মনিরুল ইসলাম::
ছালাম সাহেব তিনজন লোককে সন্দেহ করছেন। তাদের মধ্যে কেউ একজন সুব্রত বাইনকে তথ্য দিয়েছে। প্রথম সন্দেহ খালেকের উপর। খালেক তাঁর গাড়ির ড্রাইভার ছিল। গাড়ি ভালোই চালাতো। আচার-ব্যবহার ভাল ছিল। একটাই তার দোষ ছিল। নেশা করতো। ছয়মাস হলো খালেককে চাকরিচ্যূত করা হয়েছে। দীর্ঘদিন এখানে কাজ করেছে। পরিবারের সব খুঁটিনাটি বিষয় তার নখদর্পনে। খালেকের বাডড়ি বরিশাল অঞ্চলে। সুব্রত বাইনও নাকি ওই এলাকার। ছালাম সাহেব খালেকের অনেক উপকার করেছেন। খালেকের একমাত্র ছেলে দূরারোগ্য রোগে আক্রান্ত ছিল। ছালাম সাহেব তাকে চেন্নাইতে পাঠিয়ে চিকিৎসা করিয়েছে। ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা খরচ করেছেন। খালেক সবসময়ই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। এমনকি শেষদিন বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার আগে ছালাম সাহেবের পা ধরে তাঁর উপকারের কথা জানিয়েছে। খালেক সুব্রত বাইনকে খবর দিতে পারে। ছালাম সাহেব নিশ্চিত হতে পারছেন না। তরুণ কর্মকর্তার প্রশ্নে ছালাম সাহেব জানান তিনি ফেসবুক ব্যবহার করেন না। মেয়েকে ফোন করে তার ফেসবুক আইডি জানতে চাইলে মেয়ে খুব অবাক হয়। ছালাম সাহেবের সাথে কখনো ফেসবুক নিয়ে কথা হয়নি। মেয়ে কারণ জানতে চাইলে ছালাম সাহেব বাসায় এসে খুলে বলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফোন ছেড়ে দেন। তরুণ পুলিশ কর্মকর্তা মেয়ের টাইমলাইন পর্যালাচনা করেন। ছালম সাহেবের মেয়ের কোনো ব্যক্তিগত তথ্য ফেসবুকে নাই। ফেসবুক থেকে সুব্রত বাইনের তথ্য পাওয়ার কোনো সুযোগ নাই। তরুণ কর্মকর্তার অনুরোধে ছালাম সাহেব ছেলের কাছ থেকে জানতে পারেন ব্যস্ততার কারণে ছয় থেকে সাত মাস আগে তার আইডি ডিঅ্যাকটিভ করেছে। সেখান থেকেও সুব্রত বাইন তথ্য পায় নাই। ছালাম সাহেবের কর্পোরেট অফিসের অ্যাকাউন্ট সেকশনের দুজন এমপ্লয়িকে ছাঁটাই করা হয়েছিল। ছালাম সাহেবের ছেলেমেয়ে দুজনই কোম্পানির পরিচালক। পরিচালকদের সকল তথ্য অফিসে সংরক্ষিত আছে। দীর্ঘদিন চাকরি করার সুবাদে চাকরিচ্যূত দুজনও তাঁর পরিবারের তথ্য জানে। তারাও সুব্রত বাইনকে তথ্য দিতে পারে। আসামি ধরা পড়লে তাঁকে জানানো হবে বলে ডিআইজি সাহেব তাঁকে বাসায় যেতে বলেন।
ছালাম সাহেব হতাশ হন। তাঁর মনে হয় ডিআইজি সাহেব বিষয়টার গুরুত্ব বুঝতে পারছেন না। নাকি বুঝেও গুরুত্ব দিচ্ছেন না। ছালাম সাহেব দ্বন্দ্বে পড়ে যান। তিনি ডিআইজি সাহেবকে বলে কি ভুল করলেন। তাঁর তো জীবন মরণ সমস্যা। ডিআইজি সাহেব তাঁর বিষয়টি হাল্কাভাবে নিয়েছেন। ছালাম সাহেব আপসোস করেন। চা আসে। ছালাম সাহেব দ্রুত চা খান। তিনি যত তাড়াতাড়ি এখান থেকে বের হতে পারেন ততই মঙ্গল। একটাই স্বস্তি মেয়েটা বাসায়। নিরাপদে আছে। ছেলে তো ফ্লাইটে আছে। সেও নিরাপদে। ডিআইজি সাহেব ছালাম সাহেবকে এ নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করতে না করেন। ডিআইজি সাহেব নিজে লোক-লস্কর নিয়ে চলাফেরা করেন। তাছাড়া একমাত্র মেয়ে কানাডায় আছে। তাঁর তো কোনো চিন্তা নাই। ছালাম সাহেবের দুঃখ তিনি কী করে বুঝবেন। এতো দিনের পুরোনো বন্ধু অথচ আজ ছালাম সাহেবের বিপদটাকে তিনি আমলেই নিচ্ছেন না। পুলিশের সাথে কারো বন্ধুত্ব হয় না-মানুষ বোধহয় যথার্থই বলে। ছালাম সাহেবে মনে পুলিশকে বিপদের কথা জানিয়ে তিনি ফেঁসে গেছেন। সুব্রত বাইন তাঁকে বারবার সতর্ক করেছেন। পুলিশকে জানালে বিপদ বাড়বে। পুলিশের কর্তারাও নাকি তাকে ট্যাক্স দিয়ে চলে। পুলিশ তার কিছুই করতে পারবে না। যদি সুব্রত বাইন পুলিশের খবরটা জেনে যান তিনি বিপদে পড়ে যাবেন। কেন যে তিনি ডিআইজি সাহেবকে বিষয়টা জানাতে গেলেন। তিনি একটা বড় রকম ভুল করে ফেলেছেন। ছালাম সাহেব অন্যমনস্ক হয়ে যান।
বাসায় ফিরে ছালাম সাহেব অসুস্থ বোধ করেন। ব্লাড প্রেসারটা বেড়েছে। ডিআইজি সাহেবের পরামর্শে তিনি মোবাইল বন্ধ রেখেছেন। অনেকক্ষণ তিনি মেয়ের হাত ধরে চুপচাপ বসে থাকেন। মেয়ে কিছুটা অবাক হয়। ক'দিন বাদে বিয়ে তাই হয়তো বাবার মন খারাপ। ডিআইজি সাহেবের সাথে মাঝে একবার কথা হয়। সুব্রত বাইনের কল লোকেশন নাকি মাদারীপুর। এ খবর শুনে ছালাম সাহেবের কি লাভ। সুব্রত বাইন যেখানেই থাকুক তার লোকজন তো ঢাকায় আছে। ছালাম সাহেবের বাসার সামনেও থাকতে পারে। তিনি চোখের সামনে এসিডে বিকৃত ভিখারীর মুখটা দেখতে পান। তিনি পুনরায় সিদ্ধান্ত নেন সুব্রত বাইনকে টাকাটা দেবেন। ডিআইজি সাহেবকে কিছু জানাবেন না। ফোন অন করে সুব্রত বাইনের নম্বরে কল করেন। না, সুইচ অফ। সুব্রত বাইন কি তাহলে সব জেনে গেছে? ছালাম সাহেব নতুন করে আতঙ্কিত হন। রাতে ছালাম সাহেব ঘুমাতে পারেন না। পরেরদিন মেয়েকে ইউনিভার্সিটি যেতে দেন না। সাত সকালে ছেলে বিমান থেকে নেমে ছালাম সাহেবকে এয়ারপোর্টে দেখে অবাক হয়। বাবাতো তাকে এয়ারপোর্টে সিঅফ কিংবা রিসিভ করে না। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরেন তিনি। ছেলে বাবার আচরণ কিছুতেই বুঝে ওঠে না। গাড়িতে বাবা অন্যমনস্ক। বোনের বিয়ের প্রসঙ্গে ছেলের নানা প্রশ্নের জবাবে ছালাম সাহেব টুকটাক কথা বলেন। ছেলে বুঝতে পারে বাবা কোনো কথা বলতে চাচ্ছেন না।
বাসায় ফিরে ছালাম সাহেব ফোন অন করে আবারও সুব্রত বাইনের নম্বরে ডায়াল করেন। মোবাইল যথারীতি বন্ধ। ডিআইজি সাহেব নাকি সুব্রত বাইনকে ধরে ফেলবেন। ছালাম সাহেব পুরোপুরি বিশ্বাস রাখতে পারছেন না। বিকালে নিজেই ডিআইজি সাহেবকে ফোন করেন। ডিআইজি সাহেব এবারো আশ্বাস দেন। কিন্তু কবে ধরা পড়বে। ধরা পড়ার আগেই যদি তাঁর ছেলে কিংবা মেয়ের কোনো ক্ষতি করে ফেলে। পরের দুদিন সাপ্তাহিক ছুটি। মেয়ের ভার্সিটি বন্ধ। মেয়েকে তিনি বাসা থেকে বের হতে দেবেন না। কিন্তু ছেলেকে কি বলে আটকাবেন। বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে ছেলের সাথে নিজের বডিগার্ড দেন। ছেলের আপত্তি আমলে নেন না। তবু প্রতিটা মুহূর্ত তিনি আতঙ্কে কাটাচ্ছেন। দুদিন পর ফোন অন করতেই কল আসে। সুব্রত বাইন। সুব্রত বাইন এবার সরাসরি চার্জ করে। নানা হুমকি দিতে থাকে। কেন ছালাম সাহেব থানায় গিয়েছিল কৈফিয়ত চায়। ছালাম সাহেব বুঝাতে চেষ্টা করে তিনি থানায় যান নাই। সুব্রত বাইনের কণ্ঠ চড়া হতে থাকে। টাকার অঙ্ক দশ লাখ বাড়িয়ে দেয়। পঞ্চাশ লাখ টাকাই দিতে হবে। অতিরিক্ত দশলাখ জরিমানা। থানার ওসি তার পকেটে থাকে সুব্রত বাইন তাও জানিয়ে দেয়। কিন্তু ছালাম সাহেব তো থানায় যায়নি। এই প্রথম তাঁর খটকা লাগে। তিনি দোতলার জানার কাছে এসে বাইরে তাকান। সামনের রাস্তায় কাউকে দেখা যায় না। দূরে একটা পুলিশ ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। সুব্রত বাইন জানালো বাসার গেটের সামনে তার ছেলেরা পাহারা দিচ্ছে। ছালাম সাহেব ভাবেন হয়তো আড়ালে কোথাও আছে। কোন রিস্ক নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তিনি টাকাটা দেবেন। পঞ্চাশ লাখই দেবেন। সুব্রত বাইন একটি কুরিয়ার সার্ভিসের কথা বলেছে। কোন শাখায় কার নামে টাকা দিতে হবে তাও বলে দিয়েছে। থানার সাথে যোগাযোগ করলে সে চরম প্রতিশোধ নেবে তাও জানিয়ে দিয়েছে। সুব্রত বাইনের ফোন রাখার দশ মিনিটের মাথায় ডিআইজি সাহেবের ফোন আসে। তিনি ছালাম সাহেবকে সরাসরি টাকার প্রসঙ্গ তোলেন। তিনি সুব্রত বাইনকে টাকা দিতে নিষেধ করেন। ছালাম সাহেব রেগে যান। সুব্রত বাইনের কিছু করতে পারছে না অথচ তাঁর ফোনে পুলিশ আঁড়ি পেতেছে। পুলিশকে সরাসরি গালিও দেওয়া যায় না। জীবনে তিনি আর পুলিশের সাথে যোগাযোগ রাখবেন না।
পরের দিন ডিআইজি সাহেব ফোন দেন। ছালাম সাহেবকে ফোন খোলা রাখতে বলেন। সুব্রত বাইনের ফোন আসে। ডিআইজি সাহেবের পরামর্শ মতো তিনি নির্ধারিত অ্যাড্রেসে পাঁচ লাখ টাকা পাঠান। সুব্রত বাইন টাকা পাঠানো হয়েছে শুনে কিছুটা আশ্বস্ত হয়। সন্ধ্যার আগেই বাকি টাকা পাঠানোর তাগাদা দিয়ে সে ফোন কেটে দেয়। ডিআইজি সাহেবের পরামর্শমতে ছালাম সাহেব ফোন বন্ধ রাখেন। দূশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে ছালাম সাহেবের রাত কাটে। সকালে নাস্তার টেবিলে বসে ডিআইজি সাহেবের ফোন পান। চার সহযোগী সহ সুব্রত বাইন ধরা পড়েছে। কুরিয়ার সার্ভিস থেকে টাকা নিতে আসা লোকটা প্রথম ধরা পড়ে। যে নম্বর থেকে ফোন করেছে সেই ফোনসহই গ্রেপ্তার হয়েছে। ডিআইজি সাহেবের অনুরোধে ছালাম সাহেব তাঁর অফিসে যান। রোগ চেহারার একজন লোককে সামনে আনা হয়। বয়স পঞ্চাশের উপর। এই নাকি সুব্রত বাইন...(দ্বিতীয় পর্ব)
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলামের ফেসবুক থেকে নেয়া