মোহাম্মদ জুবায়ের। ৫ বছর আগে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসেন। আশ্রয় নেন কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি ব্লকে। কয়েক মাস পরেই জড়িয়ে পড়েন নানা অপরাধে। মাদক কারবারের পাশাপাশি অস্ত্র কারবারও শুরু করেন জুবায়ের। গড়ে তোলেন ১০-১২ জনের একটি গ্রুপ।
জুবায়েরের মতো একই ক্যাম্পের সি ব্লকের জাহিন হোসেনও মাদক ও অস্ত্র কারবারে জড়িত। অস্ত্র কারবারের মধ্যে বিক্রির পাশাপাশি তারা ভাড়া দিচ্ছেন। ক্যাম্পের বাইরের অপরাধী চক্র, যারা ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়িত তারা অস্ত্র ভাড়া নেয়। এ ছাড়া রাজধানীর অপরাধ জগতের লোকজনও রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে অস্ত্র ভাড়া নেয়। সম্প্রতি পুলিশের একটি গোপন প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাদক ও অস্ত্র কারবার নিয়ন্ত্রণ করছে মূলত রোহিঙ্গাদের একটি অস্ত্রধারী গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। এই গোষ্ঠীর ২৭টি গ্রুপ কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সক্রিয়।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নানা অপরাধ হচ্ছে, এটা সত্য। তবে রোহিঙ্গা অপরাধীদের রুখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তৎপর। রোহিঙ্গাদের একাধিক চক্র নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত। তাদের কঠোরভাবে দমন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
চলতি বছরের জানুয়ারির শেষে দিকে উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাশে গহিন পাহাড়ে গড়ে তোলা আরসার একটি আস্তানা থেকে ২২টি আগ্নেয়াস্ত্র, শতাধিক রাউন্ড গুলি, চারটি মাইন ও বেশকিছু বিস্ফোরক দ্রব্য উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় তিনজনকে।
এরপর ফেব্রুয়ারি মাসে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে উদ্ধার করা হয় ৫টি একনলা বন্দুক, একটি এলজি, ৩৬টি রাইফেলের গুলি, ৪টি শটগানের কার্তুজ, ৩টি হাতে তৈরি গ্রেনেডসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম।
পুলিশের গোপন প্রতিবেদনটি পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানোর পর অস্ত্র কারবারিদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপরতা বাড়ায়। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে আগ্নেয়াস্ত্রসহ ৫ রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে ৫টি বিদেশি পিস্তল, দুটি দেশীয় বন্দুক ও ১৮টি গুলি উদ্ধার করা হয়।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, উখিয়ার কুতুপালংয়ের ক্যাম্প ২-এর পশ্চিমাংশের ডি-৯ ব্লক থেকে মোহাম্মদ জুবায়ের, দিল মোহাম্মদ, মোহাম্মদ ইদ্রিছ, মোহাম্মদুল্লাহকে গ্রেপ্তার করে আর্মস পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানান, মিয়ানমার থেকে আসার পরপরই তারা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। প্রথমে মাদক কারবার, পরে অস্ত্র কারবারে জড়ান তারা। নিয়মিত অস্ত্র ভাড়া দেওয়ার কথাও স্বীকার করে তারা বলেছেন, দৈনিক হিসেবে অস্ত্র ভাড়া দেওয়া হয়। অস্ত্রের মধ্যে পিস্তলের চাহিদা বেশি। একদিনের জন্য পিস্তল ভাড়া ৩০ হাজার টাকা। অস্ত্র দেওয়ার সময় ছবি তোলে রাখা হয়। ক্যাম্পের ভেতরে অস্ত্র কারবারে জড়িত সবাই আরসার সদস্য। তাদের মধ্যে এইচ ব্লকের হাবিবুল্লাহ, বালুখালীর গফুর মিয়া, আগের শামলাপুর বাহারছড়া ক্যাম্পের মোহাম্মদ আলম, এ ব্লকের ইমাম হোসেন, আমান উল্লাহ, জাহাঙ্গীর আলম; সি ব্লকের ইসলাম মিয়া, ডি ব্লকের আতাউল্লাহ, বি ব্লকের আলী জহর, দীল মোহাম্মদ, মৌলভী আবদুর রহিম; সি ব্লকের আবদুল্লাহ, কামাল হোসেন, মো. জমিল, ব্লক ১০-এর আবুল আমিন, ক্যাম্প ১৫-এর এনায়েত উল্লাহ, ব্লক এ/৩০-এর মো. ইসলাম, ব্লক ই/৫-এর মো. আবুল মোনাফ, ব্লক-এইচ/১৩ ফারুক শাহ, ক্যাম্প-২৬ ব্লক-শালবনের মৌলভী করিম, ক্যাম্প ৫-এর আমান উল্লাহ, ২ নম্বর ক্যাম্পের মৌলভী আয়াছ, কলিমউল্লাহ, জাহিদ হোসেন, মোহাম্মদ ফরিদ, ইউসুফ, জামাল, আরমান, বাইল্লা, ফরিদ, মোহাম্মদ মুছা, সানাউল্লাহ, সালাম, ছলিমউল্লাহ, মৌলভী সামছু, কলিমউল্লাহ, জাহিদ হোসেন, ইউছুফ, জামাল, ৪ নম্বর ক্যাম্পের আরমান, আব্দুল মালেক, আব্দুল হালিম, মাস্টার সাইফ উদ্দিন, ১৭ নম্বর ক্যাম্পের সিরাজ, এনাম মাস্টার, হোসেন, ইলিয়াছ, নুর, সালাম, মৌলভী হামিদ হোছন, নূর বশর, সেলিম, মাস্টার ফারুক, মাঝি আব্দুর ছবি, হাফেজ আয়াছ, লতিফ আলী, মাঝি সাইফুল্লাহ, ওসমান, হবির আহম্মদ, আইয়ূব, মোহাম্মাদ রফিক, ৭ নম্বর ক্যাম্পের আব্দুল মাবুদ, আইয়াছ উদ্দিন, হাফেজ, কেফায়েত উল্লাহ্, হয়দার ল্যাংড়া হায়দার, ৫ নম্বর ক্যাম্পে ভুট্টু আব্দুল্লাহ, ওস্তাদ খালেক মাস্টার এনাম, হাবিবুল্লাহ, সৈয়দুল আমিন, শাহ আলম, কালা মিয়া, মৌলভী হোসেন আহাম্মেদ, মৌলভী নুরুল আমিন, নুর সাফা, লিয়াকত আলী, এহসান উল্লাহ, মাস্টার মুন্না, শামসুল আলম, মো. জাফর, মুছা, মো. জাবেদ, মাস্টার দিল মোহাম্মদ, নবী হোসেন, নুরুল আমিন, সৈয়দুল ইসলাম, নুরুল আমিন প্রমুখ। দালালদের মধ্যে আছেন নোয়াখালী পাড়ার সাইফুল ইসলাম, একই গ্রামের নুরুল ইসলাম, টেকনাফের সাবরাংয়ের আছমা বেগম, একই এলাকার সিরাজুল ইসলাম, টেকনাফের ডেইলপাড়ার দিলারা বেগম, একই এলাকার মমিনুল ইসলাম, টেকনাফের শ্যামলাপুর ইউনিয়নের নুরুল ইসলাম, কোনারপাড়া ৮ নম্বর ওয়ার্ডের জামাল উদ্দিন, সেন্টমার্টিনের বদি আলম, সেন্টমার্টিনের পূর্বপাড়ার কবির মাঝি, টেকনাফের নয়াপাড়া রঙ্গিখালীর মো. রফিক, একই এলাকার শফিক, কচ্ছপিয়া করাচিপাড়ার জাফর, জুম্মাপাড়ার আব্দুস সালাম, বাঘগোনার আইয়ূব, মিঠা পানিরছড়ার মো. ইউনুছ মিয়া প্রমুখ।
পুলিশের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ক্যাম্পের বাইরে অপরাধীদের কাছে দালালদের মাধ্যমে নিয়মিত অস্ত্র ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। যারা ভাড়া নিচ্ছে তারা অপরাধকান্ড ঘটানোর পর অস্ত্র ফেরত দেয়। অস্ত্র ভাড়া দিয়ে মাসে লাখ টাকা পাওয়া যায় বলেও আটক অপরাধীদের জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পেরেছে পুলিশ। এ ছাড়া অস্ত্র ও মাদক কারবারের পাশাপাশি মানব পাচারেও জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অপরাধীদের নিয়ে মাসখানেক আগে একটি প্রতিবেদন এসেছে পুলিশ সদর দপ্তরে। প্রতিবেদনে নানা বিষয়ে তথ্য আছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আগে ছিল মাদক কারবারের আস্তানা। বর্তমানে ক্যাম্পের ভেতর থেকেই অস্ত্র ভাড়া দেওয়া হচ্ছে।
আরসা সদস্যরা সবকটি ক্যাম্পে সক্রিয়, এ কথা উল্লেখ করে ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশি দালালদের মাধ্যমেই অস্ত্র ভাড়া দেওয়া হয়।
মিয়ানমারের রাখাইনে দেশটির সেনাবাহিনীর ব্যাপক নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের মধ্যে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ঢল নামে সীমান্ত দিয়ে। এর আগেও নানা সময় রোহিঙ্গারা পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। সবমিলিয়ে ধারণা করা হয়, ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রিত।
পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টেকনাফ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারে যুদ্ধ পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মিয়ানমারের নাগরিকদের (রোহিঙ্গা/মগ) অবৈধ অনুপ্রবেশ নিয়ন্ত্রণ, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের অরক্ষিত স্থল ও জলসীমান্তে নিরাপত্তা, রোহিঙ্গাদের রেশনের অবৈধ পাচার রোধ, মাদকের বিনিময়ে রেশনের জিনিসপত্র লেনদেনের ফলে মাদক ও চোরাচালানকৃত পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তা ছাড়া সীমান্তে যুদ্ধাবস্থায় আগ্নেয়াস্ত্র সহজলভ্য হওয়ায় সন্ত্রাসী দল বা গোষ্ঠী আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ব্যবহার করছে। স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও মগ সম্প্রদায়ের সঙ্গে আরাকান আর্মির সখ্য থাকায় তারা বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে উত্তেজনা সৃষ্টি করার পাঁয়তারা করছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আনরেজিস্টার্ড-২১, হোয়াইংকা চাকমারকুল, উংচিপ্রাং ২২, লেদা-২৪, আলী খালী-২৫, নয়াপাড়া মৌচনী-২৬ ও জাদিমুড়া ক্যাম্পসহ ৩৩টি ক্যাম্পে বসবাস করছে রোহিঙ্গারা। ভাসানচর ক্যাম্পে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করছে। আশ্রয় নেওয়ার পর কিছুদিন পরই রোহিঙ্গাদের মধ্যে একটি অংশ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তারা অস্ত্র, মাদক কারবার ও চাঁদাবাজির মতো ঘটনা ঘটায় অহরহ। প্রতিদিনই উখিয়া-টেকনাফ, তুমরু, নাইক্ষ্যংছড়ি, বান্দরবান সীমান্ত দিয়ে নিয়মিত প্রতিটি ক্যাম্পে প্রবেশ করছে অস্ত্র, ইয়াবার চালান। এসব কারবার নিয়ন্ত্রণ করতে ক্যাম্পকেন্দ্রিক গড়ে উঠেছে অসংখ্য সশস্ত্র গ্রুপ।
পুলিশ সূত্র জানায়, আরসার ২৭টি গ্রুপের প্রতিটির সদস্য সংখ্যা অন্তত একশ।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, রোহিঙ্গা অপরাধীদের যারা অস্ত্র ও মাদক কারবারে জড়িত তাদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে। ইতিমধ্যে একাধিক অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। সুত্র: দেশরুপান্তর