অভিযান চালায় কোতোয়ালি থানা পুলিশ। এ সময় পুলিশ কনস্টেবল জহিরুল ইসলামসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে তারা। জিজ্ঞাসাবাদে জহির জানায়, ইয়াবাগুলো নগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আবদুল ওয়াদুদের। এর পরও চাকরিতে বহাল আছেন আবদুল ওয়াদুদ।
শুধু এই পুলিশ কর্মকর্তাই নন, জানা গেছে টাকার লোভে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত আরও কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার নাম। গত এক বছরে অন্তত ১০ পুলিশ সদস্য ইয়াবা বিক্রির অভিযোগে গ্রেফতারও হয়েছেন। আবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা মাদক ব্যবসায়ীর তালিকায়ও চট্টগ্রামের কয়েকজন ওসির নাম এসেছে। অভিযুক্ত ওসিদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছে গোয়েন্দা সংস্থা। নিশ্চিত হওয়ার পর এসব পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নেওয়া হবে ব্যবস্থা। এরই মধ্যে পুলিশের নিচের স্তরে কয়েকজন মাদকসহ হাতেনাতে ধরা পড়ায় উদ্বিগ্ন সংশ্নিষ্টরা।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার মাহাবুবর রহমান বলেন, ‘পুলিশ সদস্যরা মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে- এটা উদ্বেগের। তবে সে যেই হোক, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া আর যারা জড়িত, চিহ্নিত করার কাজ চলছে তাদের। পুলিশ সদস্যরা যাতে মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে না পড়েন, সে জন্য মোটিভেশনাল কার্যক্রমও চলমান রয়েছে। এর পরও মাদকের সঙ্গে কোনো সদস্যের নূ্যনতম সংশ্নিষ্টতা পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
গত ৩১ আগস্ট নগরের লালদীঘির পশ্চিম পাড়ে হোটেল আল ফালাহর পঞ্চম তলার ৪০১ নম্বর কক্ষ থেকে ৮০০ পিস ইয়াবাসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তারা হলেন- জহিরুল ইসলাম, পলাশ ভট্টাচার্য ও আনোয়ার হোসেন শাহিন।
তাদের মধ্যে জহিরুল ইসলাম আদালত পুলিশের জিআরও শাখার কনস্টেবল। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জহির জানান, বিক্রির জন্য ইয়াবাগুলো তার কাছে রেখেছেন ওয়াদুদ। এই আবদুল ওয়াদুদ নগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই); গোয়েন্দা পুলিশের তিন নম্বর বিশেষ টিমে কর্মরত। এ ঘটনায় একই দিন রাতে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেছেন অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া বক্সিরহাট পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মো. নুরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ী মাদক বিক্রির জন্য জড়ো হয়েছে- সংবাদ পেয়ে অভিযান চালানো হয়। অভিযানে তিনজনকে ইয়াবাসহ হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে জহির জানিয়েছেন, ইয়াবাগুলো ওয়াদুদ নামের একজনের। ওয়াদুদ তাকে বিক্রি করতে দিয়েছেন। ওয়াদুদকে গ্রেফতার করা যায়নি। তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত করে তাকে গ্রেফতার করবেন।’
এ প্রসঙ্গে নগর গোয়েন্দা পুলিশের এএসআই আবদুল ওয়াদুদের মোবাইল ফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি তাকে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে তার কর্মস্থলে গিয়েও খোঁজ মেলেনি তার।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর ও দক্ষিণ) হাসান মো. শওকত আলী বলেন, ‘এএসআই আবদুল ওয়াদুদের মাদক সম্পৃক্ততার অভিযোগের বিষয়ে এখনও অফিসিয়ালি কিছু জানি না। সে নগর গোয়েন্দা পুলিশে কর্মরত আছে।’
গত ৩০ জুলাই রাতে নগরের পশ্চিম বাকলিয়ার তুলাতলী হাফেজনগর এলাকার হাজি গোফরান উদ্দিন মুন্সীর বাড়িতে অভিযান চালায় র্যাব। ওই বাড়ির নিচতলার একটি বাসা ভাড়া নিয়ে ইয়াবা বিক্রি করতেন বাকলিয়া থানার চাক্তাই ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই খন্দকার সাইফ উদ্দীন। এ ঘটনায় সাইফ উদ্দীনসহ দু’জনের বিরুদ্ধে মামলা করে র্যাব। মামলা হওয়ার পর থেকে পলাতক রয়েছেন তিনি। তাকে এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
র্যাব-৭-এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক মিমতানুর রহমান বলেন, ‘এসআই সাইফ শাহ আমানত সেতু চেকপোস্ট থেকে যেসব ইয়াবা উদ্ধার করতেন, সেগুলো জব্দ তালিকায় না দেখিয়ে আত্মসাৎ করতেন। এরপর বাসাটিতে মিল্লাত নামের একজনকে কমিশনের ভিত্তিতে রেখে মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতেন।’
২০১৬ সালের ১১ নভেম্বর নগরের শাহ আমানত সেতু এলাকা থেকে এক হাজার ৭০০ পিস ইয়াবাসহ একজনকে আটক করেন বাকলিয়া থানার তৎকালীন এএসআই মো. রিদওয়ান। ইয়াবাগুলো নিজে আত্মসাৎ করে আসামিকে ছেড়ে দেন। ওই ইয়াবা নিউমার্কেট মোড় এলাকায় বিক্রি করতে গিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাছে ধরা পড়েন তিনি। এ সময় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে নগর পুলিশ। গত ১২ জুলাই নগরের চান্দগাঁও থানার বহদ্দারহাট বারইপাড়া এলাকা থেকে ইয়াবা ও তিন সহযোগীসহ আবারও ধরা পড়েন এএসআই রিদওয়ান।
একই দিন মিরসরাইয়ের নিজামপুরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বাসার ফার্নিচার বহনকারী একটি ট্রাকের ফাইল কেবিনেট থেকে ২৯ হাজার ২৮৫টি ইয়াবা উদ্ধার করে র্যাব। এ ঘটনায় ট্রাকটির চালক ও সহকারীকে গ্রেফতারের পরদিন নগর পুলিশের এসআই বদরুদ্দোজাকেও গ্রেফতার করে মিরসরাই থানা পুলিশ। মিরসরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাইরুল ইসলাম বলেন, ‘ইয়াবা উদ্ধারের পর থেকে এসআই বদরুদ্দোজাকে খুলশী থানায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। আমরা প্রাথমিকভাবে ইয়াবা পাচারের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছি।’
গত ৩১ মার্চ বিকেলে নগরের আগ্রাবাদ লাকী প্লাজার পশ্চিম পাশে জ্যোতি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের সামনে থেকে নুরুচ্ছফা মামুন ও সাইফুল কবির শাকিল নামের দু’জনকে ইয়াবাসহ গ্রেফতার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার দু’জনই জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে পুলিশ কনস্টেবল কামরুজ্জামান কামরুলের কাছ থেকে ইয়াবা কিনে নগরের বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করেন তারা। তিনজনের বিরুদ্ধেই নগরের ডবলমুরিং থানায় মামলা করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। গত ২ এপ্রিল বিকেলে এ মামলায় পুলিশ কনস্টেবল কামরুজ্জামান কামরুলকে গ্রেফতার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। তিনি নগরের দামপাড়া পুলিশ লাইনে কর্মরত। পুলিশ লাইনে বসেই ইয়াবা বিক্রি করতেন কামরুল।
?২০১৭ সালের ২৮ নভেম্বর নগরের কর্ণফুলী থানার মইজ্জ্যারটেক এলাকা থেকে গ্রেফতার হন চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের গোয়েন্দা ইউনিটের (ডিবি) সহকারী উপপরিদর্শক আনোয়ার হোসেন। তার কাছ থেকে এক হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ।
একই বছরের ২৬ আগস্ট নগরের ডবলমুরিং থানার আগ্রাবাদ চৌমুহনী এলাকা থেকে এসআই আফাজ উল্যাহ এবং তার দুই সহযোগী মো. খোরশেদ আলম ও শহীদ উল্লাহকে গ্রেফতার করে র?্যাব। নগরের হালিশহর থানায় কর্মরত ছিলেন এসআই আফাজ। সুত্র : সমকাল
পাঠকের মতামত